Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামবয়োবৃদ্ধদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

বয়োবৃদ্ধদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

আফতাব চৌধুরী 

চুলে পাক ধরার সাথে সাথে জীবনসন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার এক অতি পরিচিত বিষণœ ছবি আমাদের অধিকাংশের চোখের কোণে ভেসে ওঠে। বার্ধক্য, অধিকাংশ বয়স্ক ও বৃদ্ধের কাছে তো বটেই, এমনকি অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স্ক ও তরুণদের কাছেও অভিশাপ বলেই মনে হয়। বর্তমান সামাজিক অবস্থায় এমন ভাবনা মোটেই অমূলক ও অসঙ্গত নয়। জীবন চক্রে অনিবার্য এই পরিণতি, অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুরই মতো। সম্ভবত মৃত্যুর আগাম সঙ্কেত বয়ে নিয়ে আসে বলেই বার্ধক্যে মানুষ জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে মেনে নিতে পারে না। বয়স্ক ও বৃদ্ধদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সব ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নয়, যার দরুন পরিবার তথা সমাজের সঙ্গে এক অবাঞ্চিত সংযোগহীনতা তৈরি হয় এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় বয়স্করা বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। জীবনের হাসি-আনন্দ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বার্ধক্যের নিজস্ব কিছু সমস্যা নিশ্চয়ই আছে, তার সঙ্গে এই বিষাদ যুক্ত হয়ে আরও জটিলতা সৃষ্টি করে। ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ এই প্রবচনটি বৃদ্ধদের প্রতি আচার-আচরণে বস্তুত অনুসৃত হয় না, কথার কথা হয়েই থাকে। দেহগত ও মনোগত পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত কিছু সমস্যার মোকাবিলা বয়স্কদের অনিবার্যভাবেই করতে হয়, রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়, সামাজিক কিছু সমস্যাও দেখা দেয় এ সময়। সবদিক বিবেচনা করে ও সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ ১৯৯৯ বছরটিকে ‘আন্তর্জাতিক বয়স্ক লোকবর্ষ’ Intarnational year of the older persons (IYOP) হিসেবে পালন করেছিল। উদ্দেশ্য, এমন এক সমাজ গঠন, যেখানে সকল বয়সের মানুষের মানবাধিকার, যে সমাজ বয়স্কদের ‘অসুস্থ ও অবসরপ্রাপ্ত’ (Patients & pensioners) বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না, বরং প্রগতির ‘প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী’ (agent and beneficiaries of development) হিসাবে দেখেও সম্মান দেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এর সঙ্গে সংযোজন করেছে ‘সক্রিয় বয়স্কতা’ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাও।

বার্ধ্যক্য আসলে কী? বার্ধক্যের যথার্থ ও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা আজও নিরূপিত হয়নি। বার্ধক্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত¡ হাজির করেছেন। তার মধ্যে প্রধান দু’টি হচ্ছে- 1. Stochastic theory- Ageing events occur randomly, accumulate with time and depend on environmental factors.2. Non-Stochastic theory-Ageing depends on predetermined genetic programming of the cells or organ system.

প্রথমটিতে বার্ধক্যের কারণ হিসাবে ‘সময়’ ও পরিবেশকে দায়ী করা হয়েছে, অবশ্য এক্ষেত্রে গবেষকরা একমত নন। সে যা হোক, তত্ত¡নিরপেক্ষভাবে বলা যায় যে ‘বার্ধক্য’ বা ‘জরা’ একটি অনিবার্য শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতা থেকে নির্দিষ্ট অর্থে ভিন্ন ও পৃথক। কিংবা আরও সহজ করে বলা যেতে পারে যে, বার্ধক্য হলো জন্ম-মৃত্যুর অন্তবর্তী জীবনচক্রের এক প্রান্তিক পর্যায়- অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য। এ-ও উল্লেখ্য যে, জরা বার্ধক্য খুব কম ক্ষেত্রেই রুগ্নতা বা মৃত্যুর কারণ হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবকোষ বা দেহযন্ত্রের কর্মক্ষমতা বজায় থাকে। গবেষক নাথান সোক, যিনি ‘ফাদার অব আমেরিকান জেরন্টোলজি’ বলে খ্যাত, তাঁর গবেষণায় লিখেছেন যে, কর্মক্ষমতার এই হ্রাস প্রাপ্তি ঘটে খুব ধীর গতিতে, মূল মজুত ক্ষমতার বার্ষিক এক শতাংশ হারে এবং তা আরম্ভ হয় ত্রিশ বছর বয়সের পর থেকে। তিনি এও হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, এভাবে কর্মক্ষমতার মজুত ভান্ডার পুরোপুরি নিঃশেষ হতে সময় লাগবে প্রায় ১২০ বছর। গবেষকরা এই অভিমতও পোষণ করেন যে, জরা বা বার্ধক্য কোনও রোগ নয়, যদিও কিছু কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা-প্রবণতা এসময় বৃদ্ধি পায় বা পেতে পারে। যেমন, বহুমূত্র, রক্তচাপ বৃদ্ধি, কর্কট রোগ, মেদ বৃদ্ধি, চোখে ছানি পড়া, শ্রবণশক্তিলোপ, দাঁত পড়ে যাওয়া, দুর্ঘটনা প্রবণতা ও তার ফলে হাড় ভাঙা, হাড়ের বিভিন্ন অসুখ, পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেস গ্রন্থির বৃদ্ধি ও মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুচক্র থেমে যাওয়ার ফলে উদ্ভূত সমস্যা ইত্যাদি এবং অবশ্যই অ্যালাজাইমারের অসুখ।

জরা বা বার্ধক্য সম্পর্কে সমাজে, এমনকি শিক্ষিত ভদ্রজনের মধ্যেও নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। এখানে তারই কয়েকটি উল্লেখ করা হল: ১) অনেক শিক্ষিত বিদ্বান ব্যক্তিরাও মনে করেন যে, বৃদ্ধদের সংখ্যা উন্নত দেশগুলোতেই অধিক কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক তার উল্টো। সারা পৃথিবীর ষাটোত্তীর্ণ বয়স্ক জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে । ২) বৃদ্ধ বা বয়স্করা সবই এক রকম, এ জাতীয় ভ্রান্ত ধারণাও আছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিজন বয়স্ক মানুষ অন্যজনের থেকে শারীরিক-মানসিক গঠন অথবা সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই পার্থক্যের জন্য লিঙ্গভেদ, জাতিভেদ, ভৌগোলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশের ভিন্নতা যেমন দায়ী হতে পারে তেমনি জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কুশলতা-অভিজ্ঞতাও বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে। পুরুষ ও মহিলার মধ্যেও প্রভেদ বর্তমান। মহিলারা এক্ষেত্রে, জৈবিক কারণেই কিছু বাড়তি সুবিধা উপভোগ করে, যার দরুন বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বয়স্কতম মানুষটি সচারচর পুরুষ নয়, মহিলাই হয়ে থাকে। ৩) বার্ধক্য মানেই দুর্বলতা বা অক্ষমতা, এরকম ধারণাও যথার্থ নয়। ‘বয়স হওয়া মানেই স্বচ্ছতাকে বিদায় দেওয়া’ কিংবা ‘জরা মানেই জড়তা’ নয়। বয়স্কদের এক বিরাট অংশ কর্মক্ষমই থাকে না, তারা শুধু সামাজিক দায়িত্ব পালনেও সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ভিসি ওসমান গণি তার উজ্জ্বল উদাহরণ। আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ এবং জাতিসংঘ মহাসচিব নিজেও ষাটোত্তীর্ণ। আসলে বয়োবৃদ্ধ মাত্রই অসমর্থ এ রকম ‘মিথ’ গড়ে ওঠার মূলে রয়েছে সামাজিক শ্রমদানের ক্ষেত্রে বয়স্কদের বিযুক্তি। বস্তুত বার্ধক্যের অধিকাংশ সমস্যাই কর্মবিরতি বা কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর গ্রহণের পর দেখা দেয়। ৪) বয়স্করা আর্থিক দিক দিয়ে পরনির্ভর এবং এর ফলে সমাজের কাছে আর্থিক বোঝা স্বরূপ এরকম ভাবনাও বাস্তবের সঠিক প্রতিফলন নয়। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধদের অবদান নেহায়েত কম নয়। আর্থিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য পরিকল্পনা খাতে সরকারি ব্যয় কমানোর উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের ফলেই অর্থনীতির ক্ষেত্রে বয়স্কদের অবদান বা অবদানের সামর্থ উপেক্ষিত হয়।

বয়োবৃদ্ধজনের বার্ধক্যের সমস্যাকে কেবল স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা বা অর্থনৈতিক দায় হিসাবে দেখাটা ভুল হবে। বরং এর সামাজিক গুরুত্ব অনুধাবন করেই সমাধানের সূত্র খুঁজতে হবে আমাদের। এক্ষেত্রে লক্ষ্য কী হওয়া উচিত? লক্ষ্য হওয়া উচিত স্বাস্থ্যকর ও সক্ষম বার্ধক্য অর্জন। বার্ধক্য যাতে সমাজ বিযুক্তি ও অবসর যাপনের ছুতো না হয়ে জীবনের প্রসারণ হিসাবে গণ্য হয় এবং এক অর্থপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন সৃষ্টিশীল সক্ষমতায় উন্নীত হয় তার জন্য গোটা সমাজকে সচেষ্ট হতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে যা জরুরি তা হলো:

১) বয়োবৃদ্ধদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন: আগেকার দিনে যৌথ পরিবারে বয়স্কদের আলাদা মর্যাদা ছিল, কিন্তু ‘তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান, এই আমাদের পৃথিবী’Ñ এরূপ আধুনিক অণু পরিবার বা মাইক্রো ফেমিলি সিস্টেমে বৃদ্ধরা প্রায়শই অবাঞ্ছিত। এই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিকতা বয়স্কদের মানসিক চাপ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অথচ একথা অস্বীকার করার কি উপায় আছে যে, শিশুদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে কোনও পরিবারের মাথার উপর দাদা-দাদীর অভিভাবকত্ব বিকল্পহীন?

২) আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা: বয়স্করা যেহেতু তাদের জীবনের সুবর্ণ সময় সমাজের জন্য ব্যয় করেছে কাজেই তার স্বীকৃতিস্বরূপ বয়সকালে তাদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব সমাজ এবং রাষ্ট্রকেই নিতে হবে- অবসরকালীন ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে। এই স্বীকৃতি বয়স্কদের অবশ্যই সৃজনশীল ভূমিকা পালনে অনুপ্রাণিত করবে এবং বার্ধক্যের অনিবার্য অসুবিধাগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতেও সাহায্য করবে।

৩) স্বাস্থ্যরক্ষার দিকে নজর দেওয়া: পরিবারের সদস্যদের সাথে রাষ্ট্রকেও এ বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। উন্নত দেশে বয়স্কদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ বিভাগ জেরন্টোলজি বা জেরিয়েট্রিক মেডিসিন রয়েছে। এদেশে বিষয়টি এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। বয়স্কদের প্রতি তরুণ প্রজন্মের চিকিৎসকদের দৃষ্টিভঙ্গীর বহুলাংশে সামাজিক নেতিবাচক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত, যার ফলে শুশ্রæষার গুণগত মানের তারতম্য ঘটে। মেডিক্যাল কলেজগুলোতে তাই বয়স্কদের শুশ্রæষা সংক্রান্ত বিভাগ বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা এবং যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি।

৪) সামাজিক সংযোগ স্থাপন: বয়স্করা যাতে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত না হয় তার জন্য, পরিবারের বাইরে সভা-সমিতি, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় সংগঠন ইত্যাদির মাধমে সামাজিক সংযোগ গড়ে তুলতে হবে।

৫) স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি: সক্রিয় ও সক্ষম বার্ধক্য অর্জনের লক্ষ্যে বয়স্কদের পরিমিত ও উপযুক্ত আহার, শরীর চর্চা ও বিশ্রাম, আমোদ প্রমোদ ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যাতে তারা সময়ের সঙ্গে নিজেদের সহজেই মানিয়ে নিতে পারে।

৬) প্রবীণ বয়সে সবার জন্য শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা ও চিন্তা ভাবহীন শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় জীবন যাপনের নির্দেশনা দেয়া।

৭) বার্ধ্যকের কারণ, ধরণ, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে অনুসন্ধানীয় ও সেবা প্রদান।
৯) প্রবীণদের আর্থিক, সামাজিক , পারিবারিক ও অন্যান্য সমস্যা অনুসন্ধান ও তার সমাধান।
১০) প্রবীণদের কল্যাণার্থে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা।
১১) সক্ষম প্রবীণদের আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডের ব্যবস্থা করা।

উপরোক্ত পরিকল্পনা সার্থক করে তুলতে হলে কেবল সরকারি উদ্যোগ ও বদান্যতার উপর নির্ভর করলেই চলবে না, ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পক্ষেত্র ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও উদ্যোগী হতে হবে। বার্ধক্য সম্পর্কে মানসিকতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স থেকেই শুরু করতে হবে। কেননা গতকালের শিশু এবং আজকের প্রাপ্তবয়স্করাই আগামী দিনের বয়স্ক নাগরিকে পরিণত হবে।

প্রাচীন যুগে ‘জরা’ বা ‘বার্ধক্য’কে কিন্তু বাস্তবসম্মত দৃষ্টি দিয়েই বিচার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বার্ধক্য সে যুগে মোটেই অমর্যাদাকর কিংবা ভীতিপ্রদ ছিল না বরং বয়স্কদের জীবনযাপনের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হত। আগেকার দিনে বয়স্কদের মধ্যে, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন হয়ে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্খা ছিল। নিঃসন্দেহে তা ছিল জীবনের প্রতি চূড়ান্ত সম্মান প্রদর্শন। ‘শতায়ু’ হওয়ার আশীর্বাদ প্রদান খুবই প্রচলিত ছিল সে যুগে। এর একটা কারণ বোধহয় এই জীবনকে সে যুগের মানুষ দিন-মাস-বছরের হিসাবেই পরিমাপ করেনি, যাপনের যোগ্যতার মধ্যেই জীবনের যথার্থ মূল খুঁজে পেয়েছিল। সময়ের অতিক্রান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত বার্ধক্যের ফলে অনিবার্য দেহক্ষয় অপ্রতিরোধ্য জেনে ধ্যান-যোগের মাধ্যমে এক ‘বয়সহীন সত্তা’-র উপলব্ধির মধ্যে আত্মআবিষ্কার ও মোক্ষ লাভ করতে চেয়েছে, সে যুগে এর চেয়ে বাস্তব ও সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গী আর কিছু হতে পারত না।

আধুনিক বার্ধক্য-বিজ্ঞান ও বার্ধক্য-ভীতি এড়ানোর উপরই বিশেষ গুরুত্ব দিতে চেয়েছে এবং বৃদ্ধনিবাস ইত্যাদির পরিবর্তে পরিবারের চৌহাদ্দি ও সামাজিক পরিধির মাধ্যমে বয়স্কদের বার্ধক্য-ভীতি-মুক্ত স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে মান্যতা দেবার পরামর্শ দিয়েছে, যাতে বিচ্ছিন্নতার বেদনাবোধ ছাপিয়ে ভালোবাসা ও জীবন-তৃষ্ণা তীব্রতর হয়। বার্ধক্যকে এভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও অন্তত পক্ষে বিলম্বিত করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে সাধারণত আমরা যেভাবে বছরের হিসাবে কারও বয়স্কতা নিরূপণ করে থাকি তার সঙ্গে সেই ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক কিংবা সামাজিক বয়স্কতা সব সময় সঙ্গতিপূর্ণ বা এক নয়। এমনকি বহুক্ষেত্রে একই ব্যক্তির বয়স বৃদ্ধির অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো ও জীবনযাপনের ধরন প্রক্রিয়ার মধ্যেও অসামঞ্জস্য বিদ্যমান থাকে। কাজেই সময়ের অতিক্রান্তির নিরিখে বয়স্কতাকে বিচার না করে আমরা যদি কর্মময়তা ও সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে দেখার অভ্যাস করি তাহলেই বার্ধক্য অকর্মণ্যতার সমার্থক না হয়ে অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, Add life to years, not merely years to life.. এই জীবন যোগ করাই আসল কথা, শুধু কয়েকটা বছর আরও যোগ করা নয়। আমাদের চিন্তা ও পরিকল্পনাকে এই খাতে বইয়ে দিতে পারলেই আমরা একবিংশ শতাব্দীর প্রত্যাহানের মোকাবিলা করতে সমর্থ হবো, যে প্রত্যাহানের মর্মার্থ হচ্ছে, জীবনের মানোন্নয়ন কেবল নয়, বয়স্কতার মানও উন্নত করা। বার্ধক্য হলো দ্বিতীয় শৈশব, জীবনের প্রস্থানভূমি নয়। আজকের এই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিকতা ও দুর্নীতির যুগে নিস্বার্থ বয়স্করাই সামাজিক বিবেকীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে। প্রবীণের প্রজ্ঞাই পারে যৌবনের জোয়ারকে সংযত-সংহত করে সঠিক দিশা দিতে, সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখতে। একুশ শতাব্দীর প্রবীণ ও বয়স্করা শিরদাঁড়া-সোজা করে মুখে ¯িœগ্ধ হাসি নিয়ে পথে-ঘাটে-মাঠে-ময়দানে তরুণদের প্রীতি-সম্ভাষণ জানাচ্ছে, এই দৃশ্যই আমরা দেখতে চাই। কেননা Time present and time past are both perhaps present in the future.|।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সহসভাপতি প্রবীণ হিতৈসী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান, সিলেট।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments