পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলাম এমন অনন্য এক ধর্ম, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘ইকরা’ বা পড়ো বাক্যের মাধ্যমে। ফলে জ্ঞানচর্চা মুসলিম সমাজের পরিচয় নির্ধারক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।
বইপাঠে উৎসাহ
পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহে মুমিনদের নানাভাবে জ্ঞানার্জন তথা বই পাঠে উৎসাহিত করেছে। যেমন—
১. প্রথম নির্দেশ পড়ো : পবিত্র কোরআনের প্রথম নির্দেশ ছিল ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।
(সুরা আলাক, আয়াত : ১)
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, এই আয়াতের মাধ্যমে ওহি নাজিলের সূচনা হওয়া তাৎপর্যপূর্ণ। এই আয়াত স্পষ্টত ইঙ্গিত দেয় যে মুসলমানের জীবন ও সমাজ হবে জ্ঞানভিত্তিক। জ্ঞান সংগ্রহ, জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সংরক্ষণ (বই লেখা বা অন্য মাধ্যমে) ও জ্ঞান বিতরণ হবে তার বৈশিষ্ট্য এবং পাঠে অভ্যস্ত হবে।
২. জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিম নর-নারীর জন্য ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। ’ (সহিহ মুসলিম)
উল্লিখিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞানার্জনকে মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ ঘোষণা করেছেন। আর জ্ঞানার্জনের একটি সার্বজনীন মাধ্যম বই পড়া। সুতরাং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনার্থেই মুসলিমদের বই পড়তে হয়।
বইপাঠের ঐতিহ্য
১. বই মুসলমানের সঙ্গী : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় থেকেই সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর মধ্যে বই পাঠের অভ্যাস ও ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। যেমন আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বইকে সঙ্গী করে নেয়, সে কখনো মনের প্রশান্তি হারাবে না। ’ (গুরারুল হুকুম, পৃষ্ঠা ৬৩৬)
২. বই আদান-প্রদান : মুসলমান শুধু নিজে পড়ে না; বরং অন্যকেও সে বই পড়তে উৎসাহিত করে। প্রয়োজনে নিজের বইটিও তাঁকে পড়তে দেয়। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘জ্ঞান জ্ঞানীকে জ্ঞান বিতরণ (বই প্রদান) থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি অন্যের বই ধার নেয় তার দায়িত্ব হলো বইদাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করা এবং তাকে উত্তম প্রতিদান দেওয়া। যদিও তা দোয়ার মাধ্যমে হয়। ’ (ফাওয়াইদুল মাক্কিয়া, পৃষ্ঠা ৪৪)
৩. নিমগ্ন পাঠ : ইসলামের ইতিহাসের স্মরণীয় মনীষীরা জীবনের বেশির ভাগ সময় বই পাঠে নিমগ্ন থাকতেন। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) লেখেন, ‘প্রাচীন যুগের শিক্ষকরা জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন থাকতেন। পঠন ও পাঠদান ছিল তারে আত্মার খোরাক এবং তা পরিণত হয়েছিল তাদের ইবাদত ও তপস্যায়। তারা জীবনের দীর্ঘ সময়, দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় এটা নিয়েই পড়ে থাকতেন। ’ (ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে মুসলিম অবদান, পৃষ্ঠা ১২২)
৪. পাঠাগার প্রতিষ্ঠা : বইপাঠে মুসলিম সমাজ অভ্যস্ত হওয়ায় যেখানেই তারা গেছে সেখানেই পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলিম শাসক, রাজন্যবর্গ ও আলেমরা বড় বড় গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন। মুসলিম শাসনাধীন অঞ্চলগুলোর মধ্যে ভারত, স্পেন, মধ্য এশিয়া, আরব উপদ্বীপের দেশগুলো পর্যন্ত সর্বত্রই অসংখ্য অগণিত পাঠাগার মুসলিমরা প্রতিষ্ঠা করেছে।
৫. বই ওয়াকফ করা : পাঠাগার ইসলামী সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। জনকল্যাণে মুসলিম সমাজে বই ওয়াকফ করার প্রচলন আছে প্রাচীনকাল থেকে। আল্লামা আশরাফ আলী থানবি (রহ.) মাদরাসা তথা দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় বইপুস্তক ওয়াকফ করাকে উত্তম দান বা সদকা বলেছেন। কেননা এর দ্বারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এর দ্বারা উপকৃত হলে তা সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য হবে। (আল-ইলমু ওয়াল উলামা, পৃষ্ঠা ৫৪)