Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeসাহিত্যচারণকবি ও কবিয়াল বিজয় সরকারের প্রয়াণ দিবস: জানা-অজানা কিছু কথা

চারণকবি ও কবিয়াল বিজয় সরকারের প্রয়াণ দিবস: জানা-অজানা কিছু কথা

কবিগান বাংলার একটি প্রধান লৌকিক ধর্ম-সম্প্রদায় ও দর্শন আশ্রয়ী সাধন সঙ্গীত। কবিগান বাউল দর্শনেরই একটি শাখা। 

বাংলার এক শ্রেণীর অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, একতারা আশ্রয়ী, ভাবদ্রোহি গায়ক, স্বাধীন ও সমন্বয়মূলক মরমী গায়ক ও সাধকদের চিন্তাধারায় আত্মপলব্ধি ভাবনার নাম বাউল দর্শন। তাদের আধ্যাত্ম-সাধনার গূঢ়-গুহ্য পদ্ধতি  দীক্ষিত শিষ্য-সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার ও ভাবশ্রীত করার উদ্দেশ্যেই এই গানের জন্ম। 

শিল্প-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস এখানে অনুপস্থিত। তথাপি নিগূঢ় আত্মশিল্প এখানে বিদ্যমান। কবি শব্দের অর্থ হলো ক্রান্তিদর্শী, আর কবিয়ালরা অন্তরচোখে ভবিষ্যতের কথাকে তাৎক্ষণিক গানের ভাষায় মঞ্চে উপস্থাপন করেন। 

আসরে দাঁড়িয়ে দুই দলের ঢোল-কাঁশি সহযোগে কবিতা গানে উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক অনুষ্ঠানের নাম কবিগান আর যিনি এ গানের স্রষ্টা ও গায়ক তাকে বলে কবিয়াল। 

লালন সাঁই ও কবিয়াল বিজয় সরকার বিশুদ্ধ শিল্প প্রেরনায় তাদের গান রচনা করেন নি, বিশেষ উদ্দেশ্য সংলগ্ন হয়েই তাঁদের গানের জন্ম। তবে উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনকে অতিক্রম করে তাদের গান অনায়াসে শিল্পের সাজানো বাগানে প্রবেশ করেছে স্বমহিমায়। 

কবিগানে অশ্লীলতা বিবর্জিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে বাংলা গানের ভান্ডারে রেনেসাঁর অভ্যুদয় ঘটান কবিয়াল বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী। তাই তাকে চারণকবি বলা হয়। 

কলকাতার ভারতীয়ভাষা পরিষদ তাঁকে চারণকবি সম্রাট বলে অভিহিত করেন। তারা তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিয়াল ও ভাটিয়ালী গানের রাজা বলেও সম্মানিত করেন। কিন্তু কবিগানের সৃজনকর্তা কে? সে উত্তরে আসলে পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগনার গুমো-হাবড়াল কবিয়াল গোবিন্দ তাঁতি এবং গোবিন্দ তাঁতির শিষ্য নড়াইলের পাঁচু দত্তের নাম বলা যায়।

জন্ম ও শৈশব: বাংলাদেশের বিখ্যাত কবিয়াল ও চারণকবি বিজয় সরকার ওরফে বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী ১৯০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি (১৩০৯ বঙ্গাব্দের ৭ফাল্গুন) নড়াইল জেলার সদর থানার ডুমদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে সবাই পাগল বিজয় বলেও ডাকতেন।  

চারণকবি বিজয় সরকারের পূর্বপুরুষ ছিলেন বৈরাগী। ওই বৈরাগী সমাজের বসতি ছিল যশোর। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে বিজয় সরকারের পূর্বপুরুষ বর্তমান নড়াইল সদরের শহরতলি থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে বিলের মাঝে কয়েকটি টিলার উপরে অবস্থিত ডুমদী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।  

বিজয় সরকারের পিতার নাম নবকৃষ্ণ বৈরাগী এবং মাতার নাম হিমালয়কুমারী বৈরাগী। বৈরাগী বংশের সন্তান বিজয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বংশের নাম পরিবর্তন করেন এবং বৈরাগীর পরিবর্তে অধিকারী নাম যোগ করেন। তখন বৈরাগীর পরিবর্তে তাঁর নাম হয় বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী। 

তৎকালীন সময়ে কবিয়াল নিম্নার্থে ব্যবহার করা হতো। তাই কবিয়াল বিজয় নিজেকে ‘চারণকবি’ হিসেবে প্রচার করেন। 

চারণ হলেন সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা বেদের শাখা বিশেষ অধ্যয়ন করেন। অর্থাৎ, সামগায়কবেদান্তী যখন বেদের টিকা-ভাষ্য নিজ নিজ কবিত্ব শক্তিতে রচনা করে শ্রোতাদের মন হরণ করেন তখনই তিনি চারণকবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। চারণকবি উচ্চাঙ্গের অর্থ প্রকাশ করে।  

কবিয়াল বিজয় সরকার ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও তাৎক্ষণিক কবিত্ব সত্ত্বার অধিকারী। সাধারণত কবিয়ালদের দলে যাঁরা গান রচনা করতেন তাদের সরকার বলা হতো। কিন্তু কবিয়াল নিজেরই নিজের গান রচনা করতেন, সুরারোপ করতেন এবং তা মঞ্চে গাইতেন। তার আলাদা সরকার রাখার প্রয়োজন ছিলোনা। 

যেহেতু তিনি নিজেই নিজের গান রচনা করতেন তাই তার নামের শেষে যুক্ত হয়ে গেল সরকার।আর তিনি হয়ে গেলেন বিজয় সরকার। 

বিজয় সরকারের পিতা নবকৃষ্ণ গ্রাম্যসংগীত ও কবিগানের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান লাঠিয়াল। 

নবকৃষ্ণের দশ ছেলেমেয়র মধ্যে বিজয় সরকার ছিলেন সর্বশেষ অর্থাৎ দশম সন্তান। তাঁর বড়দিদি সোহাগী বিশ্বাসের কোলেপিঠেই তিনি তাঁর শিশুকাল কাটিয়েছেন। ঘুম পাড়ানো, খাওয়ানো, গোসল করানো থেকে শুরু করে যাবতীয় দেখভাল তাঁর বড়দিদি ই করতেন। 

মাতা হিমালয়কুমারী ও পিতা নবকৃষ্ণ ও বিজয় কে যথেষ্ট আদর করতেন। সারাক্ষন চোখে চোখে রাখতেন। এভাবেই কেটে যায় তাঁর শিশু কাল।

কৈশোর ও শিক্ষাজীবন: বিজয়ের জ্যাঠতুত ভাই অভয়চন্দ্র বৈরাগী শিশু বিজয়কে পড়াশুনায় মন লাগান এবং লেখার হাতে খড়ি দেন। তার পিতা তাকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন সেখানে শিক্ষক ছিলেন ডুমদী গ্রামের নেপাল বিশ্বাস এবং লোকজন তাকে নেপাল পন্ডিত বলে ডাকতো।
 
তিনি ছিলেন সংগীত অনুরাগী ও ওস্তাদ ব্যক্তি। কিশোর বিজয় পাঠশালায় অধ্যায়নকালে গ্রামের বিয়েতে গান গেয়ে নেপাল বাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর থেকে নেপাল পন্ডিত পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে বিজয়কে গানের তালিম দিতে থাকেন। 

এভাবেই বিজয়ের গানের হাতে খড়ি শুরু হয়। কিশোর বয়সেই বিজয় যাত্রাদলে গান গেয়ে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন।বিজয় সরকার কিশোর বয়সে অতিব চঞ্চল ছিলেন। 
পাঠশালার অধ্যয়ন শেষ করে বিজয় সরকার হোগলাভাঙ্গা ইউ.পি. স্কুলে ভর্তি হন। 

চঞ্চল বিজয় সরকারের এই সময় গ্রীষ্মের দুপুর কাটতো এই গাছ সেই গাছ বেয়ে। একবার তেঁতুল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বিজয়ের ঠোঁট কেটে যায়- আজীবন ঠোঁটের ওই কাটা দাগ নিয়েই ছিলেন বিজয় সরকার। লোকে তাকে বলতো ‘ঠোঁটকাটা বিজয়’। 

আদতে নির্দয় সত্যাশ্রয়ী তার্কিক অর্থেই লোকে তাকে জানতো এবং এজন্য ঠোঁটকাটা বলতো। হোগলাভাঙ্গা ইউ.পি. স্কুলের অধ্যয়ন শেষে বাঁশগ্রাম এম.ই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। বাঁশ গ্রামের প্রধান শিক্ষক ভুবন মোহন ঘোষ কর্তৃক বিজয় সরকার সংগীতচর্চায় বেশ উৎসাহিত হন। 

অতঃপর বাঁশগ্রাম স্কুল ত্যাগ করে সিঙ্গাশোলপুরের কে.পি. ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তিনি। এখানেও তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে সংগীত চর্চায় উৎসাহ পান। 

১৯২৬ সালে বিজয় সরকার মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন এবং এখানেই তার শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। তবে তিনি পুনরায় পরীক্ষা না দিয়ে টাবরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।

বিজয় সরকারের সঙ্গীত জীবনের শুরু: কিশোর বয়স থেকেই বিজয় সরকার সংগীতের প্রতি ব্যাপক আকৃষ্ট ছিলেন। মাঠে-ঘাটে, ধানক্ষেতের আল পথ দিয়ে তিনি নিজের মনে নিজের সুরে গান গেয়ে বেড়াতেন। ওই গানের কথা ও সুর কারো কাছ থেকে শোনা কিংবা শেখা নয়। 

নিজেই তাৎক্ষণিক রচনা করে তাতে সুর দিয়ে গাইতেন তিনি। কিশোর বয়সেই পঞ্চানন মজুমদার , পুলিনবিহারি প্রমুখ গ্রাম্য কবিয়ালদের সাথে পাঁচালি গানে পাল্লা দিয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। এসময় গিরিশচন্দ্র সরকার বিজয় সরকারকে সংগীতবিদ্যায় উৎসাহিত করেন ও তালিম দেন। 

গিরিশচন্দ্র বিজয় সরকারের পিতা নবকৃষ্ণকে বলে তাঁর গানের দলে বিজয় সরকার কে অন্তভুক্ত করেন। ইতোমধ্যে বিজয় সকার গোপালপুর কাঁচারির নায়েব নিযুক্ত হন এবং সংগীত চর্চা অব্যাহত রাখেন। বাংলা ১৩৩৩ সনের কথা। 

তখন তিনি হোগলাডাঙ্গায় ফরিদপুরের মনোহর সরকার ও খুলনার মনোহর সরকারের মধ্যে পালা গান হয়। বিজয় সরকার সেই পালা গান শোনেন। রাত্রিশেষ মনোহর সরকারের গানে মুগ্ধ হয়ে তিনি একতারা বাজিয়ে তাঁকে একটি গান শোনান। 

‘আমি গুরু বৈমুখ হইয়া রইলাম ভাই
এ মুখ কেউ দেখেনা,
আমার এ মুখ দেখলে পরে
তার দুঃখ আর যাবে না’।

গান শুনে মুগ্ধ হয়ে মনোহর সকার তাঁকে কবিগান শিখাতে আগ্রহী হন এবং দু বছর তালিম দেন। পরবর্তীতে রাজেন সরকারের কাছে এক বছর তালিম নেন। কিশোর বয়স থেকেই বিজয় সরকার সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন এবং ওস্তাদ গনের কাছ থেকে কবিগান শেখার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। 

কবিয়াল গুরু, এমনকি গুরুর স্ত্রী পরিজনের কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে ঘর গৃহস্থালি, গরু-রাখালি পর্যন্ত করতেন। কোথাও গানের পারিশ্রমিক পেলে তা গুরুকে দিয়ে দিতেন। 

কবিয়াল বিজয়ের কবিগান: গুরু মনোহর সরকারের অনুমতি নিয়ে বাংলা ১৩৩৬ সালে বিজয় সরকার পৃথক কবিগানের দল তৈরি করেন। দল তৈরির পর পরই তিনি প্রথম গান করেন ভেন্নাবাড়ির কবিয়াল মহিমা সরকারের সঙ্গে। 

অল্পদিনেই সুমধুর কণ্ঠী বিজয় সরকারের নাম ডাক চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সমসাময়িক ডাকসাইতে কবিয়ালদের বায়না কমতে থাকে কিন্তু বিজয় সরকারের বায়না ক্রমশ বাড়তে থাকে। অন্যান্য কবিয়ালদের যন্ত্রীরা বিজয় সরকারের দলে এসে ভিড় করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে বিজয় সরকার ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তাঁকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। 

এর নেতৃত্ব দেন এক সময়ের ওস্তাদ রাজেন সরকার। পরে তিনি ফরিদপুরের ঘোসালকান্দি গ্রামের সংগীত সমঝদার শ্যাম লালের বাড়িতে আশ্রয় লাভ করেন। এ সময় শ্যামবাবু বরিশালের বিখ্যাত কবিয়াল নকুল সরকারের সঙ্গে বিজয় সরকারের জোট করিয়ে দেন এবং তাঁরা একসাথে দীর্ঘ আড়াই বছর গান করেন। 
কবিয়াল বিজয় সারা জীবন দুটো ধারায় গান রচনা করেছেন।  

তা হলো- কবিগান ও রামায়ণ গান। মাঝে-মধ্যে জারিয়ালদের সঙ্গে কবি-জারির পাল্লাও করেছেন। কবিগান গেয়ে তিনি পারিশ্রমিক নিতেন কিন্তু রামায়ন গেয়ে কোন পারিশ্রমিক নিতেন না। বিজয় সরকারের আমলে কবিগান ছিল অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ  কথায় ভরা।
 
তাই একে বলা হতো ‘ইতরের খেউর’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন’ ক্ষণকালজাত ক্ষণস্থায়ী সাহিত্য’। বিজয় সরকার এই কবিগানকে অশ্লীলতা মুক্ত করার চেষ্টা শুরু করেন। 

বিজয় সরকারের শ্রেষ্ঠ অবদান কবিগানে নিরপেক্ষ বিচ্ছেদ ভাটিয়ালি গান। তিনি কবিসঙ্গীতের প্রতিটি স্তরে তাঁর স্বার্থক অবদান রেখেছেন।  

তার গাওয়া কবিগানের স্তর গুলো হলো: ক) ডাক বা ধরা বা আগমনী: দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে আসর বন্দনা খ) মালসী বা ভবানী বিষয়ক গান: ইষ্টের কাছে অভিষ্ট প্রার্থনা গ.) সখি সংবাদ: শ্রী কৃষ্ণের প্রতি নায়িকা রাধার প্রেমার্তিমূলক গান ঘ.) কবিগান: সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিক রচিত গান ঙ.) টপ্পা: প্রশ্ন করা ও জবাব দেয়া হয় চ.) পাঁচালি বা ছড়া: ত্রিপদী ছন্দবদ্ধ বক্তৃতা ছ) কবির ধুয়া: ভাটিয়ালি গান জ.) পয়ার: আসর শেষে বিদায়কালীন গান এবং সবশেষে পরিবেশিত মিলন সংগীত। 

বিজয় সরকারের রচিত গানের সংখ্যা হবে তিনশত পঞ্চাশের মতো। তবে এপর্যন্ত তার গানের যে সংকলন প্রকাশ পেয়েছে তাতে মত ২৭০ টি গান স্থান পেয়েছে যা লোকসঙ্গীতের অসাধারণ সম্পদ।

বাংলাদেশ ও ভারতে তিনি আনুমানিক ৪০০০ আসরে কবিগান পারিবেশন। তার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় অসংখ্য গান রয়েছে। 

বিচ্ছেদ গান গুলোর মধ্যে তুমি জানো না রে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা; আমার পোষা পাখি উড়ে যাবে প্রাণ সজনী একদিন ভাবি নাই মনে; আমার কথক মনে রইলো শ্যামল বংশীওয়ালা;  কত ভালো লাগে তোমারে কিশোর বন্ধু বাঁশরিয়ারে; 

মুর্শিদতত্ত্বের মধ্যে আছে জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কী; ভাবতত্ত্বের মধ্যে এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে; আমি কার নৌকায় উঠিব ভাবি তাই  ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয় গান। 

‘আমার পোষা পাখি উড়ে যাবে প্রাণ সজনী’- গানটি বিজয় সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি গান। লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, ১৩৫২ বঙ্গাব্দে বিজয় সরকারের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর শেষকৃত্য সেরে বাড়ি ফেরার পথে এই গানটি রচনা করেন।

বিজয় সরকারের বিবাহ ও ব্যক্তিজীবন: ফরিদপুরের শ্যামল বাবুর মাধ্যমে বাংলা ১৩৪২ সনে বিজয় সরকার বরিশালের শশীভূষণ পান্ডের কন্যা  বীনাপানি পাণ্ড কে বিয়ে করেন। 

বীনাপানি ছিলেন কলিকাতায় পড়া শিক্ষিত রমণী। তাঁর গর্ভে বিজয় সরকারের দুটো কন্যা সন্তান কাননবালা ও মঞ্জুরানী জন্ম নেন। বীনাপানির ভাইয়ের ওইসময় টি.বি. রোগ হলে ভাইয়ের সেবা করতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হন এবং বাংলা ১৩৫২ সনের ২৪ শ্রাবণ ডুমদীতে তিনি দেহ রাখেন। 

ধারণা করা হয়, এই কারণেই বিজয় সরকার শ্রাবণ মাস নিয়ে অনেক আবেগঘন বিচ্ছেদ গান লিখেছেন। তিনি লিখেছেন-
‘বাদল ভেজা নিষ্ঠুর শ্রাবণ মেঘে ঢাকা চাঁদ 
এমন দিনে হারাইয়াছি রে আমার ঘরের চাঁদ…’

তিনি আরো বলেছেন- ‘ তের শত বায়ান্ন সাল, চব্বিশে মাসবেদ, গুরুবারে শুরু হলো বিজয় বীনার ভেদ’। 

অতঃপর, বিজয় সরকার ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে ফরিদপুর জেলার সাতপাড় গ্রামের রমেশ চন্দ্র বিশ্বাসের কন্যা প্রমদা বিশ্বাসকে বিয়ে করেন। প্রমদার সংসারে তাঁর দু পুত্রের জন্ম হয়- কাজলকুমার অধিকারী ও বাদলকুমার অধিকারী। 

এ সময় কবিগান গেয়ে বিজয় সরকার প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন খুবই মিতব্যয়ী ও বৈষয়িক। বাংলাদেশ ও ভারতে তিনি ওই সময় প্রচুর জায়গা জমি কিনেন। দেশ বিভাগের পর তিনি শুধু ভারতে জমি-জিরাত বাড়াতে থাকেন। 

বিজয় সরকারের ধর্মাচার ও ধর্মবিশ্বাস: বিজয় সরকার আকৈশোর ধর্মপ্রবন ও ভক্তিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। বহুবাদ ও মুর্তিপূজায় তার তেমন আগ্রহ ছিলনা। তবে আমৃত্যু তিনি বৈশ্ববমতের মতাদর্শী ছিলেন। 

প্রথম জীবনে তিনি তার কবিয়াল- গুরু মনোহর সরকারের সঙ্গে ‘মতুয়া’ ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেন। এরপর ফরিদপুরের কোন এক ‘কাঁথার ফকিরের’ কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। কোন এক সময় বিজয় সরকার বরিশালের ‘খেজুর তলার মতে’ ছিলেন। অবশেষে তিনি ভুবন মোহন গাঙ্গুলির নিকট ‘সত্য ধর্মে’ দীক্ষা গ্রহণ করেন।  

খুব বেশিদিন এই ধারায় তিনি থাকেননি। একসময় সত্য ধর্মের আচার-আচরণের প্রতি তার অনীহা জন্মে এবং বৈষ্ণব মতে আস্থা স্থাপন করেন এবং এক সময় সত্য ধর্ম ত্যাগ করে তিনি ইসলাম ধর্মের সুফিবাদে আকৃষ্ট হন। 

নড়াইল জেলার কালিয়া থানার পেড়লি গ্রামের পির সাহেবের উপর গভীর আস্থা রেখে ইসলামী মতে অনুধ্যান ও গোপন জিকিরে অভ্যস্ত হন। দশ বছর তিনি তার কলবে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ জিকির করেছেন, এটা বিজয় সরকারের নিজের উক্তি। 

তার মৃত্যুর বিশ বছর পূর্ব থেকে তিনি তার সম্প্রদায় ও মাঝিসম্প্রদায়ের লোকদের কৃষ্ণমতের দীক্ষা দিতে থাকেন। অনেক লোক তাঁর সাধুতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে এসে দীক্ষা নিয়েছেন।

অসাম্প্রদায়িক বিজয় সরকার: বিজয় সরকার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সততা, নিষ্ঠা, কর্মের গুন বিচার করে তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তেন। বহু মুসলমানকে তিনি অতি আপন করে নিয়েছেন এবং মুসলমানরাও তাকে আপন লোক ভাবতো। 

কবিয়াল বিজয় সরকার ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার হিন্দু-মুসলিম নর-নারীর আধ্যাতিক গুরু। কিন্তু তিনি গুরুগিরির বিনিময়ে কোন অর্থ- কড়ি নিতেননা। 

শ্রী শ্রী পাগল বিজয়ামৃত পুস্তক মতে জানা যায় যে, বাংলাদেশের জনৈক মুসলিম এক ব্যক্তির চোখ বন্ধ হয়ে গেলে বিজয় সরকার ১৩৩৬ সালে ৫০ বছর বয়সে তাঁর নিজের চোখ দুটি দান করে সেই মুসলিম ব্যক্তির দৃষ্টিদান করেন। এরপর তিনি চিরকালের জন্য অন্ধত্ব বরণ করেন। এরকম আরো অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলো বিজয় সরকারের অসাম্প্রদায়িক মননের প্রমান। 


কবিগানকে অশ্লীলতা মুক্তকরণে বিজয় সরকারের অবদান: তখনকার দিনে কবিগান ছিল অশ্লীলতা যুক্ত গেঁয়ো মূর্খদের গান। নারী-পুরুষ একসাথে বসে গান শোনা ছিল দুস্কর। সেই গানে ছিল মর্ষণ ধর্ষণ আর শৃঙ্গারের স্থূল আদিরসাত্মক কথা। 

সমাজে প্রচলিত ছিল- কবি শোনে খবিশে। কবিগানকে আরো বলা হতো- ‘বঙ্গ সরস্বতীর ললাট কলংকচিহ্ন’, ‘ইতরের খেউড়’, ‘বাংলা সাহিত্যের লজ্জা’, ‘ক্ষণকালজাত ক্ষণস্থায়ী সাহিত্য’। 

কবিগানকে এ ধারা থেকে বের করে আনেন চারণকবি বিজয় অধিকারী। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসিম উদ্দিন, কবি গোলাম মোস্তফা, সুরশিল্পী আব্বাসউদ্দীন, তৎকালীন ইংরেজি জানা ডিরোজারিও শিষ্যদের সংস্পর্শে আসেন বিজয় সরকার। 

তিনি গানে তন্ময়তা, মন্ময়তা, অনুভব, যুক্তি ও জীবন নিষ্ঠতার এমন এক সমন্বয় সাধন করেছেন যার জন্য কবিয়াল সমাজে তিনি সর্বোচ্চ আসনে আসীন। কবিয়াল বিজয় সরকারের সাবলীল ও সতর্ক শব্দ প্রয়োগ, বাচনভঙ্গির আভিজাত্য কবিগানকে এক অনন্য শালীন রুচি দিয়েছে। 

প্রাচীন কবিয়ালেরা যেখানে দেহলোলুপ, রাধার প্রতি সন্দেহজনক উক্তি দিয়ে গান রচনা করেছেন সেখানে কবিয়াল বিজয় সরকার দেহাতীত প্রেমের অপূর্ব সুষমামণ্ডিত পদ রচনা করেছেন এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে এক অদৃশ্য মিলন খুঁজেছেন। 

তিনি কৃষ্ণকে পরমাত্মা ও রাধাকে জীবাত্মা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, যমুনার জলে বরণ মালা ভাসিয়ে শ্রীমতি রাধা তৃপ্তচিত্তে অবগাহন করতে চাইছেন। 

তাইতো তিনি গানে গানে প্রকাশ করেছেন- 

‘কৃষ্ণ মিলন লাগি নিশি জাগি বাসর ঘরে
মিলন নিশি হইলো ভোর,
এলোনা শ্যাম কিশোর
কিশোরীর আঁখিলোর ঝরিয়া পড়ে…’

পাগল বিজয়ের কবিগান এক রসমণ্ডিত সাহিত্যধারা এবং বাংলা সাহিত্যের এক ঐতিহ্যময় ভান্ডার। কবিয়াল বিজয়ের গানে যে আবেগ, মায়া, শিল্পবোধ ও সৌন্দর্য দৃষ্ট হয় তা বাংলা সাহিত্যের গৌরব। 

কবিসঙ্গীতের আসরে বস্তুনিষ্ঠতার বিচারে বিজয় সরকার অতুলনীয়। মানসিকতার দিক দিয়ে বিচার করলে বিজয় সরকারকে বাস্তবধর্মী শিল্পী বলা যায় না। তার মনোজগত না পাওয়া ও বিহনের বেদনায় বিবাগী হয়ে কাঁদে। 
রবিঠাকুর বলেছেন- ‘ পাগল বিজয়ের গানে শালীনরুচির পরিচয় আছে’। কবি জসিমউদ্দিন বলেছেন- ‘ মাঝে মাঝে দেশীয় গায়কদের মুখে বিজয় বিচ্ছেদ শুনিয়া পাগল হই। এমন সুন্দর সুর বুঝি কেউ রচনা করতে পারেনা’।

শেষ জীবন: বিজয় সরকার শেষ জীবনে অন্যকে চক্ষুদান করে অন্ধত্ব বরণ করেন। তৎকালীন কলকাতার পি.জি. হাসপাতাল ও ভারতের আরো কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা করেও তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফেরানো যায়নি। 

শেষ বয়সে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তার নিজ বাড়ি থেকে কন্যা কানন বিশ্বাসের বাড়িতে স্থানান্তরিত হন। আমৃত্যু তিনি সেখানেই ছিলেন। ১৩৯২ বঙ্গাব্দ এর ১৮ অগ্রহায়ণ, (১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর) বুধবার দিবাগত রাত ১০:৫৫ মিনিটে পাগল বিজয় এ ধরার মায়া ত্যাগ করে এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনি রেখে, সুন্দর ওই পৃথিবী রেখে ৮১ বছর বয়সে ওপারে চলে যান। 

আজ এই বিখ্যাত চারণকবি বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী/ পাগল বিজয় সরকারের ৩৬ তম প্রয়ান দিবস। প্রয়ান দিবসে আমাদের কাছ থেকে অশেষ শ্রদ্ধা হে মহাজন। 

লেখক: কবি, বাউল গবেষক ও ডেপুটি কমিশনার অব বাংলাদেশ কাস্টমস

তথ্যসূত্র: 
১) কবিয়াল বিজয় সরকারের জীবন ও গান, মহসিন হোসাইন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
 ২) বাংলাদেশের বাউল: সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত, ড: আনোয়ারুল করিম, বর্ণায়ন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
৩) ভাটিয়ালি গানের রাজা পাগল বিজয়, মহসিন হোসাইন, ঢাকা, বাংলাদেশ।


৪) শ্রী শ্রী পাগল বিজয়ামৃত, বাসুদেব গোলদার, কলিকাতা, ভারত।
৫) জীবন কথা গ্রন্থ, কবি জসিম উদ্দিন, ঢাকা, বাংলাদেশ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments