Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামমাহে রমজান মুসলমানদের ঐক্য-সংহতি বৃদ্ধি করে

মাহে রমজান মুসলমানদের ঐক্য-সংহতি বৃদ্ধি করে

মানুষের মধ্যে বিদ্যমান পশুশক্তিকে দমন করে আত্মিক ও নৈতিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করা রমজান মাসের রোজা পালন করার অন্যতম উদ্দেশ্য। উপবাস অনুশীলনের মাধ্যমে অপরের অনাহার-ক্লিষ্টতা, অভাব-অনটনের দুঃখ-কষ্ট ও মানবিকতার যথার্থ অনুভূতি অর্জন করতে রোজা পালনের বিকল্প নেই। দুঃখিত, বিপদগ্রস্ত ও অসহায় মানবতার প্রতি সহানুভূতি সহমর্মিতা প্রদর্শন মানুষের নৈতিক দায়িত্বও বটে। এরূপ গুণাবলীর অধিকারী হতে হলে রোজা পালন অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) রমজান মাসের রোজার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এই পবিত্র মাসকে ‘শাহরুল মোওয়াসাত’ বা মানুষের প্রতি ‘সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই সহানুভূতি প্রদর্শনের বহু দিক রয়েছে।

‘মোওয়াসাত’ বা সহানুভূতি প্রদর্শনের অনুশীলন করার উত্তম ব্যবস্থা হিসেবে এই মাসের বৈশিষ্ট্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বর্ণনা করেছেন। তিনি ধনী-গণীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কথা বলেননি। দরিদ্র-অভাবী, ফকির-মিসকিন, অসহায়দের প্রতি ধনীদের সহানুভূতি প্রদর্শনের কথাই বলেছেন। আর্থিকভাবে সক্ষম-সচ্ছল লোকরাই দরিদ্র-অভাবী-অসহায়দের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করবে, তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করবেÑ সহানুভূতির মাস বলতে এটাকেই বুঝানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন অর্থশালী রোজাদার ইফতারের জন্য রুচিসম্মত বহু প্রকারের জিনিসের ব্যবস্থা করে তৃপ্তি সহকারে ইফতার করে অথবা ইফতারের জন্য বিপুল আয়োজন করে বড় বড় লোকদের দাওয়াত করে, অথচ তার আশেপাশে এমন রোজাদারও রয়েছে যাদের ইফতার করার সম্বল পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। বিত্তশালী লোকদের ইফতার করানোর সময় এই গরীব-মিসকিন রোজাদারদের কথা স্মরণ করে তাদেরকেও যদি অংশীদার করা হয়, তা হবে সহানুভূতি প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। তাই ইফতার-সেহরিতে এতিম-মিসকিন ও অসহায়-দরিদ্রদের জন্য একটা অংশ থাকা আবশ্যক। অনুরূপভাবে সেহরির কথাও এসে যায়। সমাজে এমন রোজাদারের অভাব নেই, যারা যথাযথভাবে সেহরি খাওয়ারও সুযোগ পায় না। তারা যেন রোজা পালনের জন্য খাদ্যকষ্ট ভোগ না করে, বিত্তবানদের সেদিকেও মনোযোগী হওয়া উচিত। রোজা পালনের মাধমে এই মমতাবোধ সৃষ্টি হয়ে থাকে। রোজাদারদের ইফতার করানোর মধ্যে যে মানবিক দিক রয়েছে তার তাৎপর্য সংক্রান্ত বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) পবিত্র রমজান মাসে দান-খয়রাতের ওপরও বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন, যাতে মানবীয় কল্যাণ রয়েছে। এই মাসে মোমেনের রিযিক বা জীবিকা বৃদ্ধি পায় বলেও রাসূলুল্লাহ্ (সা.) উল্লেখ করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম এই মাসে বিশেষভাবে অধিক পরিমাণে দানÑখয়রাত করতেন এবং তাদের বদান্য ও আত্মত্যাগের প্রবণতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেত। তাদের জীবনে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার কথা জানা যায়। রমজান মাসে তাঁদের সহানূভুতি প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত বিরল।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আরও একটি মানবিক দিকের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রমজান উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই মাসে তার খাদেম বা কর্মচারীর শ্রমের বোঝা হ্রাস করবে, আল্লাহ্ তাআলা তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে দোজখ হতে মুক্তি দান করবেন’। এই উক্তির মাধ্যমে রসূলুল্লাহ্ (সা.) এই মর্মে সকলকে উৎসাহিত করেছেন যে, রমজান মাসে মালিকরা যেন শ্রমিক-মজুরদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে এবং তাদের প্রতি শ্রম আদায়ে সহানুভূতি প্রদর্শন করে। অর্থাৎ রমজান মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও এই মাসের পবিত্রতার কথা স্মরণ করে শ্রমিকদের শ্রম হ্রাস করা, অবশ্য শ্রমিকেরও রোজাদার হতে হবে, রোজা রাখার কারণেই সে মালিকের পক্ষ হতে এই সুযোগের অধিকারী হবে।

আল্লাহ্প্রদত্ত রিযিক বা জীবিকা দ্বারা মানুষের উপকার ও কল্যাণ সাধন করা রমজানের একটি বড় শিক্ষা। এই শিক্ষা কেবল রমজানেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্যান্য সময়ের জন্যও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর একটি হাদীসের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। হজরত ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে সবর্দা পাঁচশ মনোনীত ব্যক্তি বা চল্লিশ জন ‘আবদাল’ থাকে। যখন তাদের একজন মৃত্যুবরণ করে, তখন অপরজন দ্রুত সেই স্থান অধিকার করে। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, এসব লোকের বিশেষ কাজ কী? হুজুর (সা.) বললেন, অত্যাচারীদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে এবং যারা মন্দ কাজ করে তাদের প্রতিও উপকার করে এবং আল্লাহ্ তাআলার প্রদত্ত রিজিক হতে মানুষের সঙ্গে হামদর্দী ও সহানুভূতিমূলক আচরণ করে। অর্থাৎ বান্দাগণের মধ্যে আল্লাহ্ তাআলার একটি মনোনীত বিশেষ দল সার্বক্ষণিকভাবে মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনে নিয়োজিত। তারা অত্যাচারী ও অন্যায়কারীদের প্রতিও সহানুভূতি প্রদর্শন করে থাকেন। কাজেই রমজানের মতো পবিত্র ও মহিমান্বিত মাসে দুঃখী-গরিব-মিসকিন ও অসহায় লোকদের এবং শ্রমিক মজুরের প্রতি বিত্তবান মালিক কর্তৃপক্ষ একটু সুদৃষ্টি দান করলে তা হবে রমজানের মহৎ শিক্ষারই অনুসরণ। সহানুভূতি প্রদর্শনের এই মাসে আরও নানাভাবে দুস্থ মানবতার সেবা করার প্রশস্ত ময়দান রয়েছে।

বিশ^ মুসলিমের বৃহত্তর ঐক্য-সংহতি, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহ্ তাআলার এমন একটি অবদান, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে মানব কল্যাণের অপূর্ব দৃষ্টান্ত। সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এই পবিত্র মাসের রোজা, প্রত্যেক দেশের সময়ানুযায়ী একই পদ্ধতিতে রোজা রাখার জন্য বিধি-বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে। রমজান মাসের রোজা পালনের এই খোদায়ী বিধানগুলো পর্যালোচনা করলে প্রমাণিত হয় যে, এতে ঐক্য-সংহতির এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে। সেহরি খাওয়া থেকে ইফতার পর্যন্ত দিবা ভাগের করণীয় ও বর্জনীয় কাজগুলো বিশে^র কোনো মুসলমানের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়নি, বরং প্রত্যেক দেশের মুসলমানের জন্য এক ও অভিন্ন নিয়ম করা হয়েছে। তবে বিশেষ পরিস্থিতির কথা ভিন্ন। যেমনÑ যেসব দেশে দিবা-রাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিবা ভাগ অতি সংকীর্ণ বা তিন-চার ঘণ্টারও কম, সেসব দেশে মুসলমানগণ কীভাবে রোজা পালন করবে, সেটি স্বতন্ত্র বিষয়।

সারা দুনিয়ার মুসলমানগণের জন্য সাধারণভাবে রমজানকে রোজা পালনে ধর্মীয় বিধি-বিধানে কোনো তারতম্য রাখা হয়নি। সেহরি খাওয়ার জন্য সময় নির্ধারণ ও খাওয়ার অভিন্ন রীতিনীতি রয়েছে। এবাদত-বন্দেগী, জিকির, তসবীহ, তহলীল, কোরআন তেলাওয়াত প্রভৃতি নফল এবাদতকে রমজানের করণীয় বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর একই সাথে দুনিয়াবী কাজ-কর্ম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে যে কোনো রোজাদার তার দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যাবে। রাতের ইবাদতের মধ্যে তারাবীহ্র নামাজ সকলের জন্য সুন্নত হিসেবে ধার্য্য করা হয়েছে। ইবাদতের এই অভিন্নতা মুসলমানদের মৌলিক ঐক্যের একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সমগ্র দুনিয়ার মুসলমান রমজান মাসের রোজা পালনের মধ্যে উপবাস পালনের যে ঐক্য প্রদর্শন করে থাকে, সেটিও তাদের মধ্যে ইসলামী বৃহত্তর ঐক্যেরই প্রতীক। এসবই হচ্ছে রমজান মাসব্যাপী মুসলিম ঐক্য-বৈশিষ্ট্য। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্ তাআলার রশ্মিকে তোমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং মতবিরোধ করো না।’ এই শিক্ষা কোরআনের বহু স্থানে পরিলক্ষিত হয়। রমজান মাসই এই শিক্ষার অন্যতম প্রতীক।

এই মাসের করণীয় কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ফিতরা’ প্রদান ব্যবস্থা। ফিতরা পাওয়ার যোগ্য কারা, কোরআনে তার বিশদ বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। শারীরিক আত্মশুদ্ধি ও সংযম সাধনের সাথে সাথে আর্থিক পবিত্রতা অর্জনের এই ব্যবস্থার মধ্যেও মুসলমানদের ঐক্য চেতনা জাগ্রত করার নির্দেশ রয়েছে। সারা দুনিয়ার মুসলমানগণ পবিত্র রমজান মাসে শরীয়ত নির্ধারিত পরিমাণে নির্ধারিত বস্তু দ্বারা ফিতরা প্রদান করে কতিপয় নির্ধারিত শ্রেণির লোকের প্রতি মানবতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের এক অকল্পনীয় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। সারা দুনিয়ার মুসলমানের মধ্যে একই দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। রমজান মাসের প্রতি, এই মাসের রোজার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ফিতরা আদায়ের মধ্যে দেখা যায়। শরীয়তের দৃষ্টিতে সক্ষম রোজাদার এবং অরোজাদার নারী-শিশু সকলের জন্য ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে। গরিব, ইয়াতিম, মিসকিন প্রভৃতি শ্রেণির-যারা ফিতরা পাওয়ার যোগ্য, তাদের সকলের সাহায্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের এই আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিটি স্থানে মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য। এতে মুসলিম ঐক্য-সংহতির অভিন্ন নিদর্শন এক বিরল ঘটনা। তাছাড়াও দান খয়রাতের মাধ্যমেও একই উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে থাকে। সুতরাং ফিতরা, সাধারণ দান-খয়রাত, সদকাÑ এসবই হচ্ছে রমজান মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উত্তম ব্যবস্থা। আর্থিক ক্ষমতা সৃষ্টির জন্য রমজানের এই অবদান মুসলিম জীবনের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক, যা মুসলমানগণ রমজানের মাধ্যমেই অর্জন করতে পারে।

সারা দুনিয়ার মসজিদগুলোতে এই রমজান মাসে তারাবীহর পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট দিনগুলোতে ‘এতেকাফ’ প্রথা, শবে-কদরের এবাদত-বন্দেগিতে মুসলমানদের আত্মনিয়োগ এবং আধ্যাত্মিকতা চর্চায় যে সর্বব্যাপী চেতনা-অনুভূতির সৃষ্টি হয়ে থাকে তাতেও মুসলিম ঐক্য সংহতির ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। অনুরূপভাবে এই পবিত্র মাসে সক্ষম ধনী-বিত্তশালী-মুসলমানগণ ‘জাকাত’ প্রদানের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধতার সাথে সাথে আর্থিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলার দরবারেও তারা উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে বলে তাঁরই ঘোষণা।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments