অনেক বামপন্থী লেখক-ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের কথা লিখতে গিয়ে এটাই বোঝাতে চান যে মুক্তিযুদ্ধটা ছিল অনেকটা ধর্মহীনতার সংগ্রাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলার সংগ্রামের কর্মকাণ্ড তা নাকচ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা সব সময় ছিলেন পরমভাবে ধর্মনির্ভর। ঢাকার প্রথমা প্রকাশন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গেরিলা-মুক্তিযোদ্ধাদের কতগুলো চিঠি একাত্তরের চিঠি শিরোনামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা সবাই আল্লাহনির্ভরতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এতে তাদের ধর্মপ্রাণতার প্রমাণ মেলে। ধর্মহীনতা প্রকাশিত হয়েছে—এমন কোনো মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি, উদ্বিগ্ন মাতা-পিতা, ভাই-বোনদের চিঠি পাওয়া যায় না। ‘একাত্তরের চিঠি’ গ্রন্থের কয়েকটি চিঠির ভাষা এ প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে :
১. আপনাদের দোয়ার জোরে হয়তো মরব না। কিন্তু মরলে গৌরবের মৃত্যুই হতো।… আব্বাকে সালাম। [পৃষ্ঠা ১৩]।
২. দোয়া করবে মা, আমার আশা যেন পূর্ণ হয়। [পৃষ্ঠা ১৪]।
৩. পর সংবাদ, আমি আপনাদের দোয়ায় এখনো পর্যন্ত ভালো আছি। [পৃষ্ঠা ১৫]।
৪. তবু খোদা ভরসা করে বেঁচে আছি। [পৃষ্ঠা ১৭]।
৫. চিন্তা করো না, আমি ইনশাআল্লা বেঁচে আসব। [পৃষ্ঠা ১৮]।
৬. পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে দোয়া করি, তোমার সন্তানরা যেন বর্বর পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীকে কতল করে এ দেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে পাবে।… ইনশাআল্লাহ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। [পৃষ্ঠা ১৯]।
৭. আশা করি, খোদার রহমতে কুশলে আছেন। [পৃষ্ঠা ২০]।
৮. সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট সব সময় দোয়া করবেন, আমি যেন গাজী হয়ে ফিরতে পারি।… আম্মাজানকে আমার কদমবুসি দেবেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলবেন। [পৃষ্ঠা ২২]।
৯. আল্লাহর হাতে সঁপিয়া দিয়া…কচুয়ার পথে রওয়ানা হই। [পৃষ্ঠা ২৪]।
১০. আমি আল্লাহর রহমতে ও আপনাদের দোয়ায় বাংলাদেশের যেকোনো এক স্থানে আছি। [পৃষ্ঠা ২৯]।
১১. জন্ম ও মৃত্যু মানুষের হাতে নয়, এটা পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার হাতে। তার নির্দেশ ব্যতীত দুনিয়ার কোনো কাজ হতে পারে না। একটা পা তুললে সে (মানে করুণাময় আল্লাহ) যতক্ষণ পর্যন্ত পা ফেলার হুকুম না দেবে ততক্ষণ কারোর ক্ষমতা নেই পা ফেলি। [পৃষ্ঠা ৩০]।
১২. আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, যেন আপনার ছেলে এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে গাজী হতে পারে। [পৃষ্ঠা ৩৮]।
১৩. তুমি যখন ইনশাআল্লাহ পড়তে শিখবে, বুঝতে শিখবে, তখনকার জন্য আজকের এই চিঠি লিখছি। [পৃষ্ঠা ৩৯]।
১৪. আম্মু (কন্যাকে সম্বোধন—লেখক), নামাজ পড়ে প্রত্যেক ওয়াক্তে তোমার জন্য দোয়া করি। আল্লাহ রহমানুর রাহিমের কাছে মোনাজাত করি তিনি যেন তোমার আম্মুকে আর তোমাকে সুস্থ রাখেন, বিপদমুক্ত রাখেন। [পৃষ্ঠা ৩৯]।
১৫. ইনশাআল্লাহ সেই দিন বেশি দূরে নয় আব্বু আবার তোমাকে জয়বাংলা গেয়ে শোনাবে। [পৃষ্ঠা ৪০]
১৬. নামাজে পড়ে আমার জন্য দোয়া করবেন।…খোদায় যদি বাঁচায়, তবে আমি কয়েক দিনের ভেতর ফিরে আসব। ইনশাআল্লাহ খোদা আমাদের সহায় আছেন। [পৃষ্ঠা ৪৪]।
১৭. ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের হইবে, দুনিয়া হইতে লাখ লাখ লোক চলিয়া গেছে খোদার কাছে। কামনা করি যেন সব শহীদদের কাতারে শামিল হইতে পারি। [পৃষ্ঠা ৪৭]।
১৮. খোকনকে বলো ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাত্রে আমরা সেই Operationটা করব। [পৃষ্ঠা ৪৮]।
১৯. আশা করি খোদার কৃপায় ভালোই আছেন। [পৃষ্ঠা ৫০]
২০. আল্লাহর রহমত ছাড়া কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের গোয়ালগাঁ যুদ্ধ থেকে কোনোভাবেই বাঁচতে পারতাম না। [পৃষ্ঠা ৫৪]।
২১. আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেন পরাজয়বরণ করে। [পৃষ্ঠা ৫৯]
২২. কালকে সকালে ইনশাআল্লাহ সবাইকে ফেরত পাবে। [পৃষ্ঠা ৬২]
২৩. আমার জন্য এবং দেশের জন্য দোয়া করবেন।…আপনাদের দোয়াই আমাদের সকলের পাথেয়। [পৃষ্ঠা ৬৭]।
২৪. সুবেহ সাদেকের সময় আজানের ধ্বনি শুনে মনে হয় বাংলাদেশেরই (তথাকথিত পূর্ব পাক) কোনো স্থানে শুয়ে আছি। [পৃষ্ঠা ৬৯]।
২৫. আজান শেষ হওয়ার পর ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টরের বাঁশির ধ্বনি ও মধুর ডাক ‘উঠুন’, ‘উঠুন’ বড়ই ভালো লাগে। [পৃষ্ঠা ৬৯]।
২৬. আল্লাহর কাছে দোয়া করি, দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসো সুস্থ দেহে। [পৃষ্ঠা ৭২]।
২৭. খোদা তোমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে রাখুন। এই দোয়াই করি। [পৃষ্ঠা ৭৮]।
২৮. রাজাকারদের মধ্যে আল-বদর বর্তমানে Active খুব। তারাবির নামাজের উপর গুলি, ২৫শে রমজান আট রাকাতের সেজদায় মানিকচক ও নবীনগর, ১২ রাকাতের সময় জামালকলি, পারুলিয়া মসজিদে। [পৃষ্ঠা ৮০]।
২৯. রহনপুরে ইফতার করার জন্য বসে থাকা মুসুল্লিদের ওপর গুলি চলেছে। মোমতাজ, আলী বাদে ১৮ জন শহীদ হয়েছেন। [পৃষ্ঠা ৮০]।
৩০. ঈদের দিন পাড়ার মসজিদে নামাজ হয়েছে। ঈদগাহের নামাজিরা পালিয়ে এসেছে মিলিটারি ঘেরাও হবার আগে। [পৃষ্ঠা ৮০]।
৩১. নওগাঁয় নামাজ হয়নি। ঢাকা-রাজশাহী বিচ্ছিন্ন। [পৃষ্ঠা ৮০]।
৩২. রাজ ইলু-আব্বাসী, তোরা আল্লাহর কাছে কাঁদ। যেন বেঁচে থাকি দোয়া কর। [পৃষ্ঠা ৮০]।
৩৩. আল্লাহর ওপর ভরসা করে দিন কাটাতে লাগলাম। [পৃষ্ঠা ৮২]।
৩৪. আপনি আমাদের জন্য দোয়া করেন, যেন আমরা আল্লাহর রহমতে কোনোরকমে জানে বাঁচতে পারি। [পৃষ্ঠা ৮২]।
৩৫. আপনাকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছি। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী হয়ে ফিরে আসবেন। [পৃষ্ঠা ৮২]।
৩৬. …৫-৬ ঘণ্টা ফাইট হয়। ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হইয়াছে, ১৭ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হইয়াছে। [পৃষ্ঠা ৮৪]।
৩৭. খোদার ফজলে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। [পৃষ্ঠা ৮৯]।
৩৮. আম্মা, সালাম নিবেন। আমরা জেলে আছি। জানি না কবে ছুটব।… দোয়া করবেন।… ইদ মোবারক। [পৃষ্ঠা ৯২]।
৩৯. আশা করি আল্লাহ তাআলার অসীম রহমতে ভালো আছেন।… আল্লাহ আপনাদের সকলের মঙ্গল করুক। [পৃষ্ঠা ৯৪]।
৪০. দেশ কবে স্বাধীন হবে জানি না। আমাদের আর দেখা হবে কিনা আল্লাহ জানেন। [পৃষ্ঠা ১০২]।
৪১. আল্লাহ ও আপনাদের দোয়ায় এখনো জীবিত আছি। [পৃষ্ঠা ১১১]।
৪২. আর তুমি আমাকে দোয়া করো আল্লাহ যেন আমাকে তোমার আদেশ মাথা পেতে নেওয়ার ক্ষমতা দেন। [পৃষ্ঠা ১১৫]।
৪৩. আয় খোদা, আমার স্বামীর আশা আকাঙ্ক্ষা তুমি ধুলিসাৎ করে দিয়ো না। তার জান-ছালামত নিরাপদে রেখো। [পৃষ্ঠা ১১৫]।
৪৪. খোদা তোমার নিকট সঁপে দিলাম। তুমি হেফাজতে রেখো। [পৃষ্ঠা ১১৫]।
৪৫. ঈদে তোমাদিগকে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করি। বাকি খোদার মর্জি। [পৃষ্ঠা ১১৭]।
৪৬. সব কিছুর আশা ছাড়িয়া দিতে বলিও। সময় সুযোগ থাকিলে সব কিছু হইবে বলিয়া আশা রাখি। মানুষের রিজিক আল্লাহর হাতে। [পৃষ্ঠা ১১৭]।
৪৭. প্রথমে আমার সালাম জানাই। আশা করি খোদার ফজলে ভালোই আছেন। [পৃষ্ঠা ১১৯]।
৪৮. আল্লাহ না করুক, আমার বোনগুলোর বিয়ে এবং ছোট ২টি ভাইকে মানুষ হওয়ার ব্যবস্থা যেন থাকে। [পৃষ্ঠা ১২১]
(সূত্র : একাত্তরের চিঠি (সম্পাদক সালাউদ্দীন আহমদ প্রমুখ) প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ৩২তম মুদ্রণ, ২০১৮, পৃষ্ঠা ১৩-১২৭)