অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দেওয়া হলেও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে তা ধরে রাখা যায়নি। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। বস্তুত এ প্রেক্ষাপটে অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এটি ‘পয়েন্ট টু পয়েন্ট’ ভিত্তিতে আগের বছরের একই মাসে ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭০।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তা সমন্বয় করতে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে পণ্য ও সেবা খাতের ব্যয় বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতির হারে উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে জনজীবনে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার চিত্রটি এ রকম : চাল ৭৯ শতাংশ, খোলা আটা ২৪ দশমিক ১৪, খোলা ময়দা ৩৭ দশমিক ৬৮, সয়াবিন ২৮ দশমিক ১১, পাম অয়েল ৩৮ শতাংশ এবং মসুর ডাল ৩৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। নিত্যপণ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রভাব নিম্নআয়ের মানুষকে চরম দুর্দশায় ফেলেছে। এমনিতেই করোনার কশাঘাতে চাকরিহারা, বেকার ও আয়-রোজগার কমে যাওয়া জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন খরচের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন, তার ওপর মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছে অনেক পরিবার। এ অবস্থায় যে কোনো উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়াস চালাতে হবে। তা না হলে মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি ও রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যার পরিণতি শুভ হবে না।
অবশ্য এ সত্য এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, মূল্যস্ফীতি বর্তমানে সারাবিশ্বেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৪৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। অন্যদিকে ১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে কানাডায়। এছাড়া জার্মানির মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ২৯ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বস্তুত করোনা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসার পর বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সবকিছুর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। দেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আছে, এমনটি দেখানোর চেষ্টা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংক্রান্ত সরকারি তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, মূল্যস্ফীতি বাড়লে ধনী আরও ধনী হবে। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে বেশকিছু নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে; যেমন ব্যাংকের সঞ্চয় সুদহার ৬ থেকে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। এটি ঘটলে শিল্প ঋণের সুদ হার ডাবল ডিজিটে চলে যাবে। তখন শিল্প খাত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে, যা মোটেই কাম্য নয়। এ অবস্থায় সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে যাতে বিপর্যয় নেমে না আসে, সেজন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরও মনোযোগী হওয়া দরকার।