Thursday, April 18, 2024
spot_img
Homeলাইফস্টাইলশিশুর মারাত্মক অপুষ্টি রোগে করণীয়

শিশুর মারাত্মক অপুষ্টি রোগে করণীয়

শিশুর কঙ্কালসার দেহ, চর্বি বলতে কিছু নেই। কাঁধ, বাহু, ঊরু—সবখানে অস্থিচর্মসার অবস্থা। চামড়া ঝুলে আছে। বুকের সব অস্থি বাহ্যিকভাবে ফুটে উঠেছে। এ অবস্থায় শিশুর শারীরিক পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

শিশুর শারীরিক পরীক্ষা

♦ শিশুর পানি স্বল্পতার কোনো চিহ্ন বা শকের লক্ষণাদি আছে কিনা

♦ হাতের তালু মারাত্মক রকমের ফ্যাকাসে।

♦ শুষ্ক চোখ, বিটটস স্পট, কেরাটোমেলেসিয়া, কর্নিয়ার ক্ষত—এসব পরীক্ষা করার সময় শিশুর চোখ যদি বন্ধ থাকে, তাহলে খুব মোলায়েমভাবে চোখ খুলতে হবে

♦ কান পাকা, গলা ব্যথা, ত্বকের সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া বা অন্য কোনো ইনফেকশনের লক্ষণ আছে কিনা

♦ এইডসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ

♦ জ্বর অথবা তাপমাত্রা কমে যাওয়া। রেকটাল তাপমাত্রা ৩৫.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ৯৫.৯০ ফারেনহাইটের কম

♦ মুখে ঘা

♦ চামড়ায় কোয়াশিওরকারের পরিবর্তন চিহ্নাদি। যেমন—ত্বকে কতটা অংশ সাদা, কতটা কালো হয়ে থাকে। ক্ষত : দুই পায়ে, ঊরুতে, কানের পেছনে, কখনো বা পুরো শরীরে ছড়ানো অবস্থায় দেখা যেতে পারে। ঘা থেকে পানি ঝরছে।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা

♦ মারাত্মক অপুষ্টি সমস্যাজনিত শিশুর চিকিৎসা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্টাফ থাকাই বাঞ্ছনীয়। অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশু থেকে অপুষ্টি সমস্যাজনিত শিশুটিকে পৃথক ইউনিটে রাখা উচিত।

♦ শিশুকে রাখতে হবে উষ্ণ স্থানে (২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। শিশুকে পরিষ্কার করার পরপরই তাড়াতাড়ি শুকনা কাপড়চোপড় পরানো উচিত।

♦ সার্বক্ষণিকভাবে মা যেন শিশুর সঙ্গে থাকেন।

♦ শিশুর খাবার ঠিক নিয়মে তৈরি করতে হবে। দিনরাতে তাকে খাওয়ানোর প্রক্রিয়াটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে হবে।

♦ নিয়মিত ওজন মাপা। খাবারের তালিকা করে শিশুর ওজন বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা। বহির্বিভাগ ও কমিউনিটি স্তরে অসুস্থ শিশুকে ভালোভাবে পুনর্বাসিত করা, যাতে আবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে।

চিকিৎসার নানা দিক

হাইপোগ্লাইসেমিয়া : মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা সব শিশুর ‘রক্তে গ্লুকোজের কম মাত্রা’ সমস্যায় পড়ার ঝুঁকি থাকে, যে কারণে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে ১০ শতাংশ গ্লুকোজ বা সুক্রোজ বা খাবার খেতে দিতে হবে। এসব বাচ্চাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধক ঘন ঘন খাবার খেতে দিতে হয়। হাইপোগ্লাইসেমিয়া ও হাইপোথারমিয়া কখনো বা একসঙ্গে মেলে ও ইনফেকশনের লক্ষণ বলে বিবেচিত হয়।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া নির্ণয় : ব্লাড গ্লুকোজ তিন মিলিমোল/লিটার (৫৪ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার)-এর কম হলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বুঝতে হবে। এটা ধারণা করা হয়ে থাকে যে মারাত্মক অপুষ্টিগ্রস্ত সব শিশুর হাইপোগ্লাইসেমিয়া থাকে।

শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখা : মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর প্রধান মৃত্যুর কারণ তৈরি হয় শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার জন্য। সুতরাং তাদের দেহের তাপমাত্রার সুরক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তাপমাত্রা বজায় রাখার স্বার্থে শিশুটিকে ঘন ঘন খাবার খাওয়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বগলের নিচে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কম থাকলে তাকে ‘হাইপোথারমিয়া’ বলা যাবে।

শিশুর সারা শরীর গরম রাখার জন্য পোশাক পরানো। মাথাও ঢেকে দেওয়া চাই। গরম কম্বল ও হিটার বা ল্যাম্প কাছে রাখা যায়। মায়ের দেহের সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়া, স্কিন টু স্কিন কনট্যাক্ট এবং এরপর গরম কম্বলে বা কাপড়ে আবৃত করা।

পানিশূন্যতার চিকিৎসা : শরীরে পানি ঘাটতি বা ডিহাইড্রেশন বোঝার জন্য আছে কিছু লক্ষণ। মারাত্মক অপুষ্টি সমস্যায় ভোগা শিশুর এসব লক্ষণ বিবেচনা করে পানির ঘাটতি আছে কি না, তা নির্ণয় দুরূহ হয়ে পড়ে। শিশুর রিহাইড্রেশন অর্থাৎ পানির ঘাটতি পূরণে রিসোমল স্পেশাল রিহাইড্রেশন সলিউশন ফর ম্যালনিউট্রিশন ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে।

শিশুর খাবার : ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে খাবার দিতে হবে। এখানে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ক্যালরি বা প্রোটিন আছে কি না সে হিসাবটা জরুরি। প্রথম দিকের খাবারগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন—

ক. অল্প পরিমাণে বারবার খাবার, যাতে অসমোলালিটি ও ল্যাকটোজ উপাদান কম থাকে।

খ. মুখে বা এনজিটিউবে খাওয়াতে হবে। কখনো শিরায় নয়।

গ. ১০০ কিলোক্যালরি/শিশুর প্রতি কেজি ওজন/প্রতিদিন।

ঘ. মোট তরলের পরিমাণ : ১৩০ মিলি/কেজি/প্রতিদিন (শিশুর যদি বেশি ফোলা থাকে, তবে ১০০ মিলি/কেজি প্রতিদিন)।

ঙ. যেসব শিশু বুকের দুধ পায়, তা চালিয়ে যেতে হবে।

♦ শিশুকে কাপ বা পাত্র থেকে খেতে দেওয়া যায় চামচ ব্যবহার করে। খুব দুর্বল শিশুর জন্য ড্রপার বা সিরিঞ্জও ব্যবহার করা চলে।

♦ খাওয়ানোর একটি দিক হলো ধীরে ধীরে তার প্রতিবার খাওয়ানোর পরিমাণ বাড়িয়ে আনা ও দৈনিক খাওয়ানোর বার কমিয়ে আনা।

♦ যে শিশুর খিদে ভালো ও ফোলা ভাব নেই, তার জন্য এই ছক দু-তিন দিনের মাথায় সম্পূর্ণ করা যায়।

♦ হাসপাতালে স্টাফ যথেষ্ট থাকলে খুব অসুস্থ শিশুর জন্য তিন ঘণ্টা পর পর খাওয়ানোর বিধি চালু করা হয়। অন্ততপক্ষে প্রথম দিকে তিন ঘণ্টা পর পর খাওয়াতেই হবে। এটি লক্ষ রাখতে হবে। মা ও অন্যান্য সেবাযত্নকারীকে শিশুকে খাওয়ানোর প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা উচিত। কিভাবে খাওয়ানো হবে, তা তাঁদের বুঝিয়ে দিতে হবে, তারপর তা যথাযথ পারছেন কি না পরখ করা চাই। রাতে শিশুকে ঘড়ি ধরে খাওয়ানো চালু রাখতে হয় এবং স্টাফ ডিউটি ওভাবে সাজিয়ে নিতে হবে।

ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের ঘাটতি পূরণ

মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত সব শিশুর ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের ঘাটতি হয়ে থাকে। এটিকে ‘মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ডেফিসিয়েন্সি’ বলা হয়। এসব শিশুর অ্যানিমিয়া থাকে সচরাচর, তবে শিশুর খিদে না ফেরা পর্যন্ত এবং যে ওজনে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সে স্তরে না আসা পর্যন্ত (যা সাধারণত সপ্তাহ দুই লেগে যায়) শিশুকে আয়রন দেওয়া উচিত হবে না। কেননা আয়রন ইনফেকশনপ্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। শিশুকে অন্ততপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য প্রতিদিন মাল্টিভিটামিন এবং ফলিক এসিড, জিংক, কপার দেওয়া। শিশু যখন ওজনে বাড়া শুরু করবে, তখন ফেরাস সালফেট (তিন মিলিগ্রাম আয়রন/কেজি ওজন/প্রতিদিন)। ভিটামিন ‘এ’ দিতে হবে—মুখে (ছয় মাসের নিচের ৫০ হাজার আইইড ছয় থেকে ১২ মাস বয়সে এক লাখ আইআইউ ও এর বেশি বয়সে দুই লাখ আইইইউ) প্রথম দিন।

ইনফেকশনের চিকিৎসা : মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর ইনফেকশনের সাধারণ লক্ষণাদি; যেমন—‘জ্বর’ প্রায় থাকে না। অথচ গোপনে সে বেশ কয়েক ধরনের ইনফেকশনে আক্রান্ত থাকতে পারে। সে কারণে মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা প্রতিটি শিশু কোনো না কোনো ইনফেকশনে আক্রান্ত—এ কথা মনে রেখে সরাসরিভাবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা পেয়ে থাকে। এ ছাড়া শিশুর হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজের কম মাত্রা) ও হাইপোথারমিয়া (দেহের তাপমাত্রা নিচুতে) দেখা গেলে তা ইনফেকশনের লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইলেকট্রোলাইটের অস্বাভাবিক মানের চিকিৎসা : মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা সব শিশুর পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের মান নিচুতে থাকে, যা ঠিক করে আনতে দুই সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়।

মানসিক বিকাশে যত্ন নেওয়া : মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা শিশু বুদ্ধিবৃত্তিতে পিছিয়ে যায়, মানসিক বিকাশে পিছিয়ে যায়।

♦ প্রতিদিন তাকে ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মতো পরিকল্পিত খেলাধুলায় বসিয়ে দেওয়া।

♦ যখনই শিশু সক্ষম হয়ে উঠবে, তখনই তাকে শারীরিক সামর্থ্যে কুলাচ্ছে এমন সব কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।

♦ যতটা সম্ভব শিশুর সাহচর্যে মাকে সঙ্গদানের সুযোগ সৃষ্টি; যেমন—তাকে আরাম দেওয়ার সময়ে, তাকে খাওয়ানোর সময়ে, তাকে স্নান করানোর সময়ে, তার সঙ্গে খেলার সময়ে। আর এ জন্য শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় খেলনা রাখতে হবে।

শিশুর বেড়ে ওঠার নমুনা : মারাত্মক অপুষ্টিগ্রস্ত শিশু ভর্তি হলো হাসপাতালে, তার যথাযথ চিকিৎসা চলছে। এতে যে তার উন্নতি হচ্ছে, তা বোঝা যাবে কী করে। উন্নতির প্রথম লক্ষণ হলো খিদে ফিরে পাওয়া। সাধারণভাবে ভর্তির এক সপ্তাহের মধ্যে তা আসে। এখন লক্ষ্য হলো তাকে বেশি খাবার দিয়ে তার ওজন দ্রুত বৃদ্ধি করা, যা হবে ১০ গ্রাম/প্রতি কেজি/প্রতিদিনের বেশি। তবে এটি করতে গিয়ে অর্থাৎ বেশি খাওয়ানোর ফলে যেন হার্টফেইলিওর সমস্যায় পড়তে না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

♦ এসব শিশুকে প্রতিদিন সকালে খাওয়ানোর আগে ওজন নিতে হবে ও চার্টে ফেলে দেখতে হবে।

♦ প্রতিদিন (তিন দিন অন্তর) তার ওজন গ্রাম/কেজি/দিন কতটা বাড়ল, তা হিসাব করা যায়।

♦ যদি ওজন বাড়া পাঁচ গ্রাম/কেজি/প্রতিদিন এ রকম হয়, তবে শিশুকে নতুন করে সম্পূর্ণ পরীক্ষা করতে হবে। কেননা এই বাড়া সন্তোষজনক নয়।

♦ বাড়ানো যদি ৫ থেকে ১০ গ্রাম/কেজি/দিন হয়, তবে মোটামুটি বলে গ্রহণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে খতিয়ে দেখতে হবে যে শিশুকে খাওয়ানোর টার্গেট পরিমাণ সঠিক আছে কি না অথবা শিশুর ইনফেকশন আছে এমন কোনো আশঙ্কা থেকে গেলে তার চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে কি না।

সেরে ওঠার পর ফলোআপ : ঘন ঘন খাওয়াতে হবে ক্যালরিসমৃদ্ধ ও পুষ্টিসম্পন্ন খাবার দিয়ে। ঘরে শিশুকে যে খাবার বানিয়ে দেওয়া হবে, তা যে ১৫০ কিলোক্যালরি/কেজি ও চার গ্রাম প্রোটিন/কেজি এই মানে সম্পূর্ণ থাকে মাকে বা সেবাযত্নকারীকে তা দেখিয়ে দিতে হবে। শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার অন্ততপক্ষে দৈনিক পাঁচবার দিতে হবে—

♦ মূল খাবারের শক্তিসম্পন্ন স্ন্যাকস; যেমন—দুধ, কলা, পাউরুটি, বিস্কুট খেতে দেওয়া যায়।

♦ শিশু যেন প্রতিবারে দেওয়া সবটুকু খাবার খেয়ে নেয়, সে ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা ও উৎসাহ দেওয়া।

♦ শিশুর জন্য দেওয়া খাবার আলাদাভাবে দেওয়া উচিত, যাতে তার গ্রহণকৃত খাবারের পরিমাণ সম্পর্কে হিসাব রাখা যায়।

♦ খাবারের পাশাপাশি ইলেকট্রোলাইট ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জোগান দিতে হবে।

♦ শিশু যদি বুকের দুধ পান করে, তবে যতবার চায় ততবার তা দেওয়া যায়।

♦ তার বয়স অনুযায়ী তাকে খেলতে দিতে হবে।

এ ছাড়া বাচ্চা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও মাকে বলতে হবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর শিশুকে ডাক্তার দেখিয়ে যেতে হবে। আর সেটা অনেকটা এমন—হাসপাতাল ছাড়ার এক সপ্তাহ পর, দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষে ও চতুর্থ সপ্তাহে। পরবর্তী সময়ে প্রতি মাসে একবার, ছয় মাস অন্তর ‘এ’ ভিটামিন পাচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments