ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)- এর কন্যা আম্মাজান আয়েশা (রা.) ছিলেন প্রিয় নবীর সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী ও অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারিণী। তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। বিশেষ করে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও আরবদের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল।
ইসলামের বিভিন্ন মাসআলার নীতিগত বিষয়ে তাঁর পরামর্শ নেওয়া হতো। তুলনামূলক কম বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। অনেক সাহাবি ও তাবেঈ তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার ২১০টি। তন্মধ্যে প্রায় ১১৪টি হাদিস ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম যৌথভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারি ৫৪টি হাদিস এবং ইমাম মুসলিম ৬৯টি হাদিস এককভাবে তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর কিতাব ও সুন্নতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। হাদিস বর্ণনাকারী অনেক বড় বড় মর্যাদাবান সাহাবি তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং হাদিসের কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা বা বুঝে না এলে সবাই তাঁর থেকে সমাধান নিতেন।
সাহাবি আবু মুসা আল আশআরি (রা.) বলেন, আমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের কাছে কোনো হাদিসের অর্থ বোঝা কষ্টসাধ্য হলে আয়েশা (রা.)-কে প্রশ্ন করে তাঁর কাছে এর সঠিক জ্ঞান লাভ করেছি। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৮৩)
আয়েশা (রা.) কর্তৃক নানা প্রশ্নের মাধ্যমে রাসুল (সা.) থেকে যেসব মাসআলার সমাধান জেনেছেন এবং বিভিন্ন ঘটনা, প্রেক্ষাপট ও সামাজিক ইত্যাদি বিষয়ের ওপর তাঁর থেকে বর্ণিত কয়েকটি হাদিস এখানে তুলে ধরা হলো—
কিয়ামতের দিন হিসাবের ভয়াবহতা নিয়ে প্রশ্ন
ইবনে আবি মুলাইকা (রহ.) বলেন, উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-এর বৈশিষ্ট্য ছিল, কোনো কথায় তাঁর প্রশ্ন হলে জিজ্ঞাসা করতেন এবং ভালোভাবে বুঝে নিতেন। একবার বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেওয়া হবে তার শাস্তি অবধারিত। ’ তখন আয়েশা (রা.) জিজ্ঞেস করেন, ‘আল্লাহ তাআলা কি বলেননি, ‘অচিরেই তার সহজ হিসাব নেওয়া হবে। ’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এই হিসাব তো শুধু জানিয়ে দেওয়া। কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই যার কাছে হিসাব চাওয়া হবে সে নিশ্চিত ধ্বংস হবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ১০৩)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তাআলা যে বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন তার হিসাব হবে অতি সহজ, প্রকৃতপক্ষে তা হিসাব নয়, শুধু জানিয়ে দেওয়া যে, বান্দা! এই এই কাজ তুমি করেছিলে। একেই কোরআন মজিদে ‘হিসাব’ বলা হয়েছে। আর এ জন্যই উম্মুল মুমিনিনের প্রশ্ন হয়েছে এবং তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন। তখন নবী (সা.) মূল বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন। এ থেকে যেমন আয়াতের অর্থ বোঝা গেল তেমনি হিসাব-কিতাবের ভয়াবহতাও জানা গেল।
জালিমের অভিশাপে নবীজির কৌশলী জবাব
আয়েশা (রা.) বলেন, একবার কিছু ইহুদি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলো এবং সালাম দেওয়ার ছলে বলল, ‘আসসামু আলাইকা’ (অর্থাৎ আপনার ওপর মৃত্যু নেমে আসুক)। আয়েশা (রা.) তা বুঝতে পেরে জবাবে বলেন, ‘আলাইকুমুস সামু ওয়াল লা’নাতু’ (বরং মরণ ও অভিশাপ তোমাদের ওপর পড়ুক)। তাঁর এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বলেন, হে আয়েশা! সংযত হও। আল্লাহ তাআলা সব বিষয়ে কোমলতা পছন্দ করেন। ’ উম্মুল মুমিনিন আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি শোনেননি তারা কী বলল?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমিও তো এর জবাব দিয়েছি। বলেছি, ‘ওয়া আলাইকুম’ (তোমাদের ওপরও তা পড়ুক)। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬০২৪)
খারাপ ও দুষ্টু লোকদের সঙ্গে সৌজন্য রক্ষা করা
আয়েশা (রা.) বলেন, একদা এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসার অনুমতি চাইল। লোকটিকে (দূর থেকে) দেখে তিনি বলেন, ‘গোত্রের সবচেয়ে খারাপ লোক!’ কিন্তু সে যখন ঘরে এলো তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। তার বিদায়ের পর উম্মুল মুমিনিন প্রশ্ন করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি তো প্রথমে তার সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেছিলেন, অথচ সাক্ষাতে হাসিমুখে কথা বললেন!’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আয়েশা! তুমি কি কখনো (কারো সঙ্গে) আমাকে মন্দ ও অশালীন আচরণ করতে দেখেছ? কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তি হবে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যাকে মানুষ ত্যাগ করেছে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৩২)
স্ত্রীর অভিনব অভিমানে স্বামীর ধৈর্য ধারণ
আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, ‘আমি তোমার রাগ ও অনুরাগ বুঝতে পারি। ’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আল্লাহর রাসুল! কিভাবে বুঝতে পারেন?’ তিনি বলেন, ‘তুমি যখন আমার ওপর সন্তুষ্ট থাকো, তখন বলে থাকো—‘বালা ওয়া রাব্বি মুহাম্মাদ’ (মুহাম্মদের রবের কসম!…) আর অসন্তুষ্ট হলে বলে থাকো—‘লা ওয়া রাব্বি ইবরাহিম’ (ইবরাহিমের রবের কসম!…। )’ আমি বললাম, ‘আল্লাহর রাসুল! আপনি ঠিক বলেছেন। তবে আমি শুধু আপনার নামটিই ত্যাগ করি। (অন্তর আপনার ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে। ’) (বুখারি, হাদিস : ৫২২৮)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, স্ত্রীর স্বাভাবিক মান-অভিমানকে সহজভাবে গ্রহণ করা উচিত।
নবীজির চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখে প্রশ্ন
আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, আকাশে মেঘ দেখা দিলে বা ঝোড়ো বাতাস বইতে থাকলে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মুখমণ্ডলে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠত। আমি আরজ করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আকাশে মেঘ দেখলে মানুষ খুশি হয় এবং বৃষ্টির আশা করে, কিন্তু আপনার চেহারায় আমি চিন্তা ও ভয়ের ছাপ লক্ষ করি। ’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আয়েশা! আমি কিভাবে জানব, এই মেঘ বা বাতাস কোনো আজাব বহন করে আনেনি? এক জাতির ওপর তো প্রচণ্ড বাতাস দ্বারা আজাব দেওয়া হয়েছে। তেমনি আরেক জাতি আজাব দেখে বলেছিল—এই তো মেঘ আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবে!’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৯৮)
কিয়ামতের দিন মানুষের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষকে ওঠানো হবে নগ্নপদ, বস্ত্রহীন ও খতনাবিহীন অবস্থায়। ’ এ কথা শুনে আয়েশা (রা.) প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! নারী-পুরুষ বিবস্ত্র অবস্থায় সমবেত হলে একজন কি অন্যজনের সতর দেখবে না?’ আল্লাহর রাসুল বলেন, ‘সে দিনের অবস্থা এত কঠিন হবে যে এই চিন্তারই সুযোগ থাকবে না। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬৫২৭)