Friday, April 19, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলাম৫ পয়সা ভাড়া হ্রাস আর কেরোসিনের মূল্য দিয়ে সরকারকে চেনা

৫ পয়সা ভাড়া হ্রাস আর কেরোসিনের মূল্য দিয়ে সরকারকে চেনা

ডা. জাহেদ উর রহমান

দেশে সব সময় ডিজেলের দাম পেট্রোল/অকটেনের চাইতে বেশি থাকে। এর কারণ ডিজেলের ওপরে নির্ভর করা পরিবহন এবং কৃষি সেচযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা সাধারণ জনগণ। এর মধ্যেও অবশ্য ‘কিন্তু’ আছে। কম সংখ্যায় হলেও এই ডিজেলেই চলে অতি বিলাসবহুল ব্যক্তিগত এসইউভি (কথ্য ভাষায় আমরা বলি ‘জিপ’)। এছাড়া দেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে চলাচলকারী বিশ্ববিখ্যাত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অতি বিলাসবহুল বাসগুলোতেও ডিজেলই ব্যবহৃত হয়। এসব বাসে চলাচল করেন আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মানুষ। অর্থাৎ ডিজেলে ভর্তুকি দেয়া হলে সেটা কিছুসংখ্যক আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মানুষকেও সুবিধা দেয়, যেটা অনৈতিক। একমাত্র কেরোসিন তেলে যদি ভর্তুকি দেয়া হয়, তবে সেটা একজন সামর্থ্যবান মানুষকেও লাভবান করে না। অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষকে কিছুটা সুবিধা দেয়ার জন্য কেরোসিন এক অসাধারণ পণ্য। অথচ আমাদের আশপাশের প্রতিটি দেশ যখন তার সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনকে কিছুটা হলেও সহজ করার জন্য কেরোসিনের দাম অন্য জ্বালানি তেলের চাইতে বেশ খানিকটা কম রাখে তখন আমরা রাখি ডিজেলের সমান


জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে কিছুদিন আগে।

প্রতি লিটারে দাম কমেছে ৫ টাকা। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির পর কমানো হলো ৩ থেকে ৪ শতাংশ। অবিশ্বাস্যভাবে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক এই মূল্যহ্রাসকে ‘নজির সৃষ্টি করা’ বলেছেন। তিনি যে নজির বোঝাতে চেয়েছেন, আমরা সে নজির বুঝিনি, আমরা বুঝেছি এই কাণ্ড প্রহসনের এক নজির সৃষ্টি করেছে। প্রহসন শেষ হয়নি এখানে। যেহেতু সচেতন নাগরিকরা সব সময় এই সমালোচনা করেন যে জ্বালানির দাম কমলেও পরিবহন ভাড়া তো কমে না, তাই আমাদের মিথ্যা প্রমাণ করতে যাত্রা মাঠে নেমে গেলেন পরিবহন মালিকরাও। সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে বিরাট মিটিং করে তারা জাতিকে দিলেন ‘সুসংবাদ’ ু প্রতি কিলোমিটারে ৫ পয়সা কমানো হচ্ছে ভাড়া।  এদেশে কতগুলো সিন্ডিকেটের কাছে মানুষের এখন আর ন্যূনতম মূল্য নেই। যদি সেটা থাকতো তাহলে এমন কোনো ঘোষণা তারা দেবার আগে একটু হলেও ভাবতেন। ঢাকা শহরে ১০ কিলোমিটার বিরাট দূরত্ব। তাদের সিদ্ধান্ত মতে এই দূরত্ব গেলে বাসে ভাড়া কমবে ৫০ পয়সা। আর ৫ কিলোমিটারের ক্ষেত্রে এটা ২৫ পয়সা।  ৫০ পয়সা কিংবা ২৫ পয়সায় কী কিনতে পারে, যাচ্ছি না সেই আলোচনায়, কারণ ২০১৫ সালেই একবার অর্থমন্ত্রী এক এবং দুই টাকার ক্রয় ক্ষমতা নেই বলে এই মুদ্রাগুলো উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আজকের বাজারে তাহলে পরিস্থিতি কি? এর চাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে ২৫/৫০ পয়সার মুদ্রাগুলো কি সংগ্রাহক ছাড়া আর কারও কাছে আছে? এক টাকার কয়েনই এখন এক দুর্লভ বস্তু। সত্যি বলতে জ্বালানি তেলের মূল্য এবং পরিবহন ভাড়া হ্রাসের বিষয়টি সিরিয়াস আলোচনা, বিশ্লেষণেরই যোগ্য না। এই পদক্ষেপগুলো যেটার যোগ্য, ফেসবুক হচ্ছে সেটাই-ট্রোল।  

আসলে তেলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমালেও বাস,  ট্রাকসহ পরিবহন ভাড়া কমতো না সেই অনুপাতে। অর্থাৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জেরে প্রতিটি পণ্যের মূল্য যতটা বেড়েছে জ্বালানির মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও পণ্যমূল্য কমতো তার তুলনায় অতি সামান্য। বাংলাদেশের এমন সমস্যার কথা জানে সবাই। জ্বালানি তেলের সামান্য মূল্য হ্রাস করার সরাসরি উপকারভোগীদের মধ্যে কম সামর্থ্যের মানুষদের মাত্র কয়েকটি শ্রেণি আছে। অনেক সামর্থ্যবান মানুষ তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরবাইকে পেট্রোল, অকটেন ব্যবহার করে। তবে এখন অনেক মানুষ অনেক কষ্টে ঋণ করে কিংবা অন্য কোনো সম্পদ বিক্রি করে মোটরবাইক কিনে রাইড শেয়ারিং করে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করেন। অতি সামান্য মূল্য কমলেও এই শ্রেণিটি সামান্য সুফল পাবে।  ডিজেলচালিত বাস সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে। ডিজেলচালিত ট্রাকে সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য পণ্যও পরিবহন করা হয়। কিন্তু এই মূল্য হ্রাসের সুফল কোনোভাবেই মানুষের কাছে যাবে না। তবে ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেয়া কিছু কৃষক এর সুবিধা পেতে পারেন। তবে প্রান্তিক কৃষকও এই সুফল পাবেন না কারণ তাদের সেচ যন্ত্র নেই; তারা যন্ত্র মালিকের কাছ থেকে সেচের পানি কেনেন। কেরোসিন একেবারে প্রান্তিক মানুষ ব্যবহার করে তাই তার সুফল তাদের কাছে যাবে। বলাবাহুল্য প্রতি লিটারে এই ৫ টাকা হ্রাসের সুফল, যা মূলত থেকে যাবে সামর্থ্যবান মানুষের অধিকারেই।  

জ্বালানি বিষয়ক আলোচনায় প্রায়ই আমাদের জানানো হয় বাংলাদেশের জ্বালানির মূল্য দক্ষিণ এশিয়াতে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম ছিল, তাই বাংলাদেশ থেকে নাকি জ্বালানি ভারতে পাচার হয়ে যায়। খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই আমরা বুঝি জ্বালানির মতো তরল পণ্য পাচার করার জন্য মোটেও সুবিধাজনক নয়। এমনকি সরকারের একাধিক মন্ত্রীর এই দাবির পর বিজিবির পক্ষ থেকে খুব স্পষ্ট এবং শক্তভাবে বলা হয়েছিল সীমান্ত দিয়ে কোনোভাবেই জ্বালানি ভারতে পাচার হয় না। এই পাচারের প্রসঙ্গে বিজিবি’র পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, “সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচারের চেষ্টা খুবই অপ্রতুল। এই পাচারের চেষ্টাগুলো সাধারণত ১০-১২ লিটার হয়। এ কারণে আমি মনে করি না যে সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচার হচ্ছে। ডিজেল ব্যাগে করে পাচার করা যায় না। যদি ব্যারেল ব্যারেল জ্বালানি তেল সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়, তবেই অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। সীমান্তে তো আর বাতাস দিয়ে ব্যারেল ব্যারেল জ্বালানি তেল পাচার হতে পারবে না।”  এটা ঠিক, এই দফার জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করার আগে বাংলাদেশের জ্বালানির মূল্য আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় কম ছিল। তারপরও আমাদের দেশে জ্বালানির মূল্য এত বেশি বাড়ানো কেন বড় ভুল, কীভাবে সেই মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় ভয়ঙ্কর সংকট তৈরি হয়, সেসব নিয়ে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে, তাই সেই আলোচনা থাকুক। আমি বরং দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই আরেকটা বিষয়ে। সরকার যখন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য আমাদের দেখানোর চেষ্টা করছে সেটা চেক করতে গিয়ে আমি এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফাইন্ডিং পেয়েছি। 

আমাদের আশপাশের সব দেশে ডিজেল পেট্রোল এর তুলনায় কেরোসিনের দাম অনেকটা কম। দেখা যাক আমাদের প্রতিবেশী ৩টি দেশে তাদের স্থানীয় মুদ্রায় জ্বালানি তেলের দাম কতো। ভারতে পেট্রোলের দাম রাজ্যভেদে ৯৭ থেকে ১১১ রুপি, ডিজেলের দাম রাজ্যভেদে ৮৪ থেকে ৯৭ রুপি আর কেরোসিনের দাম ৬২ রুপি। শ্রীলঙ্কায় পেট্রোলের দাম ৫৪০ রুপি ডিজেলের দাম ৪৩০ রুপি কেরোসিনের দাম ৩৪০ রুপি। আর পাকিস্তানে পেট্রোল ২৩০ রুপি, ডিজেল ২৩৬ রুপি এবং কেরোসিন ১৯৬ রুপি।  বাংলাদেশে দাম বাড়ানোর আগেও কেরোসিনের দাম ছিল ডিজেলের সমান। বাড়ানোও হয়েছে ডিজেলের সমান। ৫ টাকা কমানোর পরও ডিজেলের সমান। দেশে কেরোসিন তেল ব্যবহৃত হয় দু’টি সেক্টরে। একেবারে প্রান্তিক মানুষ তাদের আলো জ্বালাতে এবং অনেক সময় রান্নায় এই তেল ব্যবহার করে। আরেকটি ব্যবহার হচ্ছে উড়োজাহাজের জ্বালানি। যদিও উড়োজাহাজে জেট ফয়েল নামে যে কেরোসিন ব্যবহৃত হয়, সেটা আমাদের গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত কেরোসিন নয়, সেটার পরিশোধিত রূপ। অর্থাৎ উড়োজাহাজে ব্যবহার বাদ দিলে কেরোসিন ব্যবহার করে এই দেশের সবচেয়ে দরিদ্র প্রান্তিক মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে একবার বলা হয়েছিল বাংলাদেশে কেরোসিনের মূল্য কম থাকার কারণে বিদেশি এয়ারলাইনের বিমানগুলো বাংলাদেশ থেকেই জ্বালানি নিতে চায় এতে আমাদের ক্ষতি বাড়ে। এটা কোনোভাবেই যুক্তি হতে পারে না। কারণ আগেই বলেছি উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল কেরোসিন থেকে তৈরি হলেও সেটা আমাদের কুপি জ্বালানোর কেরোসিন নয়। 

বিমানের জ্বালানি নিয়ে যদি সমস্যা থেকে থাকে তাহলে জেট ফুয়েল এর দাম বাড়ালেই তো চলতো, কেরোসিনের দাম কেন বাড়ানো হবে এতটা? বর্তমানে দেশে জ্বালানি সংকটের কারণে ঘোষণা দিয়ে বিদ্যুৎ রেশনিং শুরু করা হয়েছে। ঢাকা শহরে এলাকা ভেদে ২-৩ ঘণ্টা লোডশেডিং হলেও জেলা শহরে এটা ৫-৬ ঘণ্টা আর গ্রামাঞ্চলে এটা ১০-১২ ঘণ্টায়ও থেকেছে। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনে কেরোসিনের পয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে আগের চাইতে অনেক বেশি। দেশে সব সময় ডিজেলের দাম পেট্রোল/অকটেনের চাইতে বেশি থাকে। এর কারণ ডিজেলের ওপরে নির্ভর করা পরিবহন এবং কৃষি সেচযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা সাধারণ জনগণ। এর মধ্যেও অবশ্য ‘কিন্তু’ আছে। কম সংখ্যায় হলেও এই ডিজেলেই চলে অতি বিলাসবহুল ব্যক্তিগত এসইউভি (কথ্য ভাষায় আমরা বলি ‘জিপ’)। এ ছাড়া দেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে চলাচলকারী বিশ্ববিখ্যাত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অতি বিলাসবহুল বাসগুলোতেও ডিজেলই ব্যবহৃত হয়। এসব বাসে চলাচল করেন আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মানুষ। অর্থাৎ ডিজেলে ভর্তুকি দেয়া হলে সেটা কিছুসংখ্যক আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মানুষকেও সুবিধা দেয়, যেটা অনৈতিক।  

একমাত্র কেরোসিন তেলে যদি ভর্তুকি দেয়া হয়, তবে সেটা একজন সামর্থ্যবান মানুষকেও লাভবান করে না। অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষকে কিছুটা সুবিধা দেয়ার জন্য কেরোসিন এক অসাধারণ পণ্য। অথচ আমাদের আশপাশের প্রতিটি দেশ যখন তার সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনকে কিছুটা হলেও সহজ করার জন্য কেরোসিনের দাম অন্য জ্বালানি তেলের চাইতে বেশ খানিকটা কম রাখে তখন আমরা রাখি ডিজেলের সমান।  ওদিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, তারপর সেটা অতি সামান্য কমানো এবং তার ভিত্তিতে পরিবহন ভাড়া কমা নিয়ে যা করা হলো, তার সঙ্গে যদি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের কেরোসিনের মূল্য বিবেচনা করি, তাহলে কি প্রমাণিত হয় না, সরকারের পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষ কখনো ছিলনা, নেই এখনো?

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments