Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeসাহিত্যভালোবাসার মূল্য কত?

ভালোবাসার মূল্য কত?

‘ভালোবাসার মূল্য কত/ কিছু আমি জানি না/ এ জীবন তুল্য কি তার আমি সেতো বুঝি না/ আমি না জেনে না বুঝে নিলাম তোমার মন/পরে বেশি দাম চেওনা।’- বাংলা সিনেমার এ জনপ্রিয় গানটি এক সময় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। এ গানটির এক গভীর তাৎপর্য রয়েছে। দরদাম করে কখনোই ভালোবাসার মূল্য নির্ধারিত হয় না। এরপরও প্রেমিক-প্রেমিকার মনে এ প্রশ্ন উঁকি না দিয়ে পারে না যে, প্রেমাস্পদের কাছে তার ভালোবাসার মূল্য কত? প্রেমাস্পদ তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে? বৈষয়িক মানদণ্ড দিয়ে ভালোবাসার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। তবে এর নজির যে একবারেই নেই তা নয়। রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড প্রেমিকার জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। অর্থাৎ রাজত্বের মূল্যে তিনি ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছিলেন। এডওয়ার্ডের উত্তরসূরি এ যুগেও আছেন। প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়নার দ্বিতীয় সন্তান হ্যারি রাজচক্ষু উপেক্ষা করে মেগান মার্কেলকে বিয়ে করেছিলেন। ভালোবাসার জন্য তিনি রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেছেন।

উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে প্রায়ই দেখা যায় দুই শ্রেণির নায়ক-নায়িকার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক। নায়ক ধনী, নায়িকা দরিদ্র কিংবা নায়িকা ধনী, নায়ক দরিদ্র। এ সম্পর্ক যেন ছিন্ন হয় সেজন্য ধনী নায়ক/নায়িকার ধনাঢ্য পিতা আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এমনকি টাকা দিয়ে দরিদ্র প্রেমাস্পদকে বিদায় করতে চান। তখন দরিদ্র নায়িকা/ নায়কের মুখে শোনা যায় সেই বিখ্যাত সংলাপ-‘চৌধুরী সাহেব, আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু ভিখারি নই।’ কোনো মূল্যের বিনিময়ে তারা ভালোবাসা হারাতে চান না। অঘটনঘটনপটিয়সী পরিচালকের প্রতিভার গুণে অবশ্য শেষ পর্যন্ত নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটে। বাস্তবে কিন্তু এমন নিঃস্বার্থ প্রেমিক/প্রেমিকার দেখা পাওয়া দুষ্কর। এক দরিদ্র যুবক ভালোবেসেছিলেন এক ধনী ব্যক্তির কন্যাকে। যুবকটি দেখা করতে গেল সেই ধনকুবেরের সঙ্গে। ধনী ব্যক্তিটি নিজের মহাব্যস্ততার কথা উল্লেখ করে যুবকটিকে বললেন, ‘তোমাকে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না। আমার এক মিনিট সময়ের মূল্য এক লাখ টাকা।’ যুবক তড়িঘড়ি করে বলল, ‘সময় লাগবে না। দয়া করে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে দিন আমায়।’ আর্থিক মূল্য বিচারে প্রেমিকারাও কম পারঙ্গম নয়। সাবেক প্রেমিকা চিঠি লিখেছে প্রেমিককে-

‘প্রিয় রনি, তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এখন বুঝতে পারছি, এ পৃথিবীতে তোমার চেয়ে বেশি কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারে না। আমরা কি সম্পর্কটি আবার নতুনভাবে শুরু করতে পারি না? তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। ইতি তোমার রিয়া। পুনশ্চ লটারিতে এক কোটি টাকা জেতার জন্য তোমাকে অভিনন্দন।’ ভালোবাসার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কান্না। যে ভালোবাসায় কান্না নেই সে ভালোবাসা মূল্যহীন। মান্না দে’র একটি জনপ্রিয় গানে বলা হয়েছে-‘ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে/ পথের কাঁটায় পায় রক্ত না ঝরালে/ কী করে এখানে তুমি আসবে?’ এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, অশ্রুর পরিমাণ ভালোবাসার ঘনত্বের সমানুপাতিক। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রমও ঘটে। কোনো কোনো নারীর চোখে দমকল বাহিনীর জলের কল থাকে। কারণে অকারণে সে জল চোখ থেকে বেরিয়ে আসে। এ অশ্রু নিশ্চয়ই ভালোবাসার তীব্রতার পরিচায়ক নয়।

শুধু জল নয়, আরেকটি তরল পদার্থ ভালোবাসার মূল্য নির্ধারণ করে। সেটি হচ্ছে রক্ত। দেশে দেশে, যুগে যুগে প্রেমের জন্য রক্ত ঝরিয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকারা। এমনকি রক্ত দিয়ে প্রিয়জনের নাম লিখেছে নিজের শরীরে বা কাগজে। এতে কাক্সিক্ষত ফলাফল পেয়েছে অনেকেই। কিন্তু রক্ত কখনো কখনো ব্যর্থও হয়েছে। এক নাছোড়বান্দা প্রেমিক কিছুতেই মন গলাতে পারছে না এক মেডিক্যাল ছাত্রীর। শেষে সে তার জন্য প্রেমপত্র লিখল নিজের রক্ত দিয়ে। সেই ছাত্রী রক্তলেখা প্রেমপত্র পড়ে জবাব দিল, ‘তোমার ব্লাড গ্রুপ এ পজেটিভ, তোমার রক্তে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি আছে। আর কচুশাক বেশি করে খাবে।’

বৈষয়িক চিন্তা নানাভাবে ভালোবাসার মূল্য নির্ধারণ করে। দুই প্রেমিক-প্রেমিকা রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছে। অম্ল-মধুর কথাবার্তার পর প্রেমিকা জানাল যে তার অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। প্রেমিক অনেক অনুনয়-বিনয় করল। কিন্তু প্রেমিকা তার সিদ্ধান্তে অটল। হতোদ্যম হয়ে প্রেমিক বেয়ারাকে ডেকে তাদের দু’জনের বিল আলাদাভাবে দিতে বলল। বিটিভিতে প্রচারিত এক সময়ের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনটি নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। একটি বিশেষ টিনের বিজ্ঞাপনে এক তরুণী তার হবু বরকে বলছে, ‘এক শর্তে করতে পারি বিয়া, আমাগো ঘর বানাও যদি অ্যাপোলো টিন দিয়া।’ অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট টিন এখানে ভালোবাসার মূল্যের নির্ণায়ক। কালের বিবর্তনে টিন কখনো শাড়ি, কখনো গহনা, কখনো বা গাড়ি-বাড়ির রূপ ধারণ করে।

তবে এক যাত্রায় কখনো কখনো পৃথক ফল হয়। জগন্ময় মিত্রের সেই বিখ্যাত গানটি স্মরণ করা যাক-‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি।’ এটি অনেক প্রেমিকেরই মনের কথা। শুধু প্রেমিক কেন, কোনো কোনো প্রেমিকাও মনে করে যে ভালোবেসে তার শুধু ক্ষতি হয়েছে আর প্রেমিকের লাভ হয়েছে। এমন এক প্রেমিকা ভালোবাসার মূল্য না পেয়ে হতাশ হয়ে তার প্রেমিককে বলল, ‘তোমায় ভালোবেসে আমার সর্বনাশ হয়েছে। কিছুই হতে পারলাম না।’ প্রেমিকের জবাব, ‘তো আমি কোথাকার

ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এমপি-মন্ত্রী হয়ে গেছি?’

ভালোবাসার মূল্য বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে ভালোবাসা দিবস। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বায়নের স্রোতবাহিত হয়ে ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে প্রবেশ করে। শুরুতে ফুল, কার্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমে ক্রমে পণ্য ভোগবাদের বাজারে পরিণত হয় ভালোবাসা। দামি উপহার, দামি রেস্টুরেন্টে ডেটিং প্রভৃতি হয়ে দাঁড়ায় ভালোবাসার পরিমাপক। এভাবেই ভালোবাসার মূল্যের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। তাই এটি অতিশয়োক্তি নয় যে বাজার অর্থনীতিই ভালোবাসার নিয়ন্ত্রক। জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলে থাকেন, ভালোবাসার ঘনত্ব প্রেমিকের মানিব্যাগের পুরুত্বের সমানুপাতিক। নারীবাদীরা অবশ্য আপত্তি তুলতে পারেন।

বর্তমানে অনেক নারী কর্মজীবী। তাদের ভ্যানিটি ব্যাগও ভালোবাসার মূল্য নির্ধারণ করতে সক্ষম। লেখার শুরুতে বাংলা চলচ্চিত্রের গানের কথা বলেছিলাম। শুধু চলচ্চিত্র নয়, সংগীত, সাহিত্য, শিল্পকলা, ভাস্কর্য সবকিছুই ভালোবাসার কাছে ঋণী। ভালোবাসা না থাকলে এ সৃজনশীল শাখাগুলো বন্ধ্যাত্ব বরণ করতে বাধ্য হতো। ভালোবাসা অমূল্য হিসাবেই চিত্রায়িত হয়েছে শিল্প-সাহিত্যে। যদিও শিল্প ও বাস্তবের মধ্যে ব্যবধান দুস্তর এরপরও ভালোবাসার অপরিসীম মূল্য অস্বীকার করবে কে?

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments