Saturday, April 20, 2024
spot_img
Homeজাতীয়লাশটা হলেও ফেরত দিন

লাশটা হলেও ফেরত দিন

গুম হওয়াদের স্বজনদের মানববন্ধন

বাবা পারভেজ হোসেন যখন গুম হয়েছিলেন তখন আদিবা ইসলাম হৃদির বয়স ছিল ২ বছর ৪ মাস। তার তখন অনেক কিছু বুঝার মতো বয়স ছিল না। সবেমাত্র বাবা-মায়ের আদর, ভালোবাসা ও তাদেরকে চিনতে শুরু করেছিল। সময়টা ছিল ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর। হৃদির বয়স এখন সাড়ে আট বছর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বাবার অভাবটুকু আঁচ করতে পারছে। সমবয়সীরা যখন বাবা বলে ডাকে, বাবার আদর পায় তখন হৃদি তার মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। মা ফারজানা আক্তার তখন কোনো উত্তর দিতে পারেন না। বলতে পারেন না তার বাবাকে গুম করা হয়েছে। আর বললেও গুম কী সেটা বুঝতে পারার কথাও না হৃদির।

বিজ্ঞাপন

https://76e6be945a2ade359a9a871e2673210d.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-38/html/container.html?n=1কিন্তু গুমের পর প্রতিবছরই বাবার ছবি নিয়ে মায়ের সঙ্গে হৃদি গুম হওয়াদের ফেরতের দাবিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হয়। গতকাল জাতীয় জাদুঘরের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদি বলে আমার বাবাকে আমি অনেক মিস করি। বাবাকে ফেরত চাই। হৃদির বাবা পারভেজ বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। 

শুধু হৃদি নয় তার সঙ্গে আসা বংশাল ছাত্রদলের সহ-সভাপতি সোহেলের মেয়ে সাদিয়া সরকার সাফাও বাবার ছবি নিয়ে কাঁদছে। সোহেল গুম হওয়ার সময় সাফার বয়স ছিল মাত্র তিন মাস। বাবা কেমন হয়, বাবা কি তখন তার বুঝার বয়স হয়নি। কিন্তু এখন প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত সে বাবার কথা মনে করে। বাবা কবে বাড়ি আসবে এ নিয়ে মাকে জ্বালাতন করে। কিন্তু তার মা তাকে কোনো জবাব দিতে পারেন না। পারভেজ, সোহেলের সঙ্গে একই দিন বংশাল থানা ছাত্রদলের চঞ্চল হোসেন ও জহির নিখোঁজ হয়েছিলেন। শাহবাগ এলাকা  থেকে তাদেরকে গুম করা হয়েছিল। 

হৃদি ও সাফা বাবাকে ফেরত চাইলেও ঢাকার সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য চৌধুরী আলমের ভাই খুরশিদ আলম মিঠু বলেন, যদি আমার ভাইকে যদি মেরে ফেলা হয় তবে কবরে এক মুঠো মাটি দেয়ার জন্য লাশটা অন্তত ফেরত দেন। বলেন, ২০১০ সালের ২৫শে জুন ইন্দিরা রোড থেকে সাদা পোশাকের লোকজন আমার ভাইদের তুলে নিয়ে যায়। ১২ বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করেছি। কোনো লাভ হয়নি।  

গতকাল ছিল আন্তর্জাতিক গুম দিবস। দিনটিকে ঘিরে সকালে রাজধানীর শাহবাগে গুম হওয়া শতাধিক ব্যক্তির স্বজনরা জড়ো হন হাতে প্ল্যাকার্ড ও গুম হওয়া ব্যক্তির ছবি নিয়ে মানববন্ধনে হাজির হয়েছিলেন। গুম দিবস উপলক্ষে মায়ের ডাকের ব্যানারে এই মানববন্ধনের আয়োজন করে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দুই ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনে প্রিয়জনকে ফিরে পেতে স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়েছিল শাহবাগ এলাকা। স্বজনরাই শুধু কাঁদেননি। সেখানে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে যারা এসেছিলেন তারাও কেঁদেছেন। আফরোজা ইসলাম আঁখির সভাপতিত্বে গুমের শিকার পরিবারের স্বজনরা ছাড়াও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাবিত আউয়াল, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বক্তারা বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনেরও দাবি জানান।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেটকে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালের কর্মকর্তারা বলেছেন দেশে কোনো গুম নাই। তারা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন যারা নিখোঁজ আছেন তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য। মান্না বলেন, একটু ভেবে দেখেন কতো বড় হৃদয়হীনতা এই সরকার করছে। এই কড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চেহারাগুলো দেখেন কতো করুণ। কিন্তু আমাদের সরকার বা মন্ত্রীরা সেটি দেখেন না। নিখোঁজ হওয়ার পর যে ১০ জন ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে ৬ জনই বলেছেন তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। তাই এটা গুমকারী সরকার। জাতিসংঘ বলছে ৭৬ জন নিখোঁজ আর আমাদের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে কমপক্ষে ১ হাজার মানুষ গুম। এদেরকে নিয়ে আমরা এখন কথা বলি না। সরকার এদের কণ্ঠ বন্ধ করার জন্য মিথ্যাচার করছে। মিশেল বাশেলেট যখন আসেন তখন জাতিসংঘ আসে। তার মানে জাতিসংঘের কাছে মিথ্যাচার করা হয়। তিনি বলেন, যারা ক্ষমতায় আছে তারা প্যাঁচে পড়ে গেছে। তাদের কথা দেশে-বিদেশে এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। আন্তর্জাতিকভাবে বলা হয়েছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া তারা পরের সরকারকে মানবে না। এ জন্য তারা বলছে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনা যায় কিনা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলবো, এই পরিস্থিতি চিরকাল থাকবে না।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, যারা গুম হচ্ছেন তাদের কেউ কেউ ফিরে এসেছেন। কিন্তু তারা কেউই কথা বলছেন না। তারা এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন ফিরে এসে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না। এতে পরিষ্কার তাদেরকে এমন স্থানে রাখা হয়েছিল এবং এতটাই ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে যে, ফিরে এসে একটি শব্দও বলতে চান না। যে কয়েকজন কথা বলেছেন তাদের বর্ণনার সঙ্গে এসব ঘটনা মিলে যায়। যারা এখনো নিখোঁজ আছেন তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হউক। যারা ফিরে এসেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলুন। যেসব বন্দিশালা তৈরি করা হয়েছে এগুলোর সঙ্গে যে পর্যায়ের ব্যক্তিরা জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হউক। এজন্য অবিলম্বে একটা স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। তিনি বলেন, গুমের শিকার পরিবারের নিরাপত্তা ও প্রত্যেকটি ঘটনায় মামলা নিতে হবে। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের স্বজনদের বক্তব্য অনুযায়ী স্পষ্ট, এসবের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত। তবুও সরকারের পক্ষ থেকে হাসি তামাশা করা হয়। 

বিএনপি নেতা তাবিথ আওয়াল বলেন, দেশের জনগণ ও সরকারের  কাছে আমরা বারবার হাজির হচ্ছি একটি কথা নিয়ে। আমাদের পরিবারের সদস্যরা কোথায় আছে? এই প্রশ্নের উত্তরটা বর্তমান অবৈধ সরকারের পক্ষ থেকে দিতে হবে। তারা যতই সময় নষ্ট করছে এতে কোনো লাভ হবে না। আমাদের চোখের পানি কোনোদিন শুকাবে না বুকের ব্যথাও কমবে না। বরং যতদিন যাচ্ছে আমাদের আন্দোলন ন্যায়বিচারের জন্য দাবি আরও শক্তিশালী হচ্ছে। শুধু ঢাকা শহর বা বাংলাদেশ নয়। আজকে আন্তর্জাতিক মহলও বাংলাদেশের গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের পাশে। তিনি বলেন, সেইদিন আর বেশি দূরে নয়। আমরা ন্যায়বিচার পাবো। বিচার নিশ্চিত করে ছাড়বো। 

ডাকসু’র সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, মন্ত্রিসভার সদস্যরা মিথ্যাবাদী। আজ যদি বলি আপনারা তা লিখতে বা প্রচার করতে তা পারবেন না। সেই সক্ষমতা মিডিয়ার নেই। আজ এখানে যে ছোট বাচ্চারা তাদের বাবার জন্য কান্না করছে এই কান্না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সবার কানে পৌঁছালে তাদের রোদ বৃষ্টিতে ভিজে প্রেস ক্লাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মানববন্ধন করতে হতো না। তিনি বলেন, গুম হওয়া ব্যক্তিরা আয়নাঘরে বন্দি আছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সুস্পষ্ট বক্তব্য চাই। সুস্পষ্ট বক্তব্য না পেলে সেই আয়নাঘর ঘেরাও করে বন্দিদের মুক্ত করতে হবে।

নিখোঁজ ঢাকা উত্তরের তেজগাঁও ৩৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, আমাদের দাবি যারা নিখোঁজ হয়েছেন তাদেরকে ফেরত দেয়া হউক। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। 

রেহেনা বানু মুন্নী বলেন, ২০১৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর মধ্য রাতে তুলে নেয়া হয়েছিল সরকারি সংস্থার পরিচয় দিয়ে। আমরা জিডি-মামলা করেছি। ডিবি, র‌্যাব, মানবাধিকার কমিশনসহ অনেক স্থানে গিয়েছি। আজকে পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাইনি। আমার ভাই যদি অপরাধ করে থাকে তবে তার বিচার করেন। 
নিখোঁজ মাসুমের মা আয়েশা আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের এতগুলো পরিবারের সদস্যকে গুম করে দিয়েছেন। আমাদের অপরাধ কী সেটা আমরা জানি না। আমরা যদি মিথ্যা বলতাম তবে বারবার মিডিয়ার সামনে আসতাম না। আমাদের কারও ভাই, কারও সন্তান, কারও বাবা নিখোঁজ হয়েছেন। আমরা এই গুমের বিচার চাই। আর এই অমানবিক নির্যাতন আর চাই না। সন্তানদের ফিরিয়ে দেন। 

২০১৩ সালের ১১ই ডিসেম্বরে গুমের শিকার রাজধানীর সূত্রাপুর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নি বলেন, আমি আমার ভাইকে ফেরত চাই। সে যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তবে তার বিচার করা হোক। কিন্তু তাকে গুম করে রাখার অধিকার এই রাষ্ট্রের নেই। সে অপরাধী হলে বিচার করুন, তবুও তাকে ফিরিয়ে দিন। 

ব্যারিস্টার আরমান হকের মা আয়েশা খাতুন বলেন, ২০১৬ সালের ৯ই আগস্ট রাতে রাজধানীর মিরপুরের ডিওএইচএসের একটি বাসা থেকে আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের কিছু লোক। প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যরা বাসায় আসেন। ফলে বাচ্চারা আর বাসায় ভয়ে থাকতে চায় না। তারা পড়াশোনা করতেও পারছে না। আরমানের দুই মেয়ে রাতে ঘুমালেও দুঃস্বপ্ন দেখে তাদের রাস্তায় ফেলে দেয়া হচ্ছে, ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং ওদের মারধর করা হচ্ছে। এই ধরনের সাইকোলজিক্যাল ট্রমার মধ্যে তারা আছে। পুলিশ এসে বারবার জানতে চায় আপনার ছেলে কোথায়। কিন্তু তাদের বারবার বলার চেষ্টা করি, আপনারাই তো খোঁজ দেবেন সে কোথায় আছে। 

গুমের শিকার কুষ্টিয়ার আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সাজ্জাদ হোসেনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া বলেন, আমার স্বামী ঢাকায় আজ থেকে সাত বছর আগে ১৫ই আগস্ট ফুল দিতে এসে গাজীপুরের একটি রিসোর্ট থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। তখন থেকে আর খোঁজ মেলেনি। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, তাকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দিন, আমরা তাকে ফিরে পেতে চাই।

মিরপুরের ইসমাইল হোসেন বাতেনের মেয়ে আনিসা হোসেন বলেন, আমার বাবাকে ২০১৯ সালের ১৯শে জুন মিরপুরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফেরার পথে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। আজ তিন বছর তিন মাস হলেও এখন পর্যন্ত আমার বাবার কোনো সন্ধান পাইনি। তাকে খুঁজে পেতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালায় থেকে শুরু করে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমরা আবেদন করিনি। র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ হওয়ায় পুলিশ কমিশনার আমাদের আবেদনটা পর্যন্ত পড়েননি। প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে প্রশ্ন, এই স্বাধীন বাংলাদেশে কী আমার বাবাকে খুঁজে পাবো না। যারা আমার বাবাকে তুলে নিলো তাদের বিচার কি হবে না?

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments