কোরআনে বর্ণিত ঐতিহাসিক জাতি—‘কওমে সামুদ’ বা সামুদ জাতি। এরা ‘কওমে আদ’-এর মতোই ইরাম এর বংশধর। জাতি হিসেবে এরাও ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান। নির্মাণশিল্পে তাদেরও খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ ও পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে স্থাপনা তৈরিতে এরা বেশ পারদর্শী ছিল। মহান আল্লাহ হজরত সালেহ (আ.)-কে এদের নবী হিসেবে পাঠান। তিনি তাদের মহান আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেন। তাদের শর্ত পূরণ করেন; কিন্তু তারা ঈমান না এনে উল্টো মহান আল্লাহর নিদর্শন উষ্ট্রীকে জবাই করে হত্যা করে এবং আল্লাহর আজাবের ব্যাপারেও সালেহ (আ.)-কে চ্যালেঞ্জ করে ও তাঁকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা করে। যার ফলে মহান আল্লাহ প্রথমত সালেহ (আ.)-কে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ৯ নেতাকে প্রস্তর বর্ষণ করে হত্যা করেন। এবং পরবর্তী সময়ে তাদের গোটা জাতিকে কঠিন আজাব দিয়ে ধ্বংস করে দেন। (সুরা : নামল, আয়াত : ৪৮-৫১ অবলম্বনে) ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা পবিত্র কোরআনের বহু সুরার বহু আয়াতে এসেছে।
সামুদ জাতি সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রী হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছিল পানি বণ্টনকে কেন্দ্র করে। সামুদ জাতির লোকেরা যে কূপ থেকে পানি পান করত এবং তাদের গবাদি পশুদের পানি পান করাত, সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রীও সেই কূপ থেকে পানি পান করত। উষ্ট্রী যেদিন পানি পান করত, সেদিন কুয়ার পানি নিঃশেষে পান করে ফেলত। অবশ্য ওই দিন লোকেরা উষ্ট্রীর দুধ পান করত এবং বাকি দুধ দ্বারা তাদের সব পাত্র ভরে নিত। কিন্তু এই হতভাগাদের কপালে এত সুখ সহ্য হলো না। তারা একদিন পানি না পাওয়াকে অসুবিধার কারণ হিসেবে গণ্য করল। তা ছাড়া উষ্ট্রী যখন ময়দানে চরে বেড়াত, তখন তার বিশাল দেহ ও অপরূপ চেহারা দেখে অন্যান্য গবাদি পশু ভয় পেত। ফলে তারা উষ্ট্রীকে মেরে ফেলতে মনস্থ করল। কিন্তু আল্লাহর গজবের ভয়ে কেউ সাহস করল না। ইবনে জারির প্রমুখ মুফাসসিরগণের বর্ণনা মতে, অবশেষে শয়তান তাদের সর্ববৃহৎ কুমন্ত্রণা দিল। আর তা হলো নারীর প্রলোভন। (সূত্র : নবীদের কাহিনি)
কারো কারো মতে, সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রী হত্যার পেছনে ছিল দুজন নারী। তাদের একজনের নাম ছিল উনাইজা, আরেকজনের নাম ছিল সুদফা। উনাইজা ছিল গোত্র নেতা ধনাঢ্য জাআব ইবনে উমরের স্ত্রী। সে সালেহ (আ.)-এর ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল। কেননা তার মেয়ের হবু স্বামী সালেহ (আ.)-এর ধর্ম গ্রহণ করেছিল বিধায় তার মেয়েকে বিয়ে করেনি। তাই সে সালেহ (আ.)-এর মুজিজাস্বরূপ পাঠানো উষ্ট্রীকে হত্যা করিয়ে তাঁকে হেয় করে তাঁর ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইল। এ জন্যই সে তাদের গোত্রের নেতৃস্থানীয় এক নিকৃষ্ট লোককে এ কাজের প্রলোভন দিতে লাগল, যে যদি তুমি সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রীকে হত্যা করতে পারো, তবে আমার কোনো একটা মেয়েকে তোমার কাছে বিয়ে দেব। তার নাম ছিল কুদার ইবনে সালেফ। উনাইজার প্রস্তাবে কুদার ইবনে সালেফ উষ্ট্রীটিকে হত্যা করতে রাজি হয়ে যায়।
এদিকে গোত্রের সুন্দরী ও ধনাঢ্য নারী সুদফাও সালেহ (আ.)-এর ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। কেননা তার স্বামীও সালেহ (আ.)-এর কথায় এক আল্লাহর উপাসনায় মগ্ন হয়েছে এবং তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তাই সেও সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রী হত্যার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে এবং এ কাজের জন্য সে প্রথমে সামুদ গোত্রের হুবাব নামক লোককে প্রস্তাব দেয়, যে যদি তুমি এ কাজ করতে পারো, তাহলে আমি তোমার। কিন্তু হুবাব তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। পরবর্তী সময়ে সে আগে থেকে তার প্রতি দুর্বল থাকা চাচাতো ভাই মুসাদ্দা ইবনে মুহাররিজ ইবনে মুহাইয়াকে প্রলোভন দেয় যে যদি তুমি সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রী হত্যা করতে পারো, তবে আমি তোমাকে বিয়ে করব। সে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। (সূত্র : আল বাহরুল মুহিত, মুজামু আলামিন নিসা ফিল কোরআনিল কারিম, পৃষ্ঠা ১৯০-১৯১)
এবং তারা সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রীর ওপর হামলা করে তাকে হত্যা করে ফেলে। এটাকে তারা তাদের বিজয় ভাবতে শুরু করে; কিন্তু মূলত এটা ছিল তার চূড়ান্ত ধ্বংসের ফটক মাত্র। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কিন্তু তারা রাসুলের কথা অগ্রাহ্য করল এবং উটনিকে জবাই করে দিল। শেষ পর্যন্ত তাদের পাপের কারণে তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন।’ (সুরা শামস, আয়াত : ১৪)