Friday, April 19, 2024
spot_img
Homeসাহিত্যসূর্য উঠার আগে

সূর্য উঠার আগে

হঠাৎ দেখে চমকে নির্বাক হয়ে গেছি থমকে, মনে হলো দেখে তারে অনেক দিনের চেনা। পুরনো প্রেমিককে বহু বছর পর হঠাৎ দেখলে এমনটি মনে হয়। হবে না কেন ত্রিশ বছর আগে শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্ক মুহূর্তে একেক করে মনের দুয়ারে এসে হাজির হয়ে গেল।

লেনা আমাকে দেখেনি, ভাবলাম একটু সারপ্রাইজ দিই। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠতেই নজরে পড়ল আমাকে। প্রথম দেখাতেই বলল- আরে তুমি? হঠাৎ? কেমন আছো? কোথায় আছো? কী করছো? কোথায় যাবে? বলতে বলতে জড়িয়ে ধরল আমাকে। আমার বলার কিছু ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ কল্পনার রাজ্য থেকে বের হয়ে বললাম চলো কফি হাউসে বসি। কাজ শেষে একটু শপিং করতে এসেছিলাম, বাসায় ফিরতে দেরি হবে।

এক্সপ্রেসো হাউসে ঢুকে দুই কাপ কফি অর্ডার দিয়ে বসলাম। হলো কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ অতীত এবং বর্তমানকে নিয়ে। শেষে বিদায়ের পালা, যাবার বেলা লেনা শুধু বলল- আমাকে ফেলে সেই যে চলে গেলে আর একবারও যোগাযোগ করলে না! তা হঠাৎ কেন আমাকে দেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে? আমি বললাম ফেলে ঠিক নয়, তবে চলে গিয়েছিলাম। সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম হৃদয়ে তোমাকে এবং তোমার ভালোবাসাকে, তাইতো আজ তোমাকে দেখে চিনতে একটুও দেরি হয়নি। বিদায় বেলা লেনা তার বিজনেস কার্ডটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো যদি মন চায় ফোন কর। যাবার বেলা বললো বাসায় যেতে হবে তাড়া আছে, আশা করি আবার দেখা হবে।

এদিকে আমারও বাসায় আসতে বেশ দেরি হয়ে গেল। বাসায় ঢুকে দেখি আমার স্ত্রী বেশ মন খারাপ করে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার মন খারাপ কেন? সে বললো তুমি ভুলে গেছো আজ আমার জন্মদিন? গতকাল বলেছিলে বাইরে ডিনারে নিয়ে যাবে।

আমি বললাম সমস্যা কোথায় রাত তো বেশি হয়নি, একটু ফ্রেশ হয়ে চল বাইরে যাই?
কারিনা প্রথমে যেতে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়ে গেল। ডিনারে যে রেস্টুরেন্টে ঢুকেছি সেখানেই লেনা এসেছে তার স্বামীর সঙ্গে ডিনারে। ওয়াট অ্যা কোইনসিডেন্স!

লেনা আমাকে দূর হতে দেখেছে। নতুন করে অল্প সময়ের মধ্যে আবারও দেখা! পরিচয় করিয়ে দিল লেনার স্বামী পিটারকে। আমি পরিচয় করে দিলাম কারিনাকে। পিটার বললো, চল আমরা এক টেবিলে বসি। কারিনার চোখে চোখ পড়তেই সে রাজি হয়ে গেল। পিটার খুব মজার মানুষ, অল্প সময়ের মধ্যে আমাদেরকে আপন করে নিয়েছে। পিটার, লেনার চেয়ে বয়সে বেশ বড়। রিয়েল স্টেটের ব্যবসা করে, মানে দেশের ধনীদের মধ্যে একজন। ছেলেমেয়ে হয়নি তাদের। লেনার সঙ্গে বিয়ের পর লেনা লিভমডার্ন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং তাদের আর কোন সন্তান হবে না এমনটি ডাক্তারি রিপোর্টে জানানো হয়। এ সময় লেনার মাথার চুল পড়ে যায়, চেহারার এই বিকৃতি অবস্থায় অন্য কোন ছেলে হলে হয়তবা তাকে ছেড়ে চলে যেত, কিন্তু না পিটার তা করেনি। বয়সে বড় হলেও ভালোবাসা দিয়ে আকড়ে ধরে আছে সেই থেকে লেনাকে। অনেক কিছুই জানা হলো, অনেক কথা বলা হলো। বিদায় বেলা লেনা কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে গেল, আবার হবে তো দেখা? এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো!

আমি কারিনাকে নিয়ে বাড়ি আসার পথে ভাবছি, জানিনা লেনা এখন কার কথা এবং কী কথা ভাবছে! পুরনো প্রেমের উদয় হলো নাতো? এমনটি প্রশ্ন ভাবনায় ঢুকেছে।

চলছে দিনকাল, কাজ আর বাসা। এদিকে সামনে বড় দিনের ছুটি, কারিনার সখ একটি ভালো ক্যামেরা কিনবে। ভাবলাম তাহলে আমি বড় দিনের উপহার হিসাবে একটি ক্যামেরা কিনি, যেই ভাবনা সেই কাজ। বাড়িতে এসে উপহারটি কারিনার হাতে তুলে দিলাম। উপহারটি পেয়ে সে তো মহাখুশি।

তাড়াহুড়ো করে সেও আমার হাতে তার কেনা উপহারটি দিল। খুলে দেখি এক বিস্ময়কর মহাকাব্য, যার কথা শুনেছি কিন্তু চোখে দেখিনি এর আগে। হতভম্ভ হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে বইটি দেখছি, দেখছি বইয়ের ভেতর এবং বাইরে। আশ্চর্য কিছুই তো বুঝতে পারছি নে? কি হবে এ বই দিয়ে যদি পড়তেই না পারি? ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে কোনো এক ব্যক্তি এক উদ্ভট অক্ষরে মিরাকেল এই কাব্য লিখেছিল। শুনেছি স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তরিত করা যায় এমন ধরনের তন্ত্র মন্ত্র রয়েছে এই বইয়ের মাঝে। আজ আমার হাতে সেই বই, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে!

রাতে কারিনাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কীভাবে এই বই পেল?

উত্তরে সে বললো মিসর সফরে যখন গিয়েছিলাম তখন এক বৃদ্ধ লোক ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলেছিল এই বইটি সম্পর্কে। তখন তোমার কথা মনে পড়ে যায়।
কি কথা?
তুমি বলেছিলে আমাদের প্রথম পরিচয়ে, আমি স্বপ্নের রাজ্যে বাস করি তবে স্বপ্নের সত্যি কখনো অনুভব করিনি। জীবনের সখ যদি এমন কোন কাব্য থাকত তাহলে যত টাকা হোক না কেন কিনতাম।

বৃদ্ধ বেচারা যখন বললো ভাবলাম খুব বেশি নয় সামান্য পয়সার বিনিময়ে বইটি বিক্রি করতে চায়, কি আসে যায় যদি তার কথা সত্যি না হয়! খুব তো বেশি টাকা নয়, কিনি বইটি। বেচারার দিনটি ভালো যাবে আমারও একটি স্মৃতি থেকে যাবে, সঙ্গে তোমাকে বড় দিনে উপহারটি দিতে পারব।

মহাকাব্য আমার হাতে, তবে সত্য কিনা বা কি লিখা এ তো জানার কোন উপায় নেই! বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম! লেনা পেশাগতভাবে আর্কিওলজিস্ট হিসাবে কাজ করে, ভাবলাম তাকে ফোন করলে হয়তবা কোন তথ্য পাওয়া যেতে পারে। পরের দিন সকালে লেনাকে ফোন করলাম এবং বিষয়টি সম্পর্কে বললাম। লেনা আমার কথা শুনে টেলিফোনেই একজন প্রবীণ আর্কিওলজিস্টের ঠিকানা দিলো। স্টকহোমের পুরনো শহরের একটি কর্ণারে দুই তলার উপর এক ভয়ংকর আকৃতির চেহারার মানুষ দেখে নিজেই একটু ঘাবড়ে গেলাম। তবুও এসেছি যখন তাকে বইটি দেখালাম।

বড় এক লেন্স চোখের সামনে ধরে কিছুক্ষণ পরই একটু উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেলে এই মহাকাব্য? ঘটনা খুলে বললাম যা শুনেছি কারিনার থেকে। বৃদ্ধ আর্কিওলজিস্ট শুধু বললো না এ কাজ আমি করতে পারব না।

কি কাজ তুমি করতে পারবে না আমি প্রশ্ন করলাম? উত্তরে বললো, তোমাকে এ ভাষা শিখাতে পারব না কারণ তুমি এই কাব্যের রহস্য জানতে পারলে এর ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালাবে তখন মিরাকেল ঘটনা ঘটবে যার সঠিক কারণ কেউ পৃথিবীতে দিতে পারবে না।

আমি বৃদ্ধ লোকটিকে বহু অনুরোধ করার পর বৃদ্ধ লোকটি কাব্যের রহস্য আমাকে জানাল এবং পড়া এবং বোঝার টেকনিক শিখিয়ে দিল।

বৃদ্ধ আর্কিওলজিস্টকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে আসতেই টেলিভিশনের পর্দায় রাতের খবরে জানতে পারলাম কয়েক ঘণ্টা আগে এ যুগের সবচেয়ে পুরোনো আর্কিওলজিস্টের মৃত্যু হয়েছে। (কোনো দেশ বা মহাদেশের নির্দিষ্ট বিলুপ্ত সভ্যতার সামাজিক স্থিতি, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি, বিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ও নিয়মমাফিক পদ্ধতিতে কাজ করার বিষয়কে সাধারণত আর্কিওলজি বলা হয়। এর পাশাপাশি শুধুমাত্র পুরনো সভ্যতার অংশবিশেষ, নিদর্শন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য পুনরুদ্ধারই নয়, সেগুলোকে সংরক্ষণ করে সামাজিক স্তরে মানুষের কাছে সেই ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা এবং তথ্য তুলে ধরার দায়িত্বও থাকে আর্কিওলজিস্ট অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিকদের)।

আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল, কারো সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার না করে রাতের ডিনার সেরে বিছনায় চলে গেলাম।

কারিনা জিজ্ঞেস করল, শরীর খারাপ করলো কিনা! উত্তরে বললাম না, তবে একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

ঘুম আসছে না তো গুণগুণ করে গান করতে শুরু করলাম- জানি না এখন তুমি কার কথা ভাবছ/আনমনে কার ছবি চুপি চুপি আঁকছ?

কারিনার দেওয়া মহাকাব্যটি একটু পড়তেই কখন ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই। তবে সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতের স্বপ্নের কথাগুলো বেশ মনে পড়ছে। এ স্বপ্ন আগের মতো না? এ যেন সত্যিকার ঘটনার অভিজ্ঞতা।

হঠাৎ দেখি লেনা ফোন করেছে, ফোনটি ধরে হ্যালো বলতেই বলল তোমার সঙ্গে দেখা করব, খুবই জরুরি। অফিসে লাঞ্চের সময় আসবে কিন্তু?

আমি শুধু বললাম, মনটি তোমার কেন দুরু দুরু কাঁপছে? সে বললো না ঠিক আছে পরে দেখা হবে।

লাঞ্চে লেনার সঙ্গে দেখা হতেই বলতে শুরু করল- আমি পিটারকে ভালোবাসি, সে আমার জন্য অনেক কিছু করেছে তাকে ছেড়ে তোমাকে নতুন করে বরণ করতে পারব না। তাছাড়া তুমি কি পারবে তোমার সংসার, ছেলে-মেয়ে, কারিনাকে ছেড়ে আমার সঙ্গে থাকতে?

আমি একটু অবাক হলাম প্রথমে, পরে একটুও দেরি হলো না তার সব কথা বুঝতে। রাতে তো আমি লেনাকেই স্বপ্নে দেখেছি এবং তার সঙ্গে কিছুটা মনের বদল হয়েছে। এ স্বপ্ন শুধু আমার একার নয়, যাকে নিয়ে ভাবছি তারও। সেক্ষেত্রে আমি যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি সেও সে স্বপ্নের অংশীদার হয়ে যায়। মহাকাব্যে এমনটি তন্ত্র-মন্ত্র রয়েছে। গতকাল কিছুটা রিসার্স করেছিলাম কল্পনাতে, অথচ সেটা সত্যি সত্যি ঘটেছে, ভাবতেই অবাক লাগছে!

লেনা লাঞ্চ শেষে বিদায় নিল, তবে লেনার চোখ দেখে মনে হলো সে বলছে- “কি চোখে তোমায় দেখি, বোঝাতে পারিনি আজও হয়তো, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো”।

আমরা প্রতিদিনই স্বপ্নে দেখা করি, দেশ-বিদেশ ঘুরি। পাশে দুজন দুজনার সঙ্গীর সাথেই রাতে ঘুমোই, তবে ঘুমের ঘোরে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে; যা ইদানীং কারিনা লক্ষ্য করছে। এমনকি আমার দেওয়া সেই ক্যামেরা দিয়ে রাতের স্বপ্নে যে আমি কথা বলি সবই সে রেকর্ড করে চলছে। পরে কোনো এক সময় আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে পুনর্মিলন হয়। কারিনা এবং পিটার একে অপরের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে আলোচনায় ঘটনাটি উঠে আসে। সময়ের সাথে সাথে কারিনা এবং পিটার মাঝে মধ্যে দেখা করে। এ দেখা সেই স্বপ্নে দেখা নয়। তাদের দেখা রিয়েল। আমি স্বপ্নের রাজ্যে লেনাকে নিয়ে ব্যস্ত, এদিকে আমার কারিনা লেনার পিটারকে নিয়ে নতুন ভালোবাসার রিয়েল কাব্য রচনা করেছে।

আর আমি “বসে আছি পথ চেয়ে, ফাগুনেরও গান গেয়ে, যত ভাবি ভুলে যাব, মনও মানে না”।

গল্পের আমি, নাম তার মাটস। মাটস ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এভাবেই বর্ণনা করেছিল সেদিন রাতে। আমি বললাম তারপর কী হলো? মাটস শুধু বলল- তার আর পর নেই, আমি স্বপ্নের রাজ্যে বসবাস করছি সেই থেকে…।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments