মধ্যবিত্ত পরিবারে এক কামরার কষ্টসাধ্য জীবন-সেখান থেকে কোটিপতি। আর এখন জেলবন্দি। সাগর ঠক্কর ওরফে স্যাগি তার ২৮ বছরের জীবনে সব দেখে ফেলেছেন।
নালাসোরের এই তরুণ ভারতের অন্যতম বড় আন্তর্জাতিক আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা। সাত হাজার আমেরিকানকে বোকা বানিয়ে লক্ষ লক্ষ ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন। ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য অন্তত ৫০০ কোটি রুপি।
কীভাবে এই অর্থ আসত? কী করেই বা ভারতে বসে আমেরিকানদের বোকা বানাতেন এই তরুণ? জবাবটা হলো কলসেন্টার। ভুয়া কলসেন্টারের বড় চক্র তৈরি করেছিলেন এই যুবক। দিল্লি, মুম্বাই, আমদাবাদের মতো শহর থেকে চলত এই কাজ।
সাগরের কল সেন্টারের মূল দফতর ছিল রাজধানী দিল্লি। টানা দু’বছর দিল্লি পুলিশের নাকের ডগায় থেকে প্রতারণা চালিয়ে গেছেন সাগর।
সাগরের কলসেন্টারে রীতিমতো নিয়ম মেনে কর্মী নিয়োগ করা হতো। খাতাকলমে তাদের বেতন ছিল মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। যদিও তদন্তকারীরা পরে জানতে পেরেছিলেন, এই বেতন মাসে লাখ টাকাও ছুঁয়ে ফেলতো কোনও কোনও সময়।
কর্মীদের কাজ ছিল, আমেরিকার নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা। ভয় দেখানো হতো কর ফাঁকি দেওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে। নিয়ম মেনে যদি কেউ কর দিয়েও দিতেন, তবে তাকেও বোকা বানানোর উপায় জানা ছিল তাদের। কর্মীদের সব রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি করা কথোপকথনের স্ক্রিপ্ট দিয়ে রাখার ব্যবস্থা ছিল সাগরের কলসন্টারে। চতুর ও দক্ষ কর্মীদের আমেরিকান উচ্চারণে আগে থেকে তৈরি রাখা সেই সব যুক্তি শুনে বোকা বনতেন অনেক আমেরিকান।
দিনে এমন ভয় দেখানো ফোন যেত অন্তত ১০০ জন আমেরিকান নাগরিকের কাছে। তার মধ্যে ৩০-৪০ জন সত্যি সত্যি ভয় পেতেন। আট থেকে দশ জন টাকাও দিয়ে দিতেন কর সংক্রান্ত আইনি জটিলতা এড়াতে।
এদের থেকে কম পক্ষে ৩০০ ডলার এবং সর্বাধিক ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত আদায় করত সাগরের ভুয়া কলসেন্টার। যে কর্মী সবচেয়ে বেশি অর্থ আদায় করতে পারতো, তাকে মাসে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো এক লক্ষ টাকা।
আদায় করা টাকা সরাসরি ভারতে আসত না। আমেরিকার নাগরিকরা ওই টাকা দিতেন আমেরিকার ব্যাঙ্কেই। সেখানে সাগরের এজেন্ট ছিলো। আদায় করা অর্থের ৩০ শতাংশ নিজেরা নিয়ে তারা বাকিটা পাঠিয়ে দিতেন। দুবাই এবং চীন হয়ে অর্থ আসত ভারতে।
সেই টাকাতেই কোটিপতি সাগর এক সময় বিদেশি গাড়িতে গ্যারেজ ভরেছিলেন। স্পোর্টস কার পছন্দ ছিল তার। ইতালি, জার্মানি থেকে গাড়ি কিনেছিলেন। এমনকি বিরাট কোহলীর সংগ্রহ থেকেও তার প্রথম স্পোর্টস কারটি কিনে নিয়েছিলেন সাগর। আড়াই কোটি টাকা খরচ করেছিলেন ওই গাড়িটির জন্য।
তখন টাকায় ভাসছেন সাগর। তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, সে সময় বিদেশি নামি ডিজাইনার লুই ভিত্তোঁর স্যুট পরে ঘুরে বেড়াতো সাগর। সপ্তাহের প্রতিদিন মুম্বাইয়ের অভিজাত ক্লাবে বসত তার সান্ধ্য আসর। বিদেশি গাড়িতে সাগরের সঙ্গে থাকত দু’জন দেহরক্ষী।
একে ধরতে একটা সময়ে নাকানি-চোবানি খেয়েছেন গোয়েন্দারা। সফল হননি। আত্মগোপন করতে দুবাইয়ে চলে যান সাগর। তবে তখনও ভারতে তার ব্যবসা চলছে পুরোদমে।
কিন্তু ২০১৮ সালে পুরোপুরি ধরা পড়ে যায় সাগরের কারসাজি। বিভিন্ন শহরে অভিযান চালিয়ে সাগরের ভুয়া কল সেন্টারের অন্তত ৬০০ জন কর্মীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। সাগরকে তখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। তবে আচমকা সাগর নিজেই ধরা দেন। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তিনি।
বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট বলছে, সাগরের অপরাধের কথা জানতে পেরে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন প্রেমিকা। সাগরের সঙ্গে তিনি সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেন। পুলিশ জানিয়েছে, এই প্রেমিকার জন্যই আড়াই কোটি টাকা খরচ করে বিরাট কোহলীর সংগ্রহ থেকে গাড়ি কিনেছিলেন সাগর।
আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন সাগর, তা স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান করা যায়, প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরই সাগর ওই সিদ্ধান্ত নেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারে এক কামরার ঘরে কষ্টে বড় হয়েছিলেন সাগর। বাবা ছিলেন ছোট ব্যবসায়ী মা গৃহবধূ। ক্লাস এইট পর্যন্ত সাধারণ স্কুলে পড়লেও পরে সরকারি স্কুল কলেজে শিক্ষা স¤পন্ন করেন। তবে কলেজে পড়ার সময় থেকেই প্রতারণা চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন এই তরুণ।
কলসেন্টারে কাজ করা এক বন্ধুর সহযোগিতায় এই ব্যবসায়ে হাত পাকান। সেই ব্যবসারই শিকার হন প্রায় ৭ হাজার আমেরিকান। ২০১৬ সালে আমেরিকার ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিসের ডার্টি ডজন তালিকার শীর্ষে জায়গা পায় সাগরের আর্থিক কেলেঙ্কারি। ৫ হাজার ৭৮৬ পাতার চার্জশিটে ৮০ জনের মধ্যে এক জন ছিলেন সাগর।
মুখে সযতেœ লালিত হালকা দাড়ি। পড়নে লুই ভিত্তোঁর পোশাক। ইতালিয়ান এবং জার্মান স্পোর্টস কার মুম্বাইয়ের অভিজাততম নাইট ক্লাবে যাতায়াত, সব সময়ের সঙ্গী বিশালদেহী দেহরক্ষী- ছেলেটিকে দেখে মনে হতো জীবনে সাফল্যের শিখর ছুঁয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তারপরই নেমে এল অন্ধকার।