Sunday, May 19, 2024
spot_img
Homeবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভারতীয় জুয়াড়িচক্রের অর্থপাচার

ভারতীয় জুয়াড়িচক্রের অর্থপাচার

গেমস তৈরির আড়ালে বাংলাদেশে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ নামক জুয়ার ওয়েবসাইট পরিচালনা করছে ভারতের মুনফ্রগ ল্যাবস কোম্পানি লিমিটেড’ ও ‘উল্কা’ নামক দু’টি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি এনবিআর হানা দিয়ে প্রতিষ্ঠান দু’টির ৮০ কোটি টাকা জব্দ করেছে। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ালে আদালত পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখায় ‘উল্কা গেমস লিমিটেড’র ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন স্থগিত করেন আদালত। যদিও এ আদেশের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ববোর্ডকে (এনবিআর)কে আইন মেনে অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দেন।

গতকাল রোববার বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে আদালত একটি অভিযানের প্রেক্ষাপট আমলে নিয়ে এনবিআর’র উ্েদ্দশ্যে বলেছেন, উল্কা গেমস ও ভারতীয় কোম্পানি মুনফ্রগ বরাবর দাবিনামা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পাঠাতে হবে। গতকালের শুনানিতে ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী। ভারতীয় কোম্পানি ‘মুনফ্রগ’র পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আনিতা গাজী রহমান। উল্কা গেমসের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার নাজমুস সালেহীন।

এর আগে গত ৩০ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় গ্রাহকের পাওনা টাকা আদায়ে এনবিআরের অভিযান পরিচালনার প্রেক্ষাপটে ১ মে ছুটির দিনেও আদালত পরিচালনা করা হয়। ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্য দুটি কোম্পানির আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির অনুমোদনে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ বসেন।

অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী বলেন, আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও কোনো ধরণের নোটিশ ছাড়া এনবিআরের ১৫ জনের টিম রাতভর তল্লাশি চালায়। তারা ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করেন। রাত ১২টা পর্যন্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের আটকে রাখেন। ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী ব্যাংকের গুলশান শাখায় উল্কা গেমস লিমিটেডের নামে থাকা হিসাব ফ্র্রিজ থাকার বিষয়টিও আদালতে উপস্থাপন করেন।

এদিকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, গেমস তৈরির আড়ালে বাংলাদেশে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ নামক জুয়ার ওয়েবসাইট পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে ভারতের মুনফ্রগ ল্যাবস কোম্পানি লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। গত কয়েক বছরে অনলাইন জুয়াড়িরা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দিয়েছে। অবৈধ এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় ‘উল্কা গেমস’র বাংলাদেশি এজেন্টকে একবার গ্রেফতারও করা হয়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংকও। তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার তথ্য উদঘাটিত হয়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এনবিআরকে বিষয়টি অবহিত করে। এ অনুসারে এনবিআর’র ঝটিকা অভিযান চালায়। অভিযানে মুনফ্রগ ও উল্কা গেমসের ৮০ কোটি টাকা জব্দ করে সংস্থাটি।

এর আগে ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর এক অভিযানে উল্টা গেমস’র এদেশীয় সিইও জামিলুর রশিদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তিনি এই অনলাইন জুয়া চক্রের মূল হাতা। ২০১৭ সালে ভারতের প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবসের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। ২০১৮ সালে মুনফ্রগের বাংলাদেশীয় এজেন্ট হিসেবে দেড় লাখ টাকার বেশি বেতনে এতে যুক্ত হন তিনি। মুনফ্রগের অনলাইন জুয়ার অ্যাপ তিনপাত্তি গোল্ডের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জামিলুর রশিদ ‘উল্কা গেমস’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। দেশে গেমস তৈরির অনুমোদন থাকলেও জুয়ার বৈধতা না থাকায় ‘গেম ডেভেলপ’ করার মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি উল্কা গেমসের নিবন্ধন নেন। এমনকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছ থেকে গেম বানানোর কথা বলে অনুমতি নেন ‘উল্কা গেমস লিমিটেড’-এর। এরপর মুনফ্রগ ল্যাবসের মাধ্যমে দেশে অনলাইন জুয়ার কারবার শুরু করেন। মুনফ্রগ থেকে কাগজে-কলমে মাত্র সোয়া কোটি টাকার কথিত বিনিয়োগ এনে অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে ব্যাংকিং চ্যানেলেই ২শ’ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে চক্রটি। এ ধারাবাহিকতায় এখনও অবৈধ জুয়ার জব্দ টাকাকে ‘কোম্পানি লিগ্যাল ম্যাটার’ দাবি করছে প্রতিষ্ঠান দু’টি। এরই মধ্যে জামিলুর রশিদ গ্রেফতার হয়ে কয়েক মাস কারাভোগ করে জামিনে মুক্ত হন। মুক্তিলাভ করেই নামেন আইনি লড়াইয়ে। এখন এনবিআর’র জব্দকৃত টাকা ছাড়িয়ে নিতে উচ্চ আদালত পর্যন্ত দৌড়-ঝাঁপ করছেন তিনি।

বৈদেশিক বিনিয়োগ’র কথা বলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতি নেয় ‘মুনফ্রগ’। ব্যাংকিং চ্যানেলে একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়েছে ভারতের এই জুয়াড়ি কোম্পানি। অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে কোম্পানিটি ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশ থেকে অন্তত ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছে। পরের অর্থবছরে সরিয়েছে অন্তত ৫৭ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থ বছরে পাচার করে ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা । বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতি থাকায় অনলাইন জুয়াড়ি কোম্পানিটি ব্যাংকিং চ্যানেলে বাংলাদেশ থেকে এ অর্থ বিদেশ নিয়ে যায়। এভাবে অনলাইনে জুয়ার মাধ্যমে গত তিন বছরে ১৭৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় মুন ফ্রগ। ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও হুন্ডির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান দু’টি হাজার কোটি টাকা পাচার করে।

অনলাইন জুয়া পরিচালনার অভিযোগে মানি লন্ডারিং আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ একাধিক আইনে ২০২২ সালের ১ নভেম্বর জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা (নং-০১/৩১৯) হয়। এ মামলা গ্রেফতার করা হয় জুয়াড়ি চক্রের হোতা জামিলুর রশিদ (৩১), সায়মন হোসেন (২৯), মো. রিদোয়ান আহমেদ (২৯), মো. রাকিবুল আলম (২৯), মো. মুনতাকিম আহমেদ (৩৭) ও কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ (৩২)। ওই বছর ৩০ অক্টোবর অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা থেকে র‌্যাব তাদের গ্রেফতার করেছিল। তারা প্রত্যেকেই এখন জামিনে।

এদিকে অনলাইন জুয়া বা ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধানও জামিনে মুক্ত হয়েছেন গতবছর অক্টোবরে। তারা বিরুদ্ধে ৮ বছরের দন্ডাদেশ থাকলেও ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে জামিনে মুক্ত হন তিনি। মুক্ত হয়েই নিজ জেলা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এখন তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে প্রার্থিতা ঘোষণা করে প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত। যদিও এক প্রতিদ্বন্দ্বীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ তার প্রার্থিতা ও প্রতীক বরাদ্দের ওপর স্থিতাদেশ জারি করেছেন। সমাজ বিশ্লেষক ও আইনজ্ঞরা বলছেন, অনলাই জুয়া একটি অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে দেশী-বিদেশি চক্র জড়িত। ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী মহলও জড়িত রয়েছেন। তাদের ছত্রছায়া না থাকলে এ ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম প্রকাশ্যে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments