Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeধর্মমাদ্রিদে মুসলিম শাসনের স্মৃতিচিহ্ন

মাদ্রিদে মুসলিম শাসনের স্মৃতিচিহ্ন

আধুনিক সভ্যতার ধারক ইউরোপের বহু মানুষ স্পেনের মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হলেও তারা জানে না যে স্পেনের বর্তমান রাজধানী মাদ্রিদেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ইসলামের বহু নিদর্শন, যার কিছু স্মৃতিস্মারক এখনো টিকে আছে এবং মাদ্রিদ ইউরোপের একমাত্র রাজধানী, যার শিকড়ের সঙ্গে ইসলামের নাম গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।

মাদ্রিদের গোড়াপত্তন : উমাইয়া শাসক আমির প্রথম মুহাম্মদ ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ‘মাইরিত’ শহরের গোড়াপত্তন করেন। কালান্তরে যা আধুনিক মাদ্রিদে রূপ নিয়েছে। প্রতিবেশী খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলোর হামলা থেকে আল-আন্দালুসের ইসলামী সাম্রাজ্যের উত্তর সীমানাকে রক্ষার জন্য মাইরিতকে শক্তিশালী সামরিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুসলিম শাসনের অবসান হলে মাদ্রিদ থেকে মুসলিম শাসনের স্মৃতিচিহ্নগুলো মুছে ফেলা হয়।

মুসলিম শাসনামলে মাদ্রিদ : মাইরিত দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আল-আন্দালুসের অংশ ছিল। এ সময় তা ছিল একটি বিকাশমান, উন্নয়নশীল ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান। মাইরিত বা মাদ্রিদ ছিল মুসলিম স্পেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর এবং আঞ্চলিক রাজধানী। এখানে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও বৃহদায়তন জামে মসজিদ ছিল। দ্য সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ইসলামিক মাদ্রিদের (সিইএমআই) ঐতিহাসিক ড্যানিয়েল গিল-বেনুমেয়া মনে করেন, ‘এটি আন্দালুসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের একটি শহর ছিল, যার অর্থ হলো এটি নিছক কোনো সামরিক ঘাঁটি ছিল না। এটি ছিল একটি ছোট ও বহুল পরিচিত শহর, বিশেষত এর কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, সামরিক গুরুত্ব ও একাধিক সামরিক অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় শহরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়।’

মুসলিম পতনের পর মাদ্রিদ : রাজা ষষ্ঠ আলফোনসো ১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে মাইরিত জয় করার পরও সেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় ছিল। মাইরিতে মুসলিম শাসনের অবসান হওয়ার পরও ৫০০ বছর পর্যন্ত খ্রিস্টান শাসকরা শহরের মুসলিম সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমীহ করতেন এবং শহরের মুসলিম ও খ্রিস্টানরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করত। গিল-বেনুমেয়ার মতে, খ্রিস্টান মাইরিতে মুসলমানের সংখ্যা কখনো ৫ শতাংশের বেশি ছিল না। কিন্তু তারা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব বহন করত। কাস্টিল রাজ্যের আইন অনুসারে মুসলিম ও ইহুদিদের রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ নিষিদ্ধ ছিল। তার পরও বহু শতাব্দীকাল পর্যন্ত মুসলিমরা কাউন্সিলর সমমানের পদে নিযুক্ত ছিল। মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান ছিল, বিশেষত লৌহ ও নির্মাণ শিল্পে তাদের নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা ছিল। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের শাসকরা মুসলিম ও ইহুদি সম্প্রদায়কে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ মাদ্রিদকে স্পেনের নতুন রাজধানী ঘোষণা করেন। এ সময় থেকে মূলত মাদ্রিদের মুসলিম পদচিহ্ন মুছে ফেলার প্রচেষ্টা শুরু হয়।

হুমকির মুখে মুসলিম স্মৃতিচিহ্ন : স্পেনস ইসলামিক কালচার ফাউন্ডেশনের (এফইউএনসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল এনকার্না গুতেরেস বলেন, ‘মাদ্রিদের বেশির ভাগ ইসলামী স্মৃতিচিহ্ন বিলীন হয়ে গেছে। দেয়াল ও সামান্য কিছু স্থাপত্যচিহ্ন টিকে আছে। মাদ্রিদকে রাজধানী ঘোষণা করার পর নতুন ধর্মের আদর্শের সঙ্গে মিল রেখে তাকে সাজানোর প্রয়োজন ছিল এবং তার প্রয়োজন পূরণের জন্যই আল-আন্দালুসের সমাপ্তি প্রয়োজন ছিল।’

এর পরও মাদ্রিদে নবম শতাব্দীতে তৈরি দেয়াল, শহরের মুসলিম স্থপতিদের নির্মিত প্রধান দুর্গের মূল অংশ আমির মুহাম্মদ পার্কে টিকে আছে। মাদ্রিদের জমকালো রাজকীয় প্রাসাদটিও একটি মোরিস (স্প্যানিশ মুসলিম) দুর্গের স্থানে, যা আঠারো শতকে ধ্বংস হয়ে যায়। মাদ্রিদের বেশির মুসলিম স্থাপত্য শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।

জনজীবনে মুসলিম শাসনের প্রভাব : হাজার বছর আগে মাদ্রিদে মুসলিম শাসনের অবসান হয়। কিন্তু এখনো সেখানে মুসলিম শাসনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মাদ্রিদের দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জা ‘সান পেড্রো এল ভিজোর’ ও ‘দে লা ভিলা’ নির্মিত হয়েছে মুসলিম উদ্ভাবিত ‘মুদজার’ স্থাপত্যশৈলীতে। এ ছাড়া মাদ্রিদের পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিক রীতিনীতি, ভাষা ও খাদ্যাভ্যাসে এখনো মুসলিম শাসনের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

আশার কথা : স্পেন থেকে বিতাড়িত বহু মুসলিম পরিবার দেশটিতে ফেরার চেষ্টা করছে, দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমরা ইসলামী ঐতিহ্য পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করছে এবং সত্যান্বেষী বহু অমুসলিম গবেষক স্পেনের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে মুসলিম অবদানগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

তথ্যসূত্র : দ্য নিউ আরব

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments