Sunday, May 19, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামছোট্ট নিষেধাজ্ঞা : কিছুটা অপমান, কিছু স্বস্তি

ছোট্ট নিষেধাজ্ঞা : কিছুটা অপমান, কিছু স্বস্তি

ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল,/ গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল-কী এক দ্যোতনা, তাই না? অ্যা থিং অব বউটি ইজ জয় ফর এভার-কী চিরন্তন আবেদন সৃষ্টিকারী এক কবিতার লাইন, তাই না? আবার যেখানে পাইবে ছাই … পেলেও পেতে পার অমূল্য রতন, কী বলে দেয়? নিশ্চয়ই বলে, কোনো কিছুই ফেলনা নয়, অবহেলা করতে নেই, কার ভেতর কী লুকিয়ে আছে কে জানে? বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা,/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়,/ দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিত্তে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,/ দুঃখ যেন করিতে পারি জয়-কী, কেমন লাগে শুনতে? কী এক অমর চাওয়া না? আর দ্য উডস আর লাভলি, ডার্ক অ্যান্ড ডিপ/ বাট আই হ্যাভ প্রমিজেজ টু কিপ/অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ/ অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ-এসব কি কবিতার অংশ, না নিজের আত্মার এক বহিঃপ্রকাশ? টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন-ফেলে দেওয়া যায়? রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার অংশটুকু বোটানিক্যাল গার্ডেনের একটা অংশে (বিদেশি গাছের) লেখা ছিল, এখন আর দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের সঙ্গে মিশে আছেন? কিটসকে বলা হয় রোমান্টিক কবিদের মধ্যে লাস্ট টু কাম অ্যান্ড ফার্স্ট টু গো-কিন্তু অল্প বয়সেই সে কী সৃষ্টি? আর শেকসপিয়র তো যুগে যুগে রাজা-রানিরও উপরের রাজা হয়েই থেকে গেলেন, থেকে যাবেন। নজরুলের কোনটা ফেলে কোনটা বলি-কারার ওই লৌহ কপাট, নাকি চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,-আহারে, ক্ষুদ্র জীবনে তাদের সে কী বাণী, কী অমরত্ব! ভাববেন, বিষয়ের সঙ্গে কি এসব মানায়? কেউ হয়তো ভাবছেন, ধান ভানতে শিবের গীত-তাই না? না, আমি বলি, র‌্যাবের জনা সাতেক সাবেক/বর্তমান কর্তাবাবুর ওপর আমেরিকার ওদেশ গমনে বা ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞায় পোয়েটিক বিউটি রয়েছে। এই যে উদ্ধৃত কবিতাংশগুলোয় যেমন আশার আলো রয়েছে, মনের পরিতৃপ্তি রয়েছে অসীম, হতাশ না হওয়ার প্রেরণা আছে যথেষ্ট, তেমনই মানবিকতার লঙ্ঘনের অভিযোগে আমাদের এসব কর্তাবাবুর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও আমাদের কিছুটা অপমান হয়তো আছে, কিন্তু কিছু স্বস্তিও তো আছে, না কি? এখন তো অনেকদিন আর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার-এসবের বালাই দেখছি না।

পুলিশের অনেক ছোট ছোট অপকর্ম আমাদের বড় একটা খাদে ফেলে দিয়েছে। আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল এ পুরোনো বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা বেশ নিচে নেমে গেল বলে। খালেদা জিয়ার আমলে র‌্যাব গঠনের সময় আমি প্রসঙ্গত আলাপ-আলোচনায় এর প্রয়োজন ছিল না বলেই অভিমত ব্যক্ত করতাম, যেমন আমি রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি একদম পছন্দ করিনি। একটা সুপ্রতিষ্ঠিত পুলিশবাহিনীকে প্রশিক্ষণে, সুযোগ-সুবিধায় এলিট করতে পারলেই তো উত্তম, আরেক র‌্যাব কেন? এতে পুলিশের মূল বিরাট অংশটি যেন এলিট নয়-এমন ধারণায় পড়ে যায় না? চাকরিতে আন্তঃবাহিনীর মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকা স্বাভাবিক-যেমন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিজিবি; আবার সিভিল সার্ভিসের অনেক ক্যাডারের মধ্যে যেমন প্রশাসন, কাস্টমস, ফরেন সার্ভিস, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি। আন্তঃক্যাডার বৈশিষ্ট্য, কর্মপরিধি, পদোন্নতি, পদায়ন প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আলাদা হতেই পারে, কিন্তু অন্তঃক্যাডার বা অন্তঃবাহিনীতে তো ভিন্নতা থাকার কথা নয়। একই বাহিনী বা ক্যাডারের নিজস্ব রীতি-পদ্ধতিতে, নিজস্ব চাকরি বিধিমালায়, নিজস্ব প্রশিক্ষণে, স্ব স্ব সুযোগ-সুবিধা বা প্রাপ্তিতে নিজেদের পদোন্নতি-পদায়নের ব্যাপ্তি স্বাভাবিকভাবেই স্বীকৃত। ফলে অন্তঃবাহিনীতে বা অন্তঃক্যাডারের মধ্যে কোনো অংশকে আলাদাভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়ার জন্য আলাদা ইউনিট বা ব্যাটালিয়ন সৃষ্টির কোনো প্রয়োজন হয় না। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গঠন করে বরং বৃহৎ অংশের মূল পুলিশ বাহিনীকে ধারণাগতভাবে যেন নন-এলিট ভাবার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে অন্তঃবাহিনীর দুই অংশের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক ফারাক যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই কিছুটা হলেও হীনম্মন্যতার প্রকাশ হয়তো অলক্ষে এসে গেছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে আমরা দেখলাম যে, র‌্যাবের কর্তৃত্ব, দ্রুততা, চলনবলন যেন পুলিশ থেকে কিছুটা ভিন্নতর, হয়তো সৃষ্টিটাই এ উদ্দেশ্যে বলে। অনেক বছর পরের বাস্তবতায় একটু খতিয়ে দেখলে আমরা কি এখন হলফ করে বলতে পারব যে, এতে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মূলত লাভবান হয়েছি, না একটা একক সুসংগঠিত বাহিনী সৃষ্টি থেকে পিছিয়ে গিয়েছি? এখন সাধারণ পুলিশকে জনগণ আর আস্থায় নিতে চাচ্ছে না কেন? কেউ ঠাট্টা করে কেন যে বলে রাস্তায় হকার থেকে, ফুটপাত থেকে, অবৈধ বাজার থেকে টাকার অঘোষিত অংশ নেওয়াও যেন যার যার এলাকাধীন পুলিশের কাজ। এটা শুনতে বুকটা ফেটে যায়।

এই কিছুদিন আগে আমাদের রূপনগর এলাকার বড় রাস্তায় হঠাৎ করে ভ্যান গাড়ির দোকান বন্ধ হয়ে গেল, জানা গেল, দৈনিক টাকা ওঠানোর একজনকে র‌্যাব আটক করেছে, ব্যস, পুলিশ আর ভ্যানগুলোকে রাস্তায় বসতে দেয় না। কয়েকদিন পর আবার নাকি আপসরফা হয়েছে, এখন আবার বসে, এখন নাকি সপ্তাহ হিসাবে ‘হাদিয়া’ তোলা হয়, দৈনিক নয়। বলুন তো, এসব শুনতে কার না খারাপ লাগে? রাস্তায় বাজার বসা নিয়েও ওসি বদলে একটু ভিন্ন তৎপরতা দেখা যায়, আবার লাইনে আসে। আমি বলি, অপর্যাপ্ত বাজেটে নিজেদের খাই-খরচা মেটাতে হয়তো এ বাড়তি উপার্জনের ব্যবস্থা। কিন্তু এতে একটা সুশৃঙ্খল বাহিনীর ভাবমূর্তি কত তলায় গিয়ে নেমেছে এবং র‌্যাব-পুলিশের আন্তঃইমেজের পার্থক্য যে কত বেড়ে গেছে তা সহজেই অনুমেয়। বিন্দু বিন্দু জল আর ছোট ছোট কণা কীভাবে যে আমাদের ক্ষতি করে দিচ্ছে তা বোধকরি এখন টের পাচ্ছি। দেশ উন্নত হওয়ায় এখন আবাসিক এলাকার অভ্যন্তরীণ রাস্তাতেও ইঞ্জিনের রিকশার আর হকারের হ্যান্ড মাইকের উৎপাতে আমরা যে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি তা দেখারও আর কেউ নেই। উভয়পক্ষের সমঝোতায় আইন আর পালিত হয় না। কষ্টটা হচ্ছে আমাদের।

উচ্চমর্যাদায় আসীন র‌্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সাত কর্তাবাবুর আমেরিকা প্রবেশে/ভ্রমণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে আমাদের সরকার স্বভাবতই ইতিবাচক হিসাবে মেনে নেয়নি। সরকারের উচ্চতম পর্যায় থেকেও অন্য দেশের তথা সংশ্লিষ্টদের নিজেদের সম-অধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ টেনে আনা হয়। নিজেদের ডিফেন্ড করার জন্য এটা স্বাভাবিক পদ্ধতি। প্রয়োজনে বাক-কৌশলে ডিফেনসিভ হওয়া থেকে অফেনসিভ হওয়া অর্থাৎ রক্ষণার্থক থেকে আক্রমণাত্মক হওয়া ক্ষেত্রবিশেষে বেশি কার্যকর। কিন্তু আমি ভাবি রাবীন্দ্রিকভাবে, আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন নেই, আমার ভয় না থাকলেই তো হলো; আমি অবস্থাটা জয় করতে পারলেই তো যথেষ্ট। আমি বলি, আমাদের র‌্যাবের যদি কোনো দোষ না থেকে থাকে তাহলে এ নিষেধাজ্ঞা আমলে নেওয়ারই বা কী প্রয়োজন? এ সাতজনের আমেরিকা না গেলে কী হয়? নিজেরা অসম্মানিত হয়েছি না ভাবলেই তো হলো, নাকি? বৈশ্বিক বিবেচনায় বা আন্তঃদেশীয় রীতিতে এমন নিষেধাজ্ঞা যদি অসম্মানের হয়, তবে তো হজম করতেই হবে। নচেৎ চলি না ডেমকেয়ার ভাবে, কী বলেন? হ্যাঁ, ত্রুটি যদি থেকেই থাকে, তা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। আর যদি নাই থেকে থাকে তাহলে জাতিসংঘের দাওয়াতেই বা শর্তসাপেক্ষে ড. বেনজীরের আমেরিকা যাওয়া কি আরও বেশি অসম্মানের হয়নি? এ এক সম্মেলনে অপমানজনক শর্তে হাজির হওয়ার মধ্যে তো বরং অপমানটা নিজেরাই বাড়িয়ে দিলাম না? ড. বেনজীর একজন দক্ষ অফিসার বটে, চাকরিগত কারণে আমার স্বাক্ষরেই তাদের নিয়োগপত্র। কমিউনিটি পুলিশিং-এর এক সম্মেলনে তিনি যখন ডিএমপির কমিশনার, আমিও দাওয়াত পেয়ে রাজারবাগের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলাম। আমি স্বভাবতই প্রো-পুলিশ, প্রো-এস্টাব্লিশমেন্ট তো বটেই-পুলিশের, ডেসকোর এলাকাধীন অনুষ্ঠানে সব সময় যোগ দিই। ওই অনুষ্ঠানে রাজারবাগে বেনজীর অনিয়ম করলে মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনের আওতায় কাউকে ঢাকা থেকে অর্থাৎ মেট্রোপলিটন এলাকা থেকে বের করে দেওয়ার সদম্ভ উক্তি করেছিলেন সেদিন, বড় খারাপ লেগেছে, যেমন তার কোনো এক বোট ক্লাবের সভাপতি হওয়ার খবর আমার ভালো লাগেনি। এখন তাকে আমেরিকা ঢুকতে শর্তসাপেক্ষে ভিসা দিলে তিনি গেলেন কেন? এটা কি তার অপমান নয়? তার না হলেও দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের অপমান/অসম্মান হিসাবেই আমার বিশ্বাস। যাওয়াটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আইজিপি সাহেব না গেলে মাথাটা উঁচু থাকত।

আমেরিকার এ নিষেধাজ্ঞা যদি আমাদের মনস্তাত্ত্বিক কোনো পরিবর্তন ঘটায় তা ভালো, তাহলে আমরা এ নিষেধাজ্ঞাকেও একটা থিং অব বিউটি হিসাবে নিতে পারি। আমরা এ নিষেধাজ্ঞার ছাই সরিয়ে অমূল্য রতনের সন্ধান পেতে পারি। আমরা অবশ্যই এখন টু বি অর নট টুবির দ্বন্দ্ব থেকে রেহাই পাওয়ায় সচেষ্ট করব। আমরা নিশ্চিতভাবেই বিন্দু থেকে সিন্ধুতে, বালিকণা থেকে মহাদেশ গড়াতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাব। আমরা অবশ্যই ভয়কে জয় করব, আমরা নিজেরাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হব যে, ঘুমের আগে অবশ্যই আমাদের আরও অনেক অনেক মাইল যেতে হবে। আমরা হতাশা ত্যাগ করে অবশ্যই নজরুলের ঊর্ধ্ব গগনের মাদল বাজাব, কী বলেন? অতএব, এ নিষেধাজ্ঞায় আমরা একটা পোয়েটিক বিউটি পেতে চাই, বেনজীর ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, আমিও-আমরা ভালোটাই দেখি না কেন? পুলিশ ও র‌্যাবের বিদায়ি দুই প্রধানের সুস্বাস্থ্য কামনা করে এবং নতুন দুই প্রধানের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের লেখাটি শেষ করছি।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments