Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব ও রাষ্ট্র মেরামতের প্রশ্ন

রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব ও রাষ্ট্র মেরামতের প্রশ্ন

জামালউদ্দিন বারী 

প্রতিটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ভৌগলিক সীমারেখা ও কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ দ্বারা সুরক্ষিত। তবে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে মানুষ। আব্রাহাম লিঙ্কনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় সবকিছুই মানুষের জন্য ও মানুষের দ্বারা সংঘটন প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করা হয়েছে। মানুষকে অমর্যাদা, অবমাননা, বঞ্চনা, বৈষম্য, অবক্ষয়, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা ও অমানবিকতার দিকে ঠেলে দিয়ে কোনো রাষ্ট্রের কাঙ্খিত বিকাশ ও সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। দেশের শাসকশ্রেণী জনগণের ট্যাক্সের টাকায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির পরিসংখ্যানের উপর ভর করে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে দাবি করেন, তা যদি মানুষের স্বস্তি, প্রত্যাশা ও নিরাপত্তাবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়ে বিপরীতমুখী প্রবণতার দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে রাষ্ট্র মেরামতের প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন কেউ কেউ রাষ্ট্র মেরামতের প্রয়োজনীয়তা ও তাদের অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরতে চাইছেন। এরাও শাসকশ্রেণীরই অংশ। স্বাধীনতার ৫১ বছরে এদেরও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশীদারিত্ব ছিল, এখনো আছে। যখন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত একটি সমাজ বিনির্মানে তাদের জোরালো ভ’মিকা গ্রহণের কথা ছিল, যে কারণেই হোক, তারা সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। গত দেড় দশক ধরে একটি রাজনৈতিক শক্তি দেশ পরিচালনা করছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এটি এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সময়।প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর স্বাভাবিকভাবেই বিরোধি রাজনৈতিক পক্ষের সংক্ষোভ কমিয়ে আনতে রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ ছিল অপরিহার্য্য। দেড় দশক ধরে দেশের নাগরিক সমাজ এবং পশ্চিমাবিশ্বের তরফ থেকে রাজনৈতিক সংলাপ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ণের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হলেও পুরো সময় জুড়ে এসব ক্ষেত্রে সরকারের আচরণ ছিল অস্বচ্ছ, বেপরোয়া-একগুঁয়েমিপূর্ণ। বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্ত রেমিটেন্স এবং তৈরীপোশাক খাতের কর্মসংস্থান রফতানির আয়ের পাশাপাশি কৃষিখাতের বিকাশের মধ্য দিয়ে আমাদের অর্থনীতি একটি সম্ভাবনাময় স্তরে উন্নীত হওয়ার সর্বাত্মক সম্ভাবনা থাকলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও আইনগত নিরপেক্ষতা বিনষ্টের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে তোলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সব প্রতিবেশিকে টেক্কা দিয়ে অর্থনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার দাবিদার দেশটির জনগণ এখন দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। করোনাত্তোর বৈশ্বিক মন্দা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের সর্বত্রই এক ধরণের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়ার বাস্তবতা অস্বীকার করা যায়না। পুরো উপমহাদেশের অন্য সব দেশের অর্থনীতিকে টেক্কা দিয়ে তর তর করে এগিয়ে যাওয়ার দাবিদার বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যখন গত বছরও কেউ কেউ শ্রীলঙ্কা সিন্ড্রোমের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তখনো কেউ কেউ সে সব আশঙ্কা তুড়ি মেরে উরিয়ে দিয়ে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কাছে ধরনা দিতে হবেনা বলেও ঔদ্ধত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। বিশেষত পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতেই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করেছেন। ইতিমধ্যে সে অবস্থা অনেকটাই পাল্টে গেছে। ইতিমধ্যে আইএমএফ’র কাছে চাওয়া সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ ব্যাংকিং সেক্টর ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথা বলেছে।

আইএমএফ’র ঋণ দেশের জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, আমদানি-রফতানি খাতের ব্যয় নির্বাহ এবং এলসি দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোর ডলারের সংকট নিরসনে কতটা ভ’মিকা রাখবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক যেমন দেশের অর্থনৈতিক খাতের শৃঙ্খলা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা বলেছে, একইভাবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতাদেশ, বাণিজ্যিক অংশীদার ও উন্নয়ন সহযোগীরা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে বিনষ্টের অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে একটি রাজনৈতিক সংলাপের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কার ও গ্রহনযোগ্য-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উপর জোর তাগিদ দিয়েছে। সে সব তাগিদ, আহŸান অগ্রাহ্য করার পাশাপাশি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি দমনে ডিসপ্রোপর্শনেটলি বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে একতরফা নির্বাচনের পথ বেছে নেয়া হয়েছে। বিদেশিদের স্বার্থে বা চাপে নয়, বাংলাদেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও জনগণের প্রত্যাশার কারণেই দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহনে সংস্কারের জন্য কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জোটসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অংশ্রগহণ করেনি। সে সময় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে সরকারের মধ্যেই এক ধরণের দুদোল্যমানতা দেখা গেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও শীঘ্রই রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে আরেক নির্বাচনের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনটিও অনুরূপ একদলীয় নির্বাচন ছিল। আওয়ামীলীগসহ বেশিরভাগ দল অংশগ্রহণ না করায় সে নির্বাচনটিও একটি বিতর্কিত নির্বাচন হলেও বিরোধি দলগুলোর দাবি বাস্তবায়নের জন্য তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি বাস্তবায়নের পর সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া তার প্রতিশ্রæতি রক্ষা করে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার পর নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন ৭ম জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে। জুনমাসে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে দুই জোটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে খুব ন্যারো মার্জিনের ব্যবধানে একুশ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ প্রথম ক্ষমতায় আসে। নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে। নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একই দলের বার বার তো নয়ই, দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসাই দুস্কর। বাংলাদেশে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্টভাবেই প্রমানিত হয়েছে।

দুর্ভিক্ষ, দুর্বৃত্তায়ণ, ভঙ্গুর-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় নিপতিত স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ পশ্চিমাদের প্রিডিকশনকে মিথ্যা প্রমানিত করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর কাতারে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে একাত্তুরে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। একইভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছে বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-উদ্যোক্তা জনগণ। প্রায় দেড়কোটি প্রবাসী, এককোটি গার্মেন্ট কর্মী ও কোটি কোটি কৃষকের শ্রমে-ঘামে এগিয়ে যাওয়া আমাদের রাষ্ট্রের তলানিতে যে ফুটো রয়েছে তা মেরামত না করার কারণেই কোটি কোটি মানুষের শ্রমে-ঘামে অর্জিত শত শত কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মত পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের অনুঘটক প্রতিষ্ঠানও বছরের পর বছর ধরে দেশের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিক সংস্কারের আহŸান জানিয়ে আসছে। এবার চরম অর্থনৈতিক সংকটের সময় সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে আইএমএফ’র ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা একটি আপাত স্বস্তিদায়ক ব্যাপার। তবে ঋণ পাওয়া শর্ত হিসেবে সে সব সংস্কারের বিষয়গুলোই প্রাধান্যে এসেছে। এসব সংস্কারের দাবি বাস্তবায়ন না হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো বড় সংকটের মুখে পড়বে এবং আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা পাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, আইএমএফ’র ঋণচুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের সাথে সংস্থার কর্মকর্তা পর্যায়ের প্রাথমিত সমঝোতা হলেও এর আনষ্ঠানিক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনো দুই ধাপ বাকি রয়েছে। জরুরি সহায়তা হিসেবে প্রথম সাড়ে চারশ মিলিয়ন ডলার আগামি বছরের ফেব্রæয়ারির মধ্যে ছাড় করার কথা থাকলেও আইএমএফ’র পক্ষ থেকে দেয়া চুড়ান্ত প্রস্তাব ও শর্ত বাংলাদেশ কিভাবে বাস্তবায়ন করবে তার বিবরণ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে জানানোর পর আইএমএফ সম্মত হলেই ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে ঋণের টাকা ছাড় করার আগে ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে। এর মানে হচ্ছে, ঋণের টাকা পেতে হলে বাংলাদেশকে আইএমএফ’র প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করতেই হবে। দেশের জন্য এ ধরণের বাস্তবতা সুখকর নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, বড় প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাধর রাঘব বোয়ালদের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাফ, লক্ষকোটি টাকা বিদেশে পাচারের সাথে রয়েছে রাজনৈতিক পক্ষপাত, দুর্বৃত্তায়ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থঋণ আদালত, আর্থিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশননের মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনগত স্বচ্ছতার মানদন্ডে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে কোনো সংস্কার প্রস্তাবই সামগ্রিক অর্থে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে এসেও জনগণের স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও নিরাপত্তা চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে সর্বগ্রাসি দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ। দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা প্রশাসন, প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আজ দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন অপরাজনীতি ও প্রতিহিংসার শিকার। দেশকে জনগণের কাঙ্খিত মানে উন্নীত করতে করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ণ করতে হলে প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গণকে জনগণের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও মননশীলতার অনুসঙ্গে ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের মেধাবি তরণরাও নিজের, বাবা-মা, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য এই সমাজ এবং রাষ্ট্র দায়ী। উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে, জাতির প্রয়োজনে নানা শ্রেণী পেশার দক্ষ কর্মী, গবেষক, উদ্ভাবক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, বিচারক, উদ্যোক্তা, আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী রাজনীতিবিদ ও আমলা-প্রশাসক গড়ে তোলা। দেশে এসব শ্রেণী-পেশার মানুষের অভাব নেই। সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রামে-গঞ্জেও বহুতল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বাজেট যেমন বাড়ছে, সেই সাথে জনগণকেও ক্রমবর্ধমান হারে শিক্ষাব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। এসব ব্যয় রাষ্ট্র ও সমাজের তেমন কোনো কাজে আসছে না। একদিকে শিক্ষা কারিক্যুলামকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপুযোগী করতে যেমন সরকার ব্যর্থ হয়েছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের একজন পেশাজীবী বা সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করার বিষম ফল ভোগ করছি আমরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে তার ধর্মীয় বিশ্বাস, নীতিবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনার জায়গা থেকে বিচ্যুত করার হীন প্রয়াসের কারণেই দেশের শিক্ষাঙ্গণগুলোর বেশিরভাগই অপরাজনীতি, সন্ত্রাস-টেন্ডারবাজি ও মাদকাসক্তের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশকে চরমভাবে কলুষিত করা হয়েছে।

উচ্চ শিক্ষাঙ্গণের শিক্ষকরা গবেষণা, সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতা বিকাশে নেতৃত্ব দেয়ার বদলে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতাসীন শাসকদের লেজুড়বৃত্তি ও বশংবদ হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে এশিয়ার ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও স্থান পায়না। এখানকার ভিসি শিক্ষা-গবেষণার ঘাটতির ব্যর্থতা ঢাকতে ১০ টাকায় চা, চপ, সিঙ্গারা-সমুচা খাওয়ার সুযোগকেই বড় করে দেখেন। সেখানে স্বাধীনচেতা, মননশীল ও সম্ভাবনাময় উচ্চাকাঙ্খি তরুণ-তরুনীদের সম্ভাবনা গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে। দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে শ্রেফ ফেইজবুকে দেশের পক্ষে ভারত বিরোধি পোষ্ট দেয়ার কারণে পিটিয়ে হত্যা করেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আবরার ফাহাদ হত্যার এখনো বিচার হয়নি। এ সপ্তাহে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র ফারদিন নুর পরশ নির্মম, দুখ:জনক অপমৃত্যুর শিকার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকান্ডের মোটিফ এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ। আপাত দৃষ্টে আবরার ফাহাদের মত ফারদিনের হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি দলীয় রাজনীতির সংশ্্রব যদি নাও থাকে। ফারদিনের হত্যাকান্ডের সাথেও চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রই বেরিয়ে আসে। দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম সারির মেধাবী একজন শিক্ষার্থী অপমৃত্যুর শিকার হওয়ার পর প্রাথমিক তদন্তে হত্যাকান্ডের সাথে মাদক ও নারীঘটিত বিষয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। আবরার, ফারদিনের মত তরুণরা অপমৃত্যুর শিকার হওয়ার পর গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়। দেশের লাখ লাখ তরুন-তরুনী উচ্চশিক্ষার সনদ নিয়ে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেলেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে প্রতিবেশি দেশের কর্মীরা নিয়োগ পেয়ে দেশ থেকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই পঞ্চাশ বছর পরেও আমাদের রাষ্ট্র সেই তলাবিহীন ঝুঁড়ির অপবাদকে ধারণ করছে। রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই রাষ্ট্রের মেরামত সম্ভব নয়।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments