Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামহিরো আলমের ‘প্রশ্ন’ ও ‘হিম্মত’

হিরো আলমের ‘প্রশ্ন’ ও ‘হিম্মত’

শুভ কিবরিয়া

উল্লেখযোগ্য প্রশ্নটা ছুড়েছেন তিনি আমলাতন্ত্রের প্রতি। আমজনতাকে অবজ্ঞার মনোভঙ্গি স্বাধীন দেশেও ছাড়তে পারেনি আমাদের আমলাতন্ত্র। রাজা ও প্রজার দেশ তৈরি করে তারা যে বিভেদ-বিভাজনের মানসিকতা লালন করেন, সেই ব্যুরোক্রেটিক স্কুলিংয়ের প্রতি একটা গুরুতর প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। বলেছেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যারা আমাকে মেনে নিতে চান না। তারা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে, তাদের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে স্যার বলে ডাকতে হবে। এ জন্য তারা আমাকে মানতে চান না। তারা আমার বিজয় মেনে নিতে পারেননি

ভোটের জগতে যখন মানুষের আর ভরসা নাই, উৎসাহ নাই, ভোট কেমন হতে পারে-সে সম্পর্কে যখন মানুষের পূর্বধারণা পাল্টানোর আর কোনো ব্যবস্থাই দৃশ্যমান নয়, তখন বগুড়া-৪ উপনির্বাচনে খ্যাতিমান ‘হিরো আলম’ নতুন নতুন সব প্রশ্ন তুলে ঝড় বইয়ে দিলেন আমাদের ভাবনার জগতে। অনেকের মুখোশ খুলে দিয়ে তাদের ভেতরের নোংরা চেহারাটা উন্মোচন করে দিলেন তিনি। মুখোশের আড়ালে আমাদের সমাজপতিদের নোংরা-ক্ষুদ্রতা আরেকবার দেখার সুযোগ মিললো সবার।
হিরো আলম কে, কীভাবে তার উত্থান, তার সামাজিক অবস্থান কি, সেটা জানা বিষয়।

কিন্তু অজানা যেটা ছিল সেটা হচ্ছে, নির্বাচনী মাঠে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক না নিয়েও, বিগ-শটদের প্রতিপক্ষ হয়ে সাহসের সঙ্গে লড়ে, হিরো আলম কেমনতর জনভোটের মানুষ হয়ে উঠলেন। প্রথমে তাকে ঠেকানোর চেষ্টা হয়েছে নির্বাহী বিভাগের বাধায়। সেটা তিনি উৎরে গেছেন বিচার বিভাগের নির্দেশে। তার মনোনয়ন বাতিল হয়েছে মাঠপ্রান্তে কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে রায় পেয়ে তিনি নির্বাচনে লড়েছেন। সেই নির্বাচনে সামান্য ভোটে হেরেছেন। তার দাবি সুষ্ঠু ভোটের পর ফলাফল ঘোষণার কারসাজিতে তাকে হারানো হয়েছে। এই ফলাফল বাতিল করতে তিনি আদালতে যাবার ঘোষণাও দিয়েছেন।
ভোট কারচুপি, ভোটের ফলাফল ঘোষণায় জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্রে মাস্তানি, ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের বিপুল অনুপস্থিতি এসব নতুন ঘটনা নয়। এবারের সবগুলো উপনির্বাচন বিবেচনায় নিলে ইতিহাসের সেই ধারবাহিকতায় কোনো ব্যত্যয় নাই। ব্যত্যয় শুধু একজন প্রার্থী হিসেবে হিরো আলমের কণ্ঠ ও কাজের ভেতর দিয়ে যে নতুন সামাজিক লড়াই উঠে এসেছে সেটাই।


হিরো আলম প্রান্তিক মানুষ। তার চেহারা ভালো নয়। তার কাজ অনেকেরই অপছন্দ। অভিজাততন্ত্র তাকে নিজেদের কাতারে দেখতে অপারগ। কিন্তু হিরো আলম স্বশিক্ষিত। স্বচেষ্টায় আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। নিজ কর্মগুণে এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয়। দেশে ও দেশের বাইরে বিপুলভাবে খ্যাতিমান, সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। তাই হিরো আলমের সংসদ সদস্য হতে চাওয়াটা অনেকেই মানতে পারেন না। চান না। মজার বিষয় সেটা তারা গোপনও রাখেন না।
এই অবস্থা মোকাবিলায় হিরো আলম অকপট এবং অকুতোভয় সাহসী মানুষ। তাই তিনি বলতে পারেন অবলীলায়, ‘আমার এমপি হওয়া নিয়ে, সংসদে যাওয়া নিয়ে অনেকের ঘুম হারাম, মাথা কামড়ায়। একজন এমপি’র কাজ কী? সংসদে কথা বলা। আমি কি কথা বলতে পারি না? আমার চেহারা নিয়ে এত আপত্তি কেন? এত নাটক কেন? সেখানে কেন ভালো চেহারার লোক লাগবে? আমাকে সংসদে নিয়ে গিয়ে কি অভিনয় করাবেন? আমি আপনাদের মতো ভালো কথা বলতে পারি না। বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি, এ জন্য আপনাদের বাঁধে। আপনাদের মা-বাবা আছে  সেজন্য পড়ালেখা করতে পেরেছেন, শিক্ষিত হয়েছেন। স্পিকার হয়েছেন, মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন, কমিশনার, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। আমাদের মতো নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা হলে এটা হতে পারতেন না। শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কথা বলেন। অনেক এমপি তো স্বশিক্ষিত। সংসদে ঠিকমতো “স্পিকার” উচ্চারণ করতে পারেন না। আপনাদের এত যোগ্যতা থাকলে দেশের এই অবস্থা কেন? কেন জনগণ আপনাদের ধিক্কার দিচ্ছে।’
নিজের বেদনার কথা বলেছেন। অপ্রাপ্তির কথাও বলেছেন হিরো আলম। কিন্তু যে প্রশ্নটি তুলেছেন, অভিজাততন্ত্রকে লক্ষ্য করে, সেটা খুবই মৌলিক? ওই যে হিরো আলম বলেছেন, ‘আপনাদের এত যোগ্যতা থাকলে দেশের এই অবস্থা কেন?’  উপরে বসে থাকা আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবীরা সবাই তো যোগ্য, তাহলে দেশের এই অবস্থা কেন? কেন টাকা পাচার হয়? কেন বেগম পাড়া গড়ে ওঠে কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়? কেন রিজার্ভ চুরি হয়? কেন শেয়ার বাজারে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে? কেন দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য এত দ্রুত বেড়ে উঠে? 

হিরো আলমের এই হিম্মত সম্ভবত প্রশ্ন করতে ভুলে যাওয়া জনমনে নতুন দোলা দিয়েছে। তাই সোশাল মিডিয়া, মেইন স্ট্রিম মিডিয়া তার পাশে দাঁড়াচ্ছে। তার সকল কথাকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করছে। এমনকি হিরো আলম বড় দুই রাজনৈতিক দলের বড় দুই নেতার বাহাসের বিষয়েও পরিণত হয়েছেন। 
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হিরো আলমের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘এই আওয়ামী লীগ হিরো আলমের কাছেও কতোটা অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে জিততে হয়।’ এই বক্তব্যে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে ইঙ্গিত যেমন আছে তেমন হিরো আলমকে ‘যেমন তেমন’ ভাবার অভিজাততন্ত্রীয় ইঙ্গিতও আছে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অবশ্য বেশি রাখঢাক করেন নাই। মনের কথা সজোরেই বলেছেন, ‘হিরো আলম এখন জিরো হয়ে গেছে। হিরো আলমকে বিএনপি নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছে। তারা সংসদকে ছোট করার জন্য হিরো আলমকে প্রার্থী করেছে। অবশেষে ফখরুলের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।’
এই দুই রাজনৈতিক পক্ষের মনোভঙ্গির জবাব অবশ্য দিয়েছেন হিরো আলম, ‘আপনি (ওবায়দুল কাদের) বলেছেন, হিরো আলম নাকি জিরো হয়েছে। এটা ভুল বলেছেন। হিরোকে কেউ কখনো জিরো করতে পারে না। হিরো হিরোই থাকে। আমাকে জিরো কেউ বানাতে পারেনি, পারবেও না। এটা আপনি ভুল বলেছেন। হিরোকে যারা জিরো বানাতে এসেছে, তারাই জিরো হয়েছে।’
বিএনপি নেতার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হিরো আলমের বক্তব্য, ‘মির্জা আলমগীর বলেছেন, এই সরকার এখন অসহায় হয়ে গেছে। এই সরকার অসহায় হয়েছে কি না, আমি জানি না। তবে আমি হিরো আলম যে অসহায় হয়েছি, এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? আমার ভোটের ফলাফল যে কেড়ে নেয়া হলো, এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? আমি কার কাছে বিচার দেবো। আমি যাদের কাছে বিচার দিতেছি, তারা কেউ বিচার করছে না।’

শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নন, বহুপক্ষ থেকেই আক্রমণ আসছে হিরো আলমের প্রতি। একজন নির্বাচন কমিশনার রাশিদা সুলতানা তাকে ইঙ্গিত করে কথা বলেছেন। তার জবাবটা অবশ্য খুব সুন্দর দিয়েছেন হিরো আলম। বলেছেন, ‘আপনি মাঠে এসে অভিযোগের তদন্ত না করে ঢাকা থেকেই হুট করে মন্তব্য করলেন। আপনি নন্দীগ্রামে এসে দেখেছিলেন, আমার এজেন্ট ছিল না? এজেন্ট ছিল, কিন্তু ফলাফলের কাগজ দেয়া হয়নি। ভোট নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না, এখনো নেই। ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটে হেরে যাইনি। ফল চুরি করেছেন। এ কারণে ফলাফলে হেরেছি।’
রাশিদা সুলতানার উদ্দেশ্যে হিরো আলম আরও বলেছেন, ‘ক্ষমতায় আছেন তো অনেক বড় বড় কথা বলেন। আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম, ফল বাতিল করে গণভোট দেন। একতারা প্রতীকে হিরো আলম, মশাল প্রতীকে তানসেন (একেএম রেজাউল করিম) প্রার্থী থাকবেন। প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটিভি দেন। আপনারা সব নির্বাচন কমিশনার মাঠে আসেন। মশাল নাকি একতারাকে বেশি জনপ্রিয় প্রমাণ করতে গণভোট দেন। যদি একতারা হেরে যায়, আমি নাকে খত দেবো, জীবনে কখনো নির্বাচনে যাবো না।’
বৃহৎ-ক্ষমতাধর নির্বাচন কমিশন কি এই ‘ক্ষুদ্র’ হিরো আলমের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন?

ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে ফেসবুক লাইভে এসে হিরো আলম বক্তব্য দিয়েছেন, ‘ওবায়দুল কাদের স্যার বলেছেন,  হিরো আলম পার্লামেন্টে গেলে নাকি পার্লামেন্ট ছোট হবে। আমি যদি পার্লামেন্টে গেলে পার্লামেন্ট ছোট করা হয় তবে যখন মনোনয়ন কিনছি, তখন কিন্তু আপনাদের বলা উচিত ছিল, হিরো আলমের কাছে যেন মনোনয়ন বিক্রি করা না হয়। আপনারাই বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশ, সবাই নির্বাচন করতে পারবে। সবার যদি নির্বাচন করার কথা আইনে থাকে, তাহলে আমি ভোটে দাঁড়ালে সংসদ ছোট হবে কেন? তাহলে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে আইন করতে হবে?’
খুব মৌলিক একটা প্রশ্ন তুলেছেন হিরো আলম। আইনে যা আছে তার পরিবর্তন না করা অবধি চলমান আইনকেই তো সম্মান দেয়া, মান্য করা একজন নাগরিকের কাজ। একজন মানুষের চেহারা, শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যে নীতিগত, আইনি কাঠামো বিদ্যমান সেটা লঙ্ঘন করাও যে মানবাধিকার লঙ্ঘন সেই বোধটা অনেকেই হয়তো ভুলে যাচ্ছেন হিরো আলমকে তুচ্ছ করতে যেয়ে।
হিরো আলম সেই প্রশ্নটাও তুলেছেন সজোরে। বলেছেন, ‘অনেকেই আমার যোগ্যতা নিয়ে কথা বলেছেন। পুলিশের সাবেক আইজিপি বলেছেন, আমাকে নিয়ে বলতে তার নাকি রুচিতে বাঁধে। হিরো আলম সংসদে গেলে নাকি সংসদ অবমাননা করা হবে। সংসদে কাজ কী বলুন তো? সংসদে আমরা যাবো। জনগণের সুখ-দুঃখের কথা বলবো। জনগণের ন্যায্য দাবি তুলে ধরবো। আপনারা আমাদের বাজেট দেবেন, সেই অনুযায়ী কাজ করবো। সংসদে বিল পাস করে দেবেন, আমরা জনগণের জন্য কাজ করবো। আমার যোগ্যতা দিয়ে কী করবেন, চেহারা দিয়ে কী করবেন? এসব তো দরকার নেই। জনগণ যদি এসব ভাবতো, তবে এত ভোট আমাকে কেন দিলো? আমার এত গণজোয়ার কেন উঠলো?’

উল্লেখযোগ্য প্রশ্নটা ছুড়েছেন তিনি আমলাতন্ত্রের প্রতি। আমজনতাকে অবজ্ঞার মনোভঙ্গি স্বাধীন দেশেও ছাড়তে পারেনি আমাদের আমলাতন্ত্র। রাজা ও প্রজার দেশ তৈরি করে তারা যে বিভেদ-বিভাজনের মানসিকতা লালন করেন, সেই ব্যুরোক্রেটিক স্কুলিংয়ের প্রতি একটা গুরুতর প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। বলেছেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যারা আমাকে মেনে নিতে চান না। তারা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে, তাদের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে স্যার বলে ডাকতে হবে। এ জন্য তারা আমাকে মানতে চান না। তারা আমার বিজয় মেনে নিতে পারেননি। নির্বাচন নিয়ে এ রকম প্রহসন হলে, কারচুপি হলে মানুষ নির্বাচন ভুলে যাবে।’
হিরো আলমের দাবি তাকে ভোটে হারানো হয়েছে। নইলে তিনি জনতার রায়ে সংসদ সদস্য হতেন। এখন তিনি সংসদ সদস্য হতে পারলেন না বটে কিন্তু জনতার মনে আলোড়ন তুলেছেন। তার হিম্মত ও প্রশ্ন তোলার এই সাহস-প্রমাণ করেছে আমাদের অভিজাততন্ত্র, আমলাতন্ত্র তাকে যতই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করুক না কেন, তিনি থেমে যাবার মানুষ নন। এই অন্ধকার, বিবেক রহিত প্রায় মৃত সময়েও একজন উজ্জ্বল লড়াকু মানুষ, হিরো আলম।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, kibria34@gmail.com

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments