Tuesday, April 23, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামমুদ্রানীতির ফল ঘরে তুলতে নজরদারি বাড়াতে হবে

মুদ্রানীতির ফল ঘরে তুলতে নজরদারি বাড়াতে হবে

আমরা লক্ষ করছি যে কভিড-উত্তর এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে যেমন পড়েছে, তেমনি পড়েছে অন্যান্য দেশেও। আমাদের দেশে যে প্রভাব পড়েছে, আমরা লক্ষ করি, তার মধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জ তো আমাদের আগে থেকেই ছিল। সেটা আমাদের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। যেমন—ব্যাংকিং ব্যবস্থা, মুদ্রাপাচার, দুর্নীতি, প্রবৃদ্ধির মন্থরগতি, রপ্তানি আয়ের মন্থরগতি। এর সঙ্গে বাইরের কিছু চ্যালেঞ্জ এসেছে। যেমন—জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এগুলোর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। আরেকটা হলো, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে, বিশেষ করে ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন এবং রিজার্ভ কমে যাওয়া।

এই তিনটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এগুলো এখনো আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এখনো সুস্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছি না। অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে এক-দুই মাসের মধ্যে সব সমস্যা চলে যাবে।

অন্যান্য দেশ কিন্তু ধীরগতিতে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করছে। বাংলাদেশে সরকারের যে বিভিন্ন সংস্থা আছে বা সরকারের বিভিন্ন প্রজেক্ট আছে, সেগুলো যে বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটা কিন্তু লক্ষ করছি না। অবশ্য এটা মানতে হবে, আগামী বছর নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে জন্য সরকারি দল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তৎপর।

কিন্তু অর্থনৈতিক দিকটা যদি না দেখা হয়, সেটা কিন্তু ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক যেকোনো সরকারের জন্য খুব সমস্যা হয়ে যাবে। মানে সমস্যাসংকুল একটা আর্থিক অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা যেকোনো সরকারের জন্য ভবিষ্যতে কঠিন হবে। নতুন সরকারের জন্য সমস্যা হবে। অতএব অর্থনীতিটাকে একটা মোটামুটি চাঙ্গাভাব, মোটামুটি একটা শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে পারলে সবার জন্য মঙ্গল হবে, বিশেষ করে জনসাধারণের জন্য।

এ জন্য অতিদ্রুত তৎপর হতে হবে। তৎপর পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন সবচেয়ে বড় সমস্যা। বাস্তবায়ন করতে হবে।

কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। মুদ্রানীতিতে কতগুলো ইতিবাচক দিক আছে, সেটা বলে নিই। প্রথমত, আগে এক বছরের জন্য মুদ্রানীতি নির্ধারণ করা হতো, এখন ছয় মাসের জন্য করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা অনুধাবন করেছে যে ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি করা ভালো। কোনো দেশে তিন মাসের জন্যও মুদ্রানীতি করা হয়। যা হোক, এটা একটা ইতিবাচক দিক যে তাদের মূল ফোকাস মূল্যবৃদ্ধি একটু হলেও রোধ করা। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যবসাটাও যাতে চাঙ্গা হয় তার জন্য কিছু চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। সংক্ষেপে এটাই হচ্ছে মুদ্রানীতির বড় একটা লক্ষ্য। বরাবরের মতোই তারা বলছে, এটা সতর্কতামূলক ও সহায়ক মুদ্রানীতি। মানে, সতর্ক পদক্ষেপ এবং যেটা সহায়কও হবে। এতে তারা কিছু পলিসি রেট বাড়িয়েছে। কনজিউমার ডিপোজিট ছিল ৬ শতাংশ। সেটা উঠিয়ে দিয়েছে। এটা মোটামুটি ইতিবাচক। তার পরে সুদের হার ভোক্তাঋণের সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ করেছে। আগে তো সব সুদের হারই ৯ শতাংশ ছিল। এখন অন্যান্য খাতে ল্যান্ডিং রেটটা, সেটা কিন্তু ৯ শতাংশ রয়ে গেছে। সেটাকে আর বাড়ানো হয়নি, যদিও ডিপোজিট রেট বাড়িয়েছে। ৬ শতাংশের ওপরে যেতে পারে, কিন্তু ৯ শতাংশের ওপরে যেতে পারে না। শুধু ক্রেডিট কার্ডের ওপর কোনো কিছু নেই। এটাকেই ব্যবহার করছে তারা। ব্যাংক তাদের সুবিধামতো চার্জ করবে।

অতএব এগুলো আর ব্রড মানে গ্রোথ কিছুটা বাড়িয়েছে, ব্রড মানে ব্যাপক মুদ্রা বাড়ুক, সমস্যা নেই। ডিসেম্বরে ৮.৪ শতাংশ ছিল। অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৮.২ শতাংশ হবে, সেটা ডিসেম্বরে ১৫.১০ শতাংশ ছিল। এক্সপোর্ট গ্রোথ ১০ শতাংশ দেখিয়েছে। আর রেমিট্যান্স গ্রোথ ৪ শতাংশ হবে। আমদানি ৯ শতাংশ কমে যাবে। নেগেটিভ হবে আর কি। আর প্রাইভেট সেক্টরে ক্রেডিট বাড়বে। সেটা ১৪.১০ শতাংশ আগেই ঘোষণা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি সরকারের দেওয়া ঋণ বাড়বে ৩৬ শতাংশ, যেটা ডিসেম্বরে ২৬.৬ শতাংশ ছিল।

এখন আমরা যদি দেখি, মনে হচ্ছে যে এখানে সরকারি ঋণ বাড়বে। সরকার এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি ট্রেজারি বিল ইস্যু করে সরকারকে টাকার জোগান দেবে। বাইরের ব্যাংকাররা হয়তো ট্রেজারি বিল কিনবেন না, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা নিয়ে নেবে অর্থাৎ ডেভেলপ করবে।

এসব পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতির যে চ্যালেঞ্জটা, সেটা কিন্তু তেমন কমবে না। মূল্যস্ফীতির মূল চ্যালেঞ্জটা বাংলাদেশকে লক্ষ রাখতে হবে। ডিমান্ড কমিয়ে দিয়ে বা ভোক্তা ক্রেডিট বাড়িয়ে দিয়ে চাহিদা কমানো যাবে না। আর ভোক্তা ক্রেডিট কিন্তু মোট ঋণের ৯ শতাংশের বেশি না। অতএব এখানে রেট অব ইন্টারেস্ট যতই বাড়ানো হোক, মূল্যস্ফীতির ওপর তার প্রভাব পড়বে না। আর বিশেষ কিছু লোক তো বাধ্য হয়ে ভোক্তা ঋণ গ্রহণ করছে।

রপ্তানির ব্যাপারে যদি বলি, রপ্তানি বাড়ানো ও বহুমুখীকরণের বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে কিন্তু কিছুই নেই এখানে। আপনি আমদানি করেছেন কম। কিন্তু আমদানি কমানোই যথেষ্ট নয়। একেবারে শূন্যে নিয়ে যেতে পারবেন না। কারণ আপনার কাঁচামাল আসতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেটের ব্যাপারে তেমন লক্ষণীয় কিছু দেখিনি। বলছে যে মাল্টিপল এক্সচেঞ্জ রেট আছে অনেক। বাজারভিত্তিক হবে আস্তে আস্তে। চেষ্টা করবে যে জুনের শেষের দিকে এটা বাজারভিত্তিক ও ফ্লেক্সিবল হয় এবং এক্সচেঞ্জ রেটগুলোর মধ্যে ২ শতাংশের বেশি যেন তারতম্য না হয়।

সরকারের জন্য ঋণটা বাড়বে ৩৬ শতাংশ, বেশির ভাগ কিন্তু খরচ হবে সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক খাতে এবং মেগাপ্রজেক্ট খাতে ব্যয় হতে পারে। সেটা সেখান থেকে উৎপাদিত পণ্য বাজারে আসবে না। সেটা বরং বাজারে মুদ্রা ক্রিয়েট করবে, মানে মুদ্রা সরবরাহটা বাড়িয়ে দেবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েও যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনরর্থায়নে ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়া মানে আমরা বুঝি রিজার্ভ মানি। রিজার্ভ মানি মানে হাই পাওয়ারড মানি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যদি ১০ টাকা ইস্যু করা হয়, সেটা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে তিন-চার গুণ হয়ে যায়। তাহলে আমরা যেটা বাজারে দেখি যে রিজার্ভ মানি বা যেটা হাই পাওয়ারড মানি, যেটা আমাদের টাকা পকেটে থাকে বা যেটা বাড়িতে থাকে। এক লাখ টাকা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়ে বাজারে, সেটা তিন-চার লাখ টাকা হয়ে যায় ব্রড মানির মাধ্যমে। অতএব এই টাকাটা বেড়ে যাওয়া মানে হলো, তা মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে যে এটা সতর্কতামূলক ও সহায়ক। কিন্তু সতর্কতাটা কী? সহায়কই বা কিসের? প্রবৃদ্ধি বাড়বে কি? রপ্তানি, রেমিট্যান্স বাড়বে কি? অন্যগুলোর কী ব্যাপার? কৃষি খাতের কি সহায়তা বাড়ানো হলো? বেশির ভাগ ছোট-মাঝারি শিল্পে যে ঋণ যাবে, সেটা তো খুব বেশি মনে হয় না। ব্যাংকাররা তো ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য পুনরর্থায়নে ঋণ দেওয়ার বিশেষ আগ্রহ দেখাবেন না। অতএব সতর্কতামূলক সহায়ক না এটা, বরং একেবারে সাদামাটা একটা গতানুগাতিক মুদ্রানীতি হয়েছে। এটা বরং বলা যেতে পারে, একটা রুটিনমাফিক হয়েছে। এখন দরকার প্রো-অ্যাকটিভ মুদ্রানীতি। গতানুগতির বাইরে মুদ্রানীতি দরকার ছিল। আর সরকার রাজস্বনীতিটা যদি সেভাবে প্রো-অ্যাকটিভ এবং বাস্তবতাভিত্তিক করে; সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত করে; তাহলে কিন্তু অর্থনীতিটা ঘুরে দাঁড়াবে। অন্যথায় একটু কঠিন হয়ে যাবে। 

বাংলাদেশের সমস্যাটা একেবারে অনন্য এবং আলাদা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আমাদের এফেক্ট আছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের, তারপর কভিড আছে, তারপর সম্প্রতি চীনের যে গ্রোথ কমে গেছে, সেটার এফেক্ট আছে। এটা সব দেশে আছে, শুধু বাংলাদেশে নয়। অতএব সেগুলোর ওপর দায় চাপালে তো হবে না। আমরা যদি নিজেরা শক্ত হতে পারি, তাহলে অনেক কিছু সম্ভব। আমাদের ব্যাংকিংয়ের অবস্থা খারাপ। আমাদের করাপশন, অপচয়, লিকেজ, অদক্ষতা—এগুলো ঠিক করতে অর্থনীতিতে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন।

কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কী করা হবে, তা কিন্তু তেমন বলা হয়নি। বাজেট, মুদ্রানীতি এখনই সব করে ফেলবেন, সেটা আশা করব না। তবে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে।

সব শেষে বলতে হবে, জ্বালানিটা কিন্তু আমাদের এখনো সমস্যা। সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়লে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়বে। এসব সমস্যার সমাধান তো হচ্ছে না। ঠিক আছে কৃচ্ছ্রসাধন করব। এখন জ্বালানি পলিসির ওপর চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আবার বহুদিন পর গ্যাস উত্তোলনের চেষ্টা চলছে। এই কাজগুলো যদি আমরা দ্রুত না করি, তবে নীতি ও কৌশলের সুফলটা আমরা পাব না।

যদি আমরা দক্ষতা না বাড়াই বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে, তাতে ৬.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কিভাবে হবে? ইদানীং আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ হবে না। গ্রোথের পজিশনটা একটু মনে হয় বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত ছিল। এটা একটা কথা, শুধু প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিই একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। সেটার সঙ্গে সমতাভিত্তিক এবং টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই আমাদের কাম্য।

শেষ কথা হলো, যা-ই করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলোর নজরদারি বাড়াতে হবে। এগুলো যদি আমরা ঠিক না করতে পারি, মুদ্রানীতির ফল ঘরে তুলতে পারব না। মুদ্রানীতিটা কার্যকর হবে না।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলেখক : রায়হান রাশেদ

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments