Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeসাহিত্যসুভাষ সিংহ রায়ের ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’

সুভাষ সিংহ রায়ের ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’

বঙ্গবন্ধু গবেষক হিসেবে ২০২৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ সুভাষ সিংহ রায় (জন্ম ১৯৬৬) লিখেছেন বহুল আলোচিত বিষয় ‘বাকশাল’ নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’ শিরোনামে ২৪০ পৃষ্ঠার একটি নতুন বই। আমরা যারা বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেখ হাসিনা সম্পর্কে তাঁর গবেষণা কাজের সঙ্গে পরিচিত তারা এক কথায় বলতে পারি তিনি যথার্থভাবেই একজন একাডেমিশিয়ান।

সুভাষ সিংহ রায় যখন কথা বলেন তখন যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত যথাস্থানে, যথা প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। তাঁর ব্যক্তিগত বিশাল গ্রন্থাগারে অসংখ্য বই রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো বিষয়ে রেফারেন্স দিয়ে কথা বলতে শুনবেন শ্রোতৃমণ্ডলী কিংবা পাঠকসমাজ তাঁর লেখায় ব্যবহার করতে দেখবেন নতুন প্রকাশিত বিখ্যাত বইয়ের উদ্ধৃতি নির্দ্বিধায়, অবলীলায়। 

 বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কাঠামোয় যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক এবং শোষণহীন সমাজের ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত কাল পরিসরে নিঃশেষিত হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের। আর ২০০৯ সাল থেকে পূর্ণ মাত্রায় তার বাস্তব রূপ বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশালে’র নীতি-আদর্শ, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি এখনো প্রাসঙ্গিক- লেখক সুভাষ সিংহ রায়ের আলোচ্য গ্রন্থ পাঠ করলে তা আরো বেশি স্বচ্ছ হবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কাঠামোয় যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক এবং শোষণহীন সমাজের ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত কাল পরিসরে নিঃশেষিত হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের। আর ২০০৯ সাল থেকে পূর্ণ মাত্রায় তার বাস্তব রূপ বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশালে’র নীতি-আদর্শ, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি এখনো প্রাসঙ্গিক- লেখক সুভাষ সিংহ রায়ের আলোচ্য গ্রন্থ পাঠ করলে তা আরো বেশি স্বচ্ছ হবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য 

স্মৃতিশক্তির প্রখরতায় তিনি মেধা ও মননের অনন্য পরিব্রাজক। লেখাবাহুল্য, তিনি আপদমস্তক প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার অধিকারী একজন লেখক। সমাজ ও মানুষকে তিনি বিশ্লেষণ করেন পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে।

ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী কর্মী ও নেতা সুভাষ সিংহ রায় সমকাল সচেতন এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইতিহাসের গতিমুখ সম্পর্কে সত্যান্বেষী। এজন্য বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তা, তাঁর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন ও শাসনকাল এবং দেশ-জাতি নিয়ে তাঁর ভাবনা-বিশ্বাস সম্পর্কিত রচনা, বক্তব্য-ভাষণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রন্থসমূহ নিবিড়ভাবে পাঠ করে সাধারণ পাঠকের জন্য নিজের লেখনি দাঁড় করিয়েছেন তিনি।

‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’ গ্রন্থটি পাঠ করলে সুভাষ সিংহের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার পরিধি মাপা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কেবল এ গ্রন্থটি নয় তাঁর  প্রকাশিত ২৫টি গ্রন্থের মধ্যে আরও রয়েছে- ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু পরিবার’, ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা’, ‘বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িকতা’, ‘পাঠক বঙ্গবন্ধু লেখক বঙ্গবন্ধু’ প্রভৃতি। 

এছাড়া তিনি শেখ হাসিনাকে নিয়ে সর্বাধিক গ্রন্থের রচয়িতাও। ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’র ফ্ল্যাপে বইটির পরিচয় রয়েছে এভাবে- ‘স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি হয়েছিল, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে।’ 

যার ফলে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বহু লালিত স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ কর্মসূচির মাধ্যমে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত কার্যকরী মাধ্যম ছিল জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি মাত্র রাজনৈতিক দল ‘বাকশাল’। জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে তখনকার বিশ্ব বাস্তবতায় একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক কর্মসূচিকে ঈপ্সিত লক্ষাভিমুখী দক্ষভাবে পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

“উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে সব দলের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করেন বঙ্গবন্ধু।’’ বাকশালের মূল লক্ষ্য ছিল একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও শোষিতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা; যা ছিল জনগণের যুগ যুগের লালিত স্বপ্নের মহত্তম আকাঙ্ক্ষার গৌরবময় বহিঃপ্রকাশ। বাকশাল কর্মসূচিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এক. রাজনৈতিক, দুই. আর্থ-সামাজিক, তিন. প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা- এই বইটিতে যার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। 

১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠনের পূর্বে ও পরে পার্লামেন্ট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা এবং গণভবনে জেলা গভর্নর ও বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই ভাষণগুলোর সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ এবং এতে নিহিত বাকশাল কর্মসূচির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে বইটিতে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থবাদীরা পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, যাতে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে দেশ অগ্রসর হতে না পারে। এই বইটিতে ইতিহাসের সেই অধ্যায়কেই পাঠকের নিকট তুলে ধরা হয়েছে, যা পনেরোই আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার ভেতর দিয়ে পরিসমাপ্ত হয়েছে।’

আলোচ্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য অনুধাবনের জন্য গ্রন্থ-পরিচিতির এই অংশটি পাঠকদের জন্য সহায়ক।প্রকৃতপক্ষে সুভাষ সিংহ রায় বাকশাল কি এই পরিচয় দিয়ে শুরু করে বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্য, বাকশালের ধারাসমূহ, সংবিধানের ধারা, কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রভৃতির অনুপুঙ্খ বিবরণ উপস্থাপন করেছেন।লেখকের ভাষ্য-‘তারিখটা ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। 

বেশ কিছুদিন ধরেই জল্পনা-কল্পনা চলছিল, দেশে একটা পরিবর্তন আসন্ন। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল ও কার্যনির্বাহী পরিষদের যৌথসভায় জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনীয় যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সার্বিকভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর অর্পণ করা হয়। নয়া ব্যবস্থার রূপকাঠামো কী হবে তা পরিষ্কার উল্লেখ না করেও আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিয়ে আসছিলেন। 

সন্দেহবাদীদের সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সত্যিই এলো প্রতীক্ষিত সেই দিন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্ট ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা। তিনি বললেন, জনাব স্পীকার, আজ আমাদের শাসনতন্ত্রের কিছু অংশ সংশোধন করতে হলো। আপনার মনে আছে, যখন শাসনতন্ত্র পাস করা হয়, তখন আমি এ হাউজের পক্ষ থেকে বলেছিলাম, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যদি দরকার হয়, তবে এই সংবিধানেরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হবে।’ (পৃ ৫৭)

অন্যত্র- ‘সংসদের চৌহদ্দির মধ্যেই নয়, নেতা এলেন এবার জনতার মাঝে, সরাসরি কথা বলতে। ১৯৭৫, ২৬ মার্চ, স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখানে সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিল। জীবনের শেষ জনসভায় ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অগ্নিঝরা সেই কণ্ঠস্বর শেষবারের মতো মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন জাগ্রত করেছিল। তিনি বললেন। মানুষ শুনলেন।’ (পৃ ৭৪)

অন্যদিকে ‘‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’’ গ্রন্থে পর্যায়ক্রমে আছে, পার্লামেন্টে ভাষণ : বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক, দ্বিতীয় অধ্যায় হলো-সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণ, তৃতীয় অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন। ‘বঙ্গভবনে বাকশাল প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে বিশদ আলোচনা। একদলীয় ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ ও দেশ-বিদেশে অভিনন্দিত করার বিবরণের ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বিস্তৃত পরিসরে। 

বঙ্গবন্ধু গবেষক সুভাষ সিংহ রায়ের লেখনির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সহজ গদ্যে সংহত কথন। ‘কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধু’ অংশে তিনি দেখিয়েছেন ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির ওপর।তাই সেই কমিটির সদস্যদের নিয়ে বসেছিলেন চেয়ারম্যান শেখ মুজিব। কর্মসূচি ব্যাখ্যা করার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন করে দিয়েছিলেন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কেও।বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার ভাষণের মাঝে ছিল দ্বিতীয় বিপ্লব পরিচালনার কর্মসূচি, যার চুম্বক অংশ নিম্নরূপ- ‘১. নতুন পদ্ধতি। ৬০ জেলার প্রত্যেকক জেলায় একজন করে গভর্নর থাকবে; ২. স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। এখানে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, ‘‘সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুভাবে বসবাস করা আমাদের কর্তব্য। কোনো যুদ্ধজোটে আমাদের যোগদান করার কথা চিন্তা করাও জঘন্য পাপ। কারণ আমাদের বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য সাহায্য করা দরকার।”৩. একতা মঙ্গলের পথ; ৪. আত্মসমালোচনা চাই- আত্মসমালোচনা না থাকলে আত্মশুদ্ধি করা যায় না; ৫. ডেডিকেটেট ওয়ার্কার চাই; ৬. নতুন করে গড়তে হবে- সমবায় পদ্ধতি চালু; ৭. ১০০ বিঘার বেশি জমি থাকবে না; ৮. অর্থনৈতিক অগ্রগতি- সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চাই; ৯. শোষণহীন সমাজ গঠনের পথ; ১০. দুর্নীতিমুক্ত দেশ।’(পৃ ১০৬)

লেখক জানিয়েছেন, একটা গণতান্ত্রিক প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল দ্বিতীয় বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে সারাদেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। নিযুক্ত হন ৬১ জন গভর্নর। শাসনতান্ত্রিক বিধানে ছিল জেলা গভর্নরদের নিজ নিজ এলাকায় সাধারণ ভোটে নির্বাচিত হতে হবে।

গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর নয়া প্রশাসনব্যবস্থার রূপকাঠামো বিশদভাবে আলোচনা করেন।১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নতুন পদ্ধতি কার্যকর করার জন্য নিয়োজিত গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বঙ্গভবনে শুরু হয়।বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে যে কর্মসূচি ঘোষণা করেন তা হলো-ক) পুরাতন ঘুণেধরা সিস্টেম- চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে; খ) দেশের শাসক নয়- দেশের সেবক হিসেবে আত্মনিয়োগ করতে হবে; গ) জনগণের সাথে যোগাযোগ আবশ্যক। ‘তোমরা গোলাম আমরা মালিক’ এই মনোভাব ত্যাগ করতে হবে; ঘ) নতুন পদ্ধতি- গভর্নরদের নিয়োগ; ঙ) গভর্নরদের দায়িত্ব- দুর্নীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে; চ) আইনের শাসন; ছ) নতুন বিচার পদ্ধতি; জ) দুর্নীতি দূর করতে হবে; ঝ) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ; ঞ)সমন্বয় ও পরিকল্পনা; ট)গ্রাম সমবায়।

এভাবে ‘বাকশালে’র অনন্যতার কথা বলে সুভাষ সিংহ রায় একদলীয় ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ ও দেশ-বিদেশে অভিনন্দিত হওয়ার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন আলোচ্য গ্রন্থে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের অনুমোদন নিয়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এরপর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকে যাত্রা শুরু করে দেশ। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে, সাংবিধানিকভাবে সংগঠিত এবং মূলধারার সব রাজনৈতিক দলকে তিনি একত্রে একটি পাটাতনে আনেন, স্পষ্টভাবে এটি ছিল জাতীয় ঐক্য গঠনের উদ্যোগ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনি চক্র ‘বাকশালে’র মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জাতীয় ঐক্য গঠনের উদ্যোগ সমূলে বিনষ্ট করে।পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু যে গতিতে বাংলাদেশকে উন্নয়নের আঙিনায় সমুন্নত করে তুলেছিলেন সেই অগ্রগতি থমকে যায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে।

নির্মম হত্যাকাণ্ডের সেই পটভূমি আবেগী ভাষায় তুলে ধরেছেন সুভাষ সিংহ রায় এভাবে-‘১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে পিরামিডের দেশে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তার আগে ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে লাহোরে ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনের অব্যবহিত পরে, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশ সফরে আসেন। সেই সফরের সময় তিনি বাংলাদেশকে বেশ কটি রুশ ট্যাংক দিয়েছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই ট্যাংকগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু তার পরিবারবর্গের কাপুরুষোচিত হত্যার সেই ভয়াবহ নিশীথে। বিশ্বাস, ভরসা ও আস্থার বাঙালি তাঁর বুকে ১৮টি গুলি ছুঁড়েছে। গুলিবিদ্ধ মুজিব বাংলার বুকেই লুটিয়ে পড়লেন বাংলাকে ভালোবেসে। বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণের খবর প্রকাশ হওয়ার পর কেঁপে ওঠে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। তাঁর মৃত্যুতে দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’

দ্য টাইমস অব লন্ডন-এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করে বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিনি জনগণের কাছে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, ‘আমিই রাষ্ট্র’। তাঁর মৃত্যুর পর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাতারাতি হয়ে গেল ‘ধর্মীয় বাংলাদেশ’। 

তাই ১৫ আগস্ট আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারাইনি, আমরা হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকেও, যে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ তিলে তিলে বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-“মানুষের মধ্যে দ্বিজত্ব আছে; মানুষ একাবর জন্মায় গর্ভের মধ্যে, আবার জন্মায় মুক্ত পৃথিবীতে, মানুষের এক জন্ম আপনাকে নিয়ে, আর-এক জন্ম সকলকে নিয়ে।”বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন এই বাংলার জন্য।’ (পৃ ২২৯-২৩০)

বস্তুত ‘‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’’ গ্রন্থে সুভাষ সিংহ রায়ের উপরি-উক্ত মূল্যায়ন যৌক্তিক এবং সর্বজনগ্রাহ্য বিশ্লেষণ। কারণ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কাঠামোয় যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক এবং শোষণহীন সমাজের ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত কাল পরিসরে নিঃশেষিত হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের। আর ২০০৯ সাল থেকে পূর্ণ মাত্রায় তার বাস্তব রূপ বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশালে’র নীতি-আদর্শ, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি এখনো প্রাসঙ্গিক- লেখক সুভাষ সিংহ রায়ের আলোচ্য গ্রন্থ পাঠ করলে তা আরো বেশি স্বচ্ছ হবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।

(বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল, সুভাষ সিংহ রায়, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০২৩, প্রচ্ছদ : কাজী তাবাসসুম আহমেদ, মূল্য : ৫৮০ টাকা।) 

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments