Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামরাজনীতিতে 'মুখরা রমণী বশীকরণ'

রাজনীতিতে ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’

ড. মাহফুজ পারভেজ

সংসারে ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’-এর মন্ত্র শিখিয়ে গেছেন কালজয়ী সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। পারিবারিক আবহে রচিত শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত কমেডি ‘দ্য টেইমিং অব দ্য শ্রু’র  কাহিনিতে তা বর্ণিত হয়েছে, যা বাংলায় রূপান্তর করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী এবং তিনি নাটকটির বাংলা নাম দেন ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’। 

কিন্তু রাজনীতিতে  ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’-এর কলা-কৌশল সম্পর্কে কোনো পণ্ডিত কোনো তত্ত্ব দেন নি। তথাপি, রাজনৈতিক পরিসরে প্রায়ই ‘মুখরা’ চরিত্রের কেউ কেউ আবির্ভূত হন, যার বা যাদের বকবকানি বিতণ্ডা, বিরক্তি ও বিপদের কারণ হয়। ফলে সংসারে  ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’-এর মতোই রাজনীতিতেও  ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’-এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত কমেডির আখ্যান বা কাহিনী সম্পর্কে সকলেই কমবেশি অবগত। ভীষণ বদমেজাজী এক সুন্দরী তরুণী ক্যাথেরিনা মিনোলা গল্পের নায়িকা। সময়টা মধ্যযুগের ইতালি। ব্যস্ত শহর পাদুয়া। এই শহরের এক অভিজাত ধনী ব্যক্তি বাপতিস্তা। তার  ‍দুই মেয়ে ক্যাথেরিনা ও বিয়াংকা। রূপে দুজনেই অসামান্য।

বিয়াংকা বিনয়ী ও মিষ্টভাষী। কিন্তু ক্যাথেরিনা কর্কশভাষী, প্রচণ্ড ঝগড়ুটে ও মারকুটে। 

বিয়াংকাকে বিয়ে করতে অনেক তরুণ আগ্রহী। কিন্তু বাপতিস্তার সিদ্ধান্ত হলো আগে তিনি বড় মেয়ের বিয়ে দেবেন। ক্যাথেরিনার বিয়ের আগে বিয়াংকাকে কোনোভাবেই বিয়ে দেবেন না তিনি।

বিয়াংকার তিন পাণিপ্রার্থী লুসেনশিও, গ্রেমিও এবং হরটেনসিও তাই স্থির করে আগে তারা ক্যাথেরিনার জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করবে। এ সময়ে পাদুয়ার আসেন এক ধনী যুবক পেট্রুশিও। তিনি এসেছেন তার উপযুক্ত ধনী ও সুন্দরী কনের খোঁজে।

ক্যাথেরিনাকে বিয়ে করতে আগ্রহী হন পেট্রুশিও। তিনি বাপতিস্তার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান এবং ক্যাথেরিনাকে রাজি করাবেন বলে দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ক্যাথেরিনার সঙ্গে দেখা করে পেট্রুশিও তাকে আদর করে কেইট বলে ডাকেন। কেইটের গালাগাল ও কথার আঘাত হেসে উড়িয়ে দেন তিনি। বিয়েতে কেইটের আপত্তিকে কানেই তোলেন না চালাক পেট্রুশিও। স্থির হয়ে যায় তাদের বিয়ের দিন।

বিয়ের আসরে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে এসে হাজির হন পেট্রুশিও। তার ভয়ংকর মেজাজে পুরোহিতসহ অতিথিরা সবাই ভয়ে থমকে যায়। বদমেজাজী কেইটও ভয় পেয়ে যায়। হাস্যরসাত্বক বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে কেইটের সঙ্গে বিয়ে হয় পেট্রুশিওর। 

বিয়ের পরই কেইটকে নিজের শহরে নিয়ে যায় পেট্রুশিও। নিজের প্রাসাদে পৌঁছানোর পর কর্মচারীদের উপর ভীষণভাবে রাগারাগি করতে থাকেন তিনি। গৃহর্মীদের আনা কোনো খাবারই পছন্দ হয় না তার। কোনো পোশাক, কোনো খাবারই তার স্ত্রী মহামান্যা কেইটের উপযুক্ত নয় এই অভিযোগে সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে থাকেন তিনি। ফলে কেইটকে রীতিমতো না খেয়ে থাকতে হয়। কেইটকে ঘুমাতেও দেন না তার উগ্রমেজাজী স্বামী। কারণ বিছানায় পানি ঢেলে সেটি মহামান্য স্ত্রীর শোবার অনুপযুক্ত বলে ঘোষণা করেন তিনি । ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত কেইট নিজের স্বভাবসিদ্ধ ঝগড়া ভুলে পেট্রুশিওকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এইভাবে পেট্রুশিওর কথায় সায় দিতে এবং শান্তি রক্ষায় উদগ্রিব হয়ে বশীভূত হন ক্যাথেরিন।

রাজনীতিতে যদি এমন  ‘মুখরা রমণী’র দেখা পাওয়া যায়, তার ক্ষেত্রে করণীয় কি? কিভাবে তাকে নিবৃত্ত ও প্রশমিত করা সম্ভব হতে পারে? তাকে বশীকরণ করার মন্ত্র কেউ বাৎলে না দিলেও এহেন উপদ্রব থেকে পরিত্রাণের উপায় নিশ্চয় আছে। এসব চরিত্রকে কঠিন স্বামীর মতো শাসন করতে পারে জনগণ। অতীতে বাংলাদেশের  রাজনীতিতে এমন  ‘মুখরা’দের উপযুক্তভাবে শায়েস্তা করেছে খোদ জনগণ এবং ইতিহাস তাদের কথা ও কাজে জন্য চিরস্থায়ীভাবে নিন্দিত করেছে।
 

পাকিস্তানি আমলে স্বৈরশাসক জান্তার পদলেহী গভর্নর সব সময় ‘আমার প্রেসিডেন্ট’, ‘আমার প্রেসিডেন্ট’ বলতেন। বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্র সঙ্গীত বদলে ফেলতে চাইতেন। তার করুণ পরিণতি কেমন হয়েছিল, তা সবারই জানা আছে।

বাংলাদেশ আমলে এমন চরিত্র অনেক দেখা গিয়েছে এবং এখনো দেখা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সবচেয়ে বেশি কথা ও স্তাবকতা করা লোকগুলোই বঙ্গবন্ধুর রক্ত মারিয়ে মুশতাকের মন্ত্রিসভার সামনের কাতারে চলে গিয়েছিলেন। জিয়া সরকারের ‘মুখরা’গণ প্রায়-সবাই এরশাদ সরকারে যোগ দিয়েছিলেন। একজন সাংবাদিক কাম রাজনীতিবিদ তো ‘ঝাড়ুদার হওয়ার’ প্রকাশ্য ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিলেন।

খালেদা জিয়ার আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলানো দুইজনের ‘মুখরা’ চরিত্র জনগণের হাসির খোরাক হয়। হত্যা ও অপরাধের বিচারের দিকে না গিয়ে বড় মন্ত্রী বলেছিলেন ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়েছে’ আর ছোট মন্ত্রী বিকৃত বাংলা ও ইংরাজির মিশ্রণে দম্ভ করেছিলেন, ‘হোয়ার ইজ জঙ্গিজ?’

সেসব দিন চলে গেলেও তাদের এবং তাদের মতো অনেকের অতিরিক্ত কথা বলা এবং সরকার, প্রশাসন ও জনগণকে বিব্রত করার বিষয়গুলো এখনো আলোচিত হয়। বর্তমানেও সে অপধারা চলছে। বাংলাদেশের পক্ষে বা জাতীয় নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সমবেত হয়ে অনেকেই দেশবিরোধী ও নেতার প্রতি অপমানকর স্লোগান ও বক্তব্য দিয়ে ফেলেন। অতি উচ্চপদে আসীনদের এসব কথা ও উক্তি সামাজিক মাধ্যম ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ভাইরাল হয়।

রাজনীতিতে কথার কথা হিসাবে অনেক কথা বলা হলেও পররাষ্ট্র বা ডিপ্লোম্যাসির ক্ষেত্রে যারা কাজ করেন, তারা প্রচণ্ড সতর্ক ও সাবধান থাকেন। অত্যন্ত কম কথা বলেন। বোমা মারলেও তাদের মুখ থেকে কথা বের করা যায় না। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। সকাল-বিকাল কথার ফুলঝুরি ছুটছে। কোন কথার কি মর্ম ও প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটাও খেয়াল করা হচ্ছে না। এতে কার লাভ হচ্ছে, কে জানে! তবে সরকার থেকে জনগণ পর্যন্ত সবার যে ক্ষতি হচ্ছে, বিরক্তি উৎপন্ন হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।

পণ্ডিতরা বলেছেন, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও বিপ্লবে “শীর্ষে আসতে” হলে একটি দেশের জন্য প্রয়োজনীয় চারটি গোষ্ঠীর প্রয়োজন।  প্রথমত, দেশটিকে অনেক বেশি শীর্ষ বিজ্ঞানী তৈরি করতে হবে।  দ্বিতীয়, গবেষণা এবং উচ্চ শ্রেণীর নকশা সমর্থন ও প্রণয়ন করার জন্য প্রশিক্ষিত একটি জনগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে।  তৃতীয়, শিক্ষিত সহায়ক প্রযুক্তিবিদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। চতুর্থ এবং শেষ, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকদের এমন বানাতে হবে, যারা বিজ্ঞানীরা কী বলছেন তা বোঝার এবং বাস্তবায়ন করার দক্ষতা ও যোগ্যতা রাখেন। আমরা এই চার শ্রেণীর মানুষ বানাতে না পারলেও সর্বস্তরে ব্যাঙের ছাতার মতো বাক্যবাগীশ ও মুখরা উৎপন্ন করেছি।

আমরা একটি জরুরি নৈতিক শিক্ষাও ভুলতে চলেছি। ‘কথা তথা জিহ্বাকে’ আত্ম-শাসনে রাখার নির্দেশ ছেলেবেলা থেকে দেওয়া হলেও কেউ সেটা মানার প্রয়োজন বোধ করছে না। অথচ,  কথা বলার মাধ্যম জিহ্বা মানবদেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর দ্বারা আমরা খাবারের স্বাদ গ্রহণ এবং মনের ভাব প্রকাশ করি। জিহ্বা ছোট একটি মাংসপিণ্ড হলেও এটি আল্লাহ তায়ালার বড় নেয়ামত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি কি তার জন্য দুটি চোখ বানাইনি? আর একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট।’ (সুরা বালাদ, আয়াত: ৮-৯)। 

মূলত, জিহ্বা হলো অন্তরের মুখপাত্র ও প্রতিনিধি। আর বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ জিহ্বার নিকট দায়বদ্ধ। এটি মানুষকে ধ্বংসের অতলেও ডুবাতে পারে। আবার সাফল্যের শীর্ষেও সমাসীন করতে পারে। বলা হয়, জিহ্বা অধিকাংশ অনিষ্টের মূল। অধিকাংশ পাপ ও পুণ্যের কাজ জিহ্বার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। তাই জিহ্বাকে সংযত রাখা আবশ্যক। 

এ প্রসঙ্গে হজরত সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি এক দিন রাসুলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! যে জিনিসগুলো আপনি আমার জন্য ভয়ের বস্তু বলে মনে করেন; তার মধ্যে অধিক ভয়ঙ্কর কোন জিনিস? হজরত সুফিয়ান (রা.) বলেন, এটা শুনে রাসুল (সা.) নিজের জিহ্বা ধরে বললেন, এটা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫৬৬)

বুদ্ধিমান ও নির্বোধের মাপকাঠি হলো জিহ্বা। জিহ্বার দ্বারা একজন মানুষ যেমন সম্মানিত হয়, তেমনি অপদস্থও হয়। আর জিহ্বার অপব্যবহারের কারণে অনেক মানুষ দুনিয়ায় বিপদে পড়বে ও আখেরাতে জাহান্নামে যাবে। এসব সদুপদেশ সাধারণ মানুষের মতো রাজনীতির  ‘মুখরা’গণও যদি মনে রাখেন, তাহলে সবার জন্যেই কল্যাণ।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments