Friday, July 26, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামকেমন হবে আগামী দিনের বিশ্ব?

কেমন হবে আগামী দিনের বিশ্ব?

মানবজাতি বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমান বিশ্বসভ্যতার ঠিকানায় পৌঁছেছে। কিন্তু এই বিশ্বসভ্যতা টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে চরম উদ্বেগ।

২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরু হওয়ার তিন দিন পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পারমাণবিক অস্ত্রের দায়িত্বে থাকা বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতায় রেখেছিলেন। যারা রাশিয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, সেসব দেশকে নজিরবিহীন পরিণতি ভোগ করার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

রাশিয়ার কাছে সর্বাধিকসংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত আছে। রাশিয়ার হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ৫ হাজার ৯৭৭। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রাশিয়ার হাতে আছে ৫৫০টি বেশি পারমাণবিক অস্ত্র।

পৃথিবীর পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের ৯০ শতাংশেরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। তবে উদীয়মান শক্তিধর দেশ চীন অস্ত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। তিন শতাধিক নতুন ক্ষেপণাস্ত্র তাদের মজুতে যোগ হয়েছে। তারা পারমাণবিক অস্ত্রের গুণগত উন্নতিও ঘটাচ্ছে।

চীনের কাছে আছে ৩৫০টি পারমাণবিক অস্ত্র। চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারতের আছে ১৬০টি পারমাণবিক অস্ত্র। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ইসরাইল ও উত্তর কোরিয়ার হাতে মজুত পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা যথাক্রমে ২৯০, ২২৫, ১৬৫, ৯০ ও ২০। এই তথ্য পরিবেশন করেছে স্টকহোমের ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে এ প্রতিষ্ঠানটিকে সিপ্রি বলা হয়।

এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর নানা দেশের অস্ত্রভান্ডারের ওপর বস্তুনিষ্ঠভাবে গবেষণা করে আসছে। শুধু শক্তিধর দেশগুলোই নয়, যেসব দেশ তুলনামূলকভাবে কম শক্তিধর, সেসব দেশেরও অস্ত্রভান্ডার সম্পর্কে তথ্য পরিবেশন করে চলেছে সিপ্রি।

যুদ্ধবিগ্রহমুক্ত অবস্থায় কোন দেশের অস্ত্রভান্ডার কেমন, সেসব তথ্য সামরিক কূটনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অন্যদেশের সঙ্গে মিত্রতা কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখে। যুদ্ধাবস্থায় বন্ধুত্বের সম্পর্কে থাকা একাধিক দেশের অস্ত্রভান্ডার যোগ হয়ে সামরিক শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। পাকিস্তান আণবিক অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলার জন্য চীনের সহায়তা পেয়েছে। বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু হলে চীন ও পাকিস্তানের অস্ত্রভান্ডার একে অপরের সক্ষমতা যোগ করে অধিকতর সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। বর্তমান বৈশ্বিক কূটনীতিতে যে লাইনআপ দেখা যায়, এর ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি, সংকট ভয়াবহ হলে রাশিয়া ও চীন এক কাতারে দাঁড়াবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ভারত ও ইসরাইল এক কাতারে দাঁড়াবে। সোজাভাবে বলা যায়, সমগ্র বিশ্ব দুটি পক্ষে কাতারবন্দি হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও এরকম হয়েছিল।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর বিশিষ্ট রাজনীতিবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা লিখেছিলেন বহুল আলোচিত গ্রন্থ The End of History. এই গ্রন্থে তিনি বলতে চেয়েছেন, বিশ্বসভ্যতা এমন একটি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, যখন আদর্শগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কোনো ভিত্তি থাকছে না। সমগ্র বিশ্ব উদারনৈতিক মুক্ত উদ্যোগের বিশ্বে পরিণত হবে। পুঁজিবাদ তার শক্তিমত্তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই গড়ে উঠবে আগামী দিনের সমাজব্যবস্থা। এ ধরনের একটি ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক পথে অগ্রসর করে নেওয়ার জন্যই বিশ্বায়নের সূচনা হয়েছিল। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ট্রিনিটি-বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং ডব্লিউটিও একযোগে বিশ্বায়নের ব্যাকরণটি তৈরি করল এবং তা বিশ্বে প্রায় সব দেশের ওপরই চাপিয়ে দিতে সক্ষম হলো। বিশ্বায়ন যখন বিজয়ীর বেশে এগিয়ে চলছিল, তখন আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধ বিশ্বায়নের ওপর ছায়াপাত করল। কার্ল মার্কস ঊনবিংশ শতাব্দীতেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, পুঁজিবাদ বিশ্বায়নের পথে অগ্রসর হবে কোনো একসময়ে। কিন্তু তিনি এ কথাও বলেছিলেন, যে পুঁজিবাদ বিশ্বায়নের জন্ম দিয়েছে, সেই পুঁজিবাদই বিশ্বায়নের গতিরোধ করতে বাধার বিন্ধ্যাচল সৃষ্টি করবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, এর ফলে বিশ্বায়নের অগ্রযাত্রা অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। আমরা এটাও লক্ষ করেছি, বিশ্বের কারখানা বলে পরিচিত চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছিল। এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বাণিজ্যের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে আমদানি করা পণ্যসামগ্রীর ওপর শুল্ক বাধা আরোপ করতে শুরু করলে চীনও মার্কিন পণ্যসামগ্রীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের বাণিজ্য বাধা আরোপ করতে শুরু করে। দেখা গেল এতে কোনো পক্ষই লাভবান হলো না। যা হলো তা হচ্ছে, বিশ্বায়নের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে অনাস্থার সৃষ্টি। মনে রাখা দরকার, একটি বিশ্বব্যবস্থা নিছক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়। এক দেশের সঙ্গে অন্যদেশের যে সম্পর্ক তৈরি হয়, এর পেছনে কাজ করে ভূরাজনীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ, এথনিসিটি, ধর্মীয় বিশ্বাস প্রভৃতি। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে যেসব ফ্যাক্টর কাজ করছে, সেগুলো অর্থনীতির তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ বিভিন্ন দেশকে প্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করেছিল। দেখা গেল সংক্রমণের কারণে এক দেশের সঙ্গে অন্যদেশের বিমান পরিবহণ প্রায় থেমে গেছে। অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন কোভিড-১৯ কি প্রকৃতিসৃষ্ট? না মানবসৃষ্ট? এই অতিমারি যখন শুরু হলো, তখন শোরগোল উঠেছিল, এই ভাইরাস চীনের উহান শহরে অবস্থিত বায়োলোজিক্যাল ল্যাব থেকে ছড়িয়েছে। এই শোরগোল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সন্দেহের তির নিক্ষিপ্ত হলো যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ট ডেট্রিক-এর জীবাণু যুদ্ধ আয়োজনের বিপজ্জনক গবেষণার ওপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে কোভিড-১৯-এর কারণে। মার্কিন জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ কোভিডের টিকা নিতে চায়নি। তারা সন্দেহ ব্যক্ত করে বলতে চেয়েছে কোভিড-১৯-এর টিকাগুলো মানুষের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। অপর একটি দল বলতে চাইল কোভিডের ভাইরাস বিশ্বের জনসংখ্যাকে একটি কাক্সিক্ষত মাত্রায় নামিয়ে আনার হাতিয়ার মাত্র। এসব অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে এটাকে একটি বিশ্বজীবাণু যুদ্ধরূপে দেখা যায়। এছাড়াও অভিযোগ আছে, কোভিড-১৯ অতিমারির অজুহাতে মানুষের কাছ থেকে তার ফ্রিডম কেড়ে নেওয়ারই একটি চেষ্টামাত্র। শোনা যাচ্ছে, কোভিড-১৯কেন্দ্রিক ভাইরাস গবেষণা মানুষের জিনভিত্তিক হয়ে গেছে। এই জিনভিত্তিক কোভিড-১৯-এর ভাইরাস সেসব মানুষের দেহে সংক্রমিত হবে, যাদের জিন জিনভিত্তিক কোভিড ভাইরাসের অনুরূপ। কোনো দেশ যদি করোনাভাইরাসের গবেষণা এতদূর এগিয়ে নিতে পারে, তাহলে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এই ভাইরাস ব্যবহার করে প্রাণসংহার করাও সম্ভব হতে পারে।

একটি গণতান্ত্রিক দেশের আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে স্বচ্ছতা। কোভিড-১৯ নিয়ে যেসব জল্পনা-কল্পনা চলছে, এর মূলে রয়েছে অস্বচ্ছতা। আমরা আন্দাজ করতে পারি পৃথিবীর প্রধান রাষ্ট্রগুলো জীবাণুযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আলোচনার শুরুতে আমরা উল্লেখ করেছিলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের কথা। প্রশ্ন হলো, পৃথিবী কি পারমাণবিক যুদ্ধের ফলে মহাশ্মশানে পরিণত হবে? রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছিল একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর আত্মরক্ষণের বা সেলফ প্রিজারভেশনের চেতনা থেকে। অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার মানে MAD। MAD-এই তিনটি অক্ষরের সম্প্রসারিত রূপ হলো Mutually Assured Destruction. অর্থাৎ পারমাণবিক যুদ্ধ হলে এর মধ্যকার সব শক্তিরই ধ্বংস নিশ্চিত হবে। আবার যেসব রাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, সেসব রাষ্ট্র অন্য পারমাণবিক সক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রের ওপর হামলা চালাবে না। কারণ, তারা ভালো করেই জানে পারমাণবিক যুদ্ধ মানে সব পক্ষের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া।

জীবাণুযুদ্ধের একটি সুবিধা হলো, এর ফলে অবকাঠামোর কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু জীবাণুযুদ্ধকে যদি নিশ্চিতভাবে লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে উন্নত করা যায়, তাহলে যুদ্ধের চালিকাশক্তি রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করা হলেও অন্যান্য সম্পদ ধ্বংস হবে না। এ কারণেই কি ভাইরাস নিয়ে এতসব গবেষণা হচ্ছে? দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান সভ্যতার যারা কান্ডারি, তারা মানবজাতির জন্য ধ্বংস এবং অমঙ্গল ডেকে আনছেন! বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো কবে অমঙ্গল এবং অশুভ থেকে বের হয়ে এসে সমৃদ্ধতর বিশ্বের সম্পদ মানবজাতির স্বার্থে ন্যায়ানুগ ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ভোগ করার পথে হাঁটবে?

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments