Thursday, April 18, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামরাজনৈতিক সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উন্নয়নের গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নিতে হবে

রাজনৈতিক সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উন্নয়নের গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নিতে হবে

বছরের শেষ প্রান্তে এসে দেশে অনাকাক্সিক্ষত নানা ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষত আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশি-বিদেশী কুশীলবদের নতুন মেরুকরণের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যাচ্ছে। একদিকে মাঠের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়ার উন্নততর চিকিৎসা নিয়ে রাজনৈতিক ব্লেইম গেম ও আইনগত কুটতর্ক যখন দেশে একটি চাপা রাজনৈতিক অসন্তোষকে বাড়িয়ে তুলছে, তখন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের রূপরেখা নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। বিগত দুইটি জাতীয় নির্বাচনের আগেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রয়োজনে জাতীয় সংলাপ ও সমঝোতার নানামুখী উদ্যোগ, প্রস্তাব ও চাপকে পাত্তা না দিয়ে এক তরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যে অটল ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি সকলের অংশগ্রহণে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলা হলেও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর তারা অনেকটাই চুপ মেরে গেছে। পশ্চিমা গণতন্ত্রপন্থীদের নিরবতার অন্যতম কারণ হতে পারে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে দেশে বিরোধি দলের জোরালো অবস্থান বা গণআন্দোলন না থাকা। তবে বছরের এ সময়ে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই নীরবতার পেছনে লুক্কায়িত অসন্তোষের বহি:প্রকাশ ঘটতে দেখা গেলো বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নানামাত্রিক টানপোড়েন থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো, অত:পর বাংলাদেশের অন্যতম চৌকষ ও এলিটফোর্স র‌্যাব ও পুলিশ প্রধানসহ, একজন সদ্য সাবেক সেনাপ্রধান এবং এসব বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা বাতিলের মত সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিনে জমে থাকা অসন্তোষ, একই সঙ্গে চীনের সাথে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ককে ঘিরে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রক্রিয়া বলে ধারণা করা যায়। রাজনৈতিক কারণে দেশে মানবাধিকারের লঙ্ঘণ হয়েছে এবং হচ্ছে তা নিয়ে যে প্রশ্ন রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি হঠাৎ করেই উত্থাপিত হয়নি, দীর্ঘদিন ধরেই তা নিয়ে সমালোচনা চলছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার বাইরে নয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ বা অসন্তোষ প্রকাশের ঘটনা বাংলাদেশে সম্ভবত এটাই প্রথম। আমরা সরকারের এমন অবস্থানকে সমর্থন করি। তবে র‌্যাব-পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন না করলেও দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও জোর দাবি জানাই।

দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চরম অবক্ষয়ের শিকার। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতার অকথ্য-অশালীন বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সমাজের সর্বস্তরে অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করেছে। ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের হাতে বুয়েটের নিরপরাধ শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকা-ের দুই বছরের মাথায় ২০ জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর ফাঁসি ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় ঘোষিত হওয়ার পর গত এক দশকের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন আরো অনেক হত্যাকা-ের ফিরিস্তি গণমাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে, যেসব হত্যাকা-ের বিচার হয়নি। দশক ধরে বিচার অমিমাংসিত থাকা, দুর্ধর্ষ হত্যাকারিরা পুলিশের চোখে পলাতক থাকলেও সমাজে জনপদে প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ানো, মৃত্যুদ-ের শাস্তি মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া, আইনের ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে অনেকে শাস্তি এড়াতে সক্ষম হলেও কেউ কেউ চুড়ান্তভাবে শাস্তি এড়াতে ব্যর্থ হয়ে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতায় মাফ পাওয়ার পর পুনরায় হত্যাকা-ে জড়িত হওয়ার মত ঘটনাও দেশে ঘটেছে। এসব ঘটনা জনমনে বিচারহীনতার সংস্কৃতির ধারনাকে পাকাপোক্ত করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীরা ২০১২ সালে প্রকাশ্য দিবালোকে, পুলিশের সামনে কুপিয়ে বিশ্বজিৎ দাসকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। দর্জি দোকানের শ্রমিক বিশ্বজিৎকে শিবির সন্দেহে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- প্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ২২ জন হলেও বেশিরভাগ এখনো পুলিশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। হাইকোর্টে কয়েকজনের মৃত্যুদ-সহ বেশিরভাগ আসামির সাজা বহাল থাকলেও গত ৭ বছরেও মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের রায় কার্যকর হয়নি। পলাতক আসামিদেরও ধরা হয়নি। ভিকটিমের পরিবার বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে শেষ বিচারকের কাছে ফরিয়াদ জানায়। বিশ্বজিতের মত আবরার ফাহাদকেও শিবির কর্মী সন্দেহে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহার কক্ষে ৬ ঘন্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। যদিও আবরার ফাহাদ শিবির কর্মী ছিল কিনা, তেমন কোনো তথ্য প্রমান খুঁেজ পাওয়া যায়নি। ছাত্রশিবির বা জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই গোপণে ছাত্রশিবির তার সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী যেমন সক্রিয় ছিল তেমনি সর্বদলীয় ছাত্র-ঐক্যের পাশাপাশি ছাত্রশিবিরকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। আবরার ফাহাদের শিবির সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া না গেলেও তার নামাজ পড়া এবং দেশের পক্ষে ভারতের সাথে ভারসাম্যহীন পানিচুক্তির বিরোধিতা করে ফেইজবুকে পোস্ট দেয়ার কারণেই বুয়েট ছাত্রলীগ ওকে শিবির বলে সন্দেহ করেছিল!

বিশেষ ধর্ম, বিশেষ দর্শন, ও বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে অতিরঞ্জিত প্রচারনা, ফোবিয়া এবং তা নির্মূল করার রাজনৈতিক এজেন্ডা সাধারণত বিপরীত ফল দেয়। গত হাজার বছরেও কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাসকে গায়ের জোরে দমিয়ে দেয়া যায়নি। পশ্চিমা বিশ্ব বিশাল ভূরাজনৈতিক এজেন্ডা সামনে রেখে ফিলিস্তিন থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করার পর ইসরাইলকে ক্রমাগত শক্তিশালী ও আগ্রাসী করে তোলার পরও ৭৩ বছরে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে দুর্বল করা যায়নি। উপরন্তু বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে গত একযুগে তিনবার ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে আইডিএফ পরাস্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। জায়নবাদিদের স্বার্থে ইরান, উত্তর কোরিয়ার সাথে মার্কিনীদের বৈরীতা শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কায়েমের দুই দশক পর সামরিক পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাথা নত করে মার্কিনীদের আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হয়েছে। এই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আমরা স্মরণ করি, আইয়ুব-ইয়াহিয়া খানদের সামরিক শক্তির ঔদ্ব্যত্ব বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে দমিয়ে দিতে পারেনি। শক্তি দিয়ে কোনো দেশাত্মবোধ ও আদর্শিক চেতনাকে দমন করা যায়না। ভারতে হাজার বছর ধরে মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ গরুর গোশত খাচ্ছে। এতে হিন্দুদের হিন্দুত্ব কখনো খর্ব হয়নি। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গো-মাংস রফতানিকারক দেশ, এতেও ভারতীয় হিন্দুদের কোনো মাথাব্যথা নেই। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ভারতের শাসন ক্ষমতায় আসার পর সে দেশের উগ্র হিন্দুরা গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে বেশ কিছু মুসলমানকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। যদিও গরুর গোশত খাওয়া ভারতীয় আইনে কোনো অপরাধ নয়, তথাপি গরুর গোশত খেয়েছে বা ফ্রিজে রেখেছে, এমন প্রচারনা চালিয়ে নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশে শিবির কর্মী সন্দেহে বিশ্বজিৎ দাস এবং আবরার ফাহাদের মত তরুণদের কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ নামধারি সন্ত্রাসীরা। আওয়ামী শাসনামলে দেশের সবচেয়ে পুরনো ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় একদল সন্ত্রাসী-ধর্ষক শুধু আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগেরই বদনাম করেনি, তারা দেশের ভাবমর্যাদাও ক্ষুন্ন করেছে এবং করছে। একেকটা হত্যাকা-ের পর অভিযুক্তদের দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও অঘটনের আগেই এদের প্রতি সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান থাকলে অনেক দুর্গতি ও দুর্নাম থেকে আমাদের দেশ ও সমাজ রক্ষা পেত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কিত বক্তব্য এবং একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে টেলিফোনে ধর্ষনের হুমকি ও আপত্তিকর বক্তব্যের জেরে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মুরাদ হাসান পদত্যাগ করে কানাডায় আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে ঢুকতে না পেরে দুবাইতে আশ্রয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নতমুখে দেশে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের একজন সংসদ সদস্য, কয়েকদিন আগেও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশন থেকে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জা ও অবমাননাকর।

গত একযুগে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশের বড় বড় রুই-কাতলারা নিজেদের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বউদের নামে বাড়ি, জমিজিরাত-এস্টেট কিনে কানাডায় বেগম পাড়া গড়ে তুলেছেন। কানাডা ছাড়াও আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সম্পদ পাচার করে সেকেন্ড হোম গড়ে তোলা ব্যক্তিরা এখন ডাক্তার মুরাদ হাসান ও জেনারেল আজিজের অবস্থা দেখে প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে অধরা রাঘব-বোয়ালরা বিদেশে সম্পদের পাহাড়ের মধ্যেও এমন নাজেহাল অবস্থায় পড়ায় মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। লুটপাট করা সম্পদ পরজগতে কোনো কাজে আসবে না। এটা ধর্মের সতর্ক বার্তা। তবে কখনো কখনো দুনিয়াতেও সম্পদ নিজের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় টাকার বস্তা লুকানোর ব্যর্থ প্রয়াসে ধরাপড়া অনেক নতমুখ এ দেশের মানুষ দেখেছে। অনেক দুর্দ- প্রতাপশালী স্বৈরাচারি শাসকের পতন বিশ্ববাসী দেখেছে। এসব শুধুই ব্যক্তি ও গোষ্ঠির পতন। তবে আদর্শিক রাজনৈতিক শক্তি উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মানে এগিয়ে চলে। সেসব উত্থান-পতনের ঘটনা ইতিহাসের অংশে পরিনত হয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা ও বির্বতনকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট থাকা। ‘পলিটিক্স ইজ আর্ট অব কনফাইন্ড কমপ্রোমাইজ’, সমঝোতা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা একেবারেই অচল। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর অন্ধ দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের নামে একপাক্ষিক পলিটিক্যাল ডগমা সব নাগরিকের উপর চাপিয়ে দেয়ার কারণে তিরিশের দশকে জার্মানির নাজি পার্টি ফ্যাসিবাদে পরিনত হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি বিরোধীদলের ভূমিকা সমান্তরালভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধ সমুন্নোত থাকলে সহিংস রাজনীতির কোনো স্থান থাকে না। একতরফা পক্ষপাতমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচনে বিজয়কে নিরঙ্কুশ করতে বিরোধীদল দমনের মত রাজনৈতিক-প্রশাসনিক তৎপরতা যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতের শামিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে দেশে ভয়ের সংস্কৃতি কায়েম করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবর্হিভুত হত্যাকা-ের মত অমানবিক কর্মকা-ে জড়িত হওয়ার অভিযোগগুলোকে পুঁজি করে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা আমাদের রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ গ্রহণ করছে। এসব অভিযোগ অমূলক নয়। গত এক দশকে শত শত মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। বিরোধীদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছেন। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এটা কাম্য নয়। আমরা জানি, গুম-খুনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশি হচ্ছে। তবে সেসব ঘটনার সাথে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন বা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানির অভিযোগ নেই। সেখানকার নির্বাচনেও ভিন্ন রকম অনিয়মের ঘটনা থাকলেও আমাদের দেশের মতো বিরোধীদলকে নানাভাবে দুর্বল করে , প্রার্থীতা থেকে বিরত রেখে বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের মত ঘটনা সেখানে কখনোই ঘটেনি।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পুলিশ ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, এসব ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বা আগামি নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন একটি আস্থাপূর্ণ নির্বাচন কমিশন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে, সব দলের অংশগ্রহণমূলক, দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করার মত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না। দশম ও একাদশ নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক পক্ষ ও দেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনকে ভারসাম্যপূর্ণ করার নানা প্রস্তাব দেয়া হলেও মূলত সরকারি দলের অনীহার কারণে তা সম্ভব হয়নি। আমাদের গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নিয়ে নিকটতম প্রতিবেশী ভারত বা চীনের কোনো মাথ্যাব্যথা নেই। শুধু বাণিজ্যিক সুবিধা ও কৌশলগত অংশিদারিত্বের বাইরে সবকিছু গোল্লায় গেলেও তাদের কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয়না। রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের বদলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রতি বার বার সমর্থন দেয়া থেকেই তা প্রমানিত হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্যও খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা একান্তই এ দেশের মানুষের জন্য খুব বেশি গুরুত্ববহ ও আকাক্সিক্ষত বিষয়। আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে দেশের সব রাজনৈতিক শক্তিকে জনগণের সেই প্রত্যাশিত গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও মানবাধিকারের দাবিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ চলবে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীন ইচ্ছা ও জনমতের প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে। কোনো আন্তর্জাতিক চাপে নয়, রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐক্যের মধ্য দিয়ে জনমতের সেই প্রতিফলনকে অবারিত করতে হবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments