দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংঘটিত ইহুদি গণহত্যা ‘হলোকস্ট’ নামে পরিচিত। এই হলোকস্টে লক্ষাধিক ভুক্তভোগীর হারানো ছবি খুঁজে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সাদিয়া আফরিন হীরা
‘বিছানায় ঠকঠক শব্দ শুনতে পাচ্ছি। নািসরা যখন আমাকে খুঁজছিল বিছানার নিচে লুকিয়ে থেকে নিজেকে বলছিলাম, এখন যদি শ্বাসও আমি নিই, আজই হয়তো আমার পৃথিবীর বুকে শেষ দিন’, বললেন ব্লাঞ্চ ফিক্সার। প্রায় ধরা পড়তে পড়তে তিনি নািসদের হাত থেকে বেঁচে যান।
ব্লাঞ্চ সৌভাগ্যবান ছিলেন বলেই বেঁচে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলোকস্টে নািস বাহিনীর হাতে ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হয়েছিল।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
গুগলের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ড্যানিয়েল প্যাট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমনই এক টুল তৈরি করেছেন, যা দিয়ে এই সব মানুষের পরিচয় বের করা সম্ভব। এই টুল দিয়ে হাজারো ঐতিহাসিক ছবি থেকে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির পরিচয় বের করা সম্ভব। এর সাহায্যে ব্লাঞ্চের এমন একটি ছবি ফিরিয়ে আনা হয়, যা তিনি নিজেই কোনো দিন দেখেননি। প্যাটের ওয়েবসাইটিতে একজন ব্যক্তির মুখমণ্ডল বিশ্লেষণ করতে ফেশিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ছবিগুলোর সম্ভাব্য মিল খুঁজে পেতে প্রযুক্তিটি পুরনো ছবির আর্কাইভ অনুসন্ধান করে। এমন হাজারো ভুক্তভোগীর ছবি আছে, সেসব মানুষকে শনাক্ত করতে প্যাটের তৈরি করা প্রযুক্তিটি হতে পারে মূল চাবিকাঠি।
সফটওয়্যারটি এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক মুখমণ্ডলকে ক্রস-রেফারেন্স করেছে। বিশেষ করে এমন লোকদের মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যারা এরই মধ্যে কোনো একটি ছবিতে চিহ্নিত হয়েছে, কিন্তু আর কোনো ছবিতে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ছবি ও হারানো স্মৃতি
ব্লাঞ্চকে ছোটবেলায় ডাকা হতো ‘ব্রোনিয়া’ নামে। যখন নািসরা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তখন ব্লাঞ্চ সপরিবারে পোল্যান্ডে বসবাস করতেন। সেই গণহত্যায় নিজের মা এবং ভাই-বোনদের হারিয়েছেন তিনি। কিন্তু ব্লাঞ্চের আন্টি রোজ তাঁকে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখায় অল্পের জন্য তাঁর জীবন রক্ষা পায়। ব্লাঞ্চের বয়স এখন ৮৬ বছর এবং বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে। ওই সময়কার নিজেদের একটি পারিবারিক ছবিটি সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন। তবে সম্প্রতি এমন একটি গ্রুপ ছবি দেখেছেন যা আর আগে কখনো দেখেননি, এটি যুদ্ধের সময় ফ্রান্সে তোলা হয়েছিল। শুধু ড্যানিয়েলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যারটির বদৌলতে এই তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে।
মিলছে নতুন তথ্য
ব্লাঞ্চের সঙ্গে দেখা করতে নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমান ড্যানিয়েল। ছবিগুলো দেখে ব্লাঞ্চের শৈশবের হারানো স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে। ছবিটিতে বড় একটি দলের সামনে নিজেকে দাঁড়ানো দেখে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারেন ব্লাঞ্চ, শুধু তাই নয়, তাঁর আন্টি রোজ এবং ছবির একজন ছেলেকেও শনাক্ত করতে সক্ষম হন। এই নতুন তথ্যের ভিত্তিতে ড্যানিয়েল ও ইউনাইটেড স্টেটস হলোকস্ট মেমোরিয়াল জাদুঘর কাজ করার জন্য আশার আলো দেখতে পায়।
জাদুঘরের কিউরেটরিয়াল অ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টর স্কট মিলার বলেন, ‘এই ছবিগুলো শনাক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছবিগুলোর মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের কাছে মর্যাদার চিহ্ন পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। ছবিগুলো পুরো ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য স্মরণীয় স্মৃতির বাহক। পরিসংখ্যানটি আমাদের সবারই জানা, হলোকস্টে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই মর্মান্তিক ঘটনায় নিহত হওয়া অনেক ব্যক্তির একটি নাম ও পরিচয় আজও জানা যায়নি। ফলে এই ছবিগুলো প্রতিটি ব্যক্তির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টসাধ্য। ব্লাঞ্চকে ছবিগুলো দেখানোর আগে মাত্র তিনজন ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা গিয়েছিল। ব্লাঞ্চ ও ড্যানিয়েলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধুনিক প্রযুক্তির সফটওয়্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ, যার কারণে সেই সংখ্যা বর্তমানে দ্বিগুণে দাঁড়িয়েছে।’