Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামবৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো

এম এ খালেক 

স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের তেজি ভাব কমছেই না। প্রায় প্রতিদিনই বাজারে ডলারের মূল্য বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও ডলারের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি মার্কিন ডলার তাদের জিম্মায় রাখতে পারবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আশা করছে, এ উদ্যোগের ফলে ডলার আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা সন্দিহান এ উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে। কারণ বাজারে মার্কিন ডলারের দর কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং প্রতিনিয়তই ডলারের মূল্যে অস্থিতিশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে বাজারে ছেড়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটাও বেশিদিন চালানো যাবে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক যদি রিজার্ভ থেকে অনবরত ডলার বাজারে ছেড়ে দিতে থাকে, তাহলে অচিরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়বে। সেই অবস্থায় রিজার্ভকে স্ফীত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বর্ধিত আকারে ঋণ গ্রহণের কোনো বিকল্প থাকবে না।

কিন্তু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতোমধ্যেই কমতে শুরু করেছে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। এরপর থেকেই রিজার্ভ কমতে শুরু করে। সর্বশেষ হিসাব মোতাবেক, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অবশিষ্ট ডলার রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। কাজেই সেই অর্থকে রিজার্ভে দেখানো ঠিক নয়। এটা আন্তর্জাতিক রীতির পরিপন্থি।

বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে রিজার্ভের পরিমাণ স্ফীত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এমনকি আইএমএফের কাছ থেকেও কঠিন শর্তে ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণের জন্য আবেদন জানিয়েছে। আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হলে এমন কিছু শর্ত মানতে হবে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ইত্যাদি সংস্থা থেকেও ঋণ গ্রহণের চেষ্টা চলছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে মার্কিন ডলার ছেড়ে স্থানীয় মুদ্রার মান বজায় রাখার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তার বাস্তবতা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, এ মুহূর্তে রিজার্ভ থেকে মার্কিন ডলার বাজারে ছেড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে তা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ এতে ডলারের রিজার্ভ কমে যাবে। বরং ডলারের বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াটাই যৌক্তিক। এতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করা যাবে। এ ছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ করার কথা নয়।

২০০৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট চালু করে। এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিন বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিত। কিন্তু ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট চালু হওয়ার পর মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। তারা প্রত্যক্ষভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক পরোক্ষভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে।

বাজারে মার্কিন ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রার চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট মুদ্রা কিছু পরিমাণে বাজারে ছেড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা চালায়। আবার কোনো সময়ে ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রার জোগান বেশি হয়ে স্থানীয় মুদ্রার অতিমূল্যায়ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে কিছু মুদ্রা তুলে নেয়। এভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

বাজারে মার্কিন ডলারের তেজি ভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত ১ সেপ্টেম্বর ৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার বাজারে ছেড়েছে। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের ২ মাস ১ দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক মোট ২৫৬ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার বাজারে ছেড়েছে। আগের অর্থবছরে বাজারে ডলারের জোগান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্রয় করেছিল। এভাবে ডলার ক্রয় অথবা বিক্রি করার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ খুব একটা কার্যকর বলে প্রতীয়মান হবে না। কারণ ডলারের বিনিময় হার যদি বাজারের চাহিদা ও জোগানের ওপর ছেড়ে দেওয়া না হয়, তাহলে প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করা যাবে না।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশকেই মার্কিন ডলারের গতি-প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলে কোনো মুদ্রার অস্তিত্ব না থাকলেও মার্কিন ডলার তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে অনেকটাই আন্তর্জাতিক মুদ্রার রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বের মোট বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৬২ শতাংশই মার্কিন ডলারে সংরক্ষিত হয়।

আর্থিক লেনদেনের ৮৫ শতাংশই মার্কিন ডলারের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। বিশ্বে এমন কোনো দেশ সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে মার্কিন ডলার গৃহীত হয় না। বাংলাদেশে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্রিটিশ পাউন্ডের মাধ্যমে রিজার্ভ সংরক্ষণ করা হতো। পরে মার্কিন ডলারের মাধ্যমে রিজার্ভ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৭৫ শতাংশই মার্কিন ডলারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। অবশিষ্ট রিজার্ভ আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস, ইউরো, পাউন্ড, ইউয়ানে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

বর্তমানে স্থানীয় মুদ্রা বাজারে মার্কিন ডলারের যে উত্থান-পতন লক্ষ করা যাচ্ছে, তার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। তবে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে রপ্তানি আয় বেড়েছে। তবে রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না।

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্যবৃদ্ধির কারণে যদি আমদানি ব্যয় বেড়ে থাকে তাহলে রপ্তানি আয় তো একইভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কারণ আগে পণ্য রপ্তানি করে যে অর্থ আয় করা সম্ভব ছিল এখন তার চেয়ে কম পণ্য রপ্তানি করে সেই পরিমাণ অথবা তার চেয়ে বেশি অর্থ আয় করা সম্ভব। কিন্তু ব্যাপারটি সেভাবে ঘটছে না। এর অর্থ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কোনো অসংগতি ঘটছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ পাচার হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে।

আমদানি বাণিজ্যের নামে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। এর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। গত কয়েক বছরের মধ্যে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই আশার খবর। কারণ ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে অর্থনীতিতে গতিশীলতা সৃষ্টি হওয়া। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়েছে? ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বাড়লেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে জুলাই মাসের তুলনায় আগস্ট মাসে আমদানির জন্য এলসি খোলার হার ৩৩ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির জন্য খোলা এলসির হার কমেছে ৫৫ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ বাড়ালেও তা শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে না। তাহলে এই বাড়তি অর্থ কোথায় যাচ্ছে? আমাদের দেশের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর দেশ থেকে মুদ্রা পাচার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ২০২৩ সালের শেষদিকে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আসন্ন নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল হবে। যারা রাজনৈতিক পরিচয়ে ফায়দা লুটছেন, তারা দেশের বাইরে অর্থ পাচার করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা মনে করছেন, যদি সরকার পরিবর্তন হয় তাহলে তাদের বিপদ হতে পারে। তাই তারা আগে থেকে মুদ্রা স্থানান্তর করছেন। স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের ব্যাংক রেট এবং কার্ব মার্কেট রেটের মধ্যে সাধারণত এক টাকা থেকে দুই টাকা ব্যবধান থাকে। কিছুদিন আগে এ ব্যবধান ১২ টাকায় উন্নীত হয়েছিল। এতে বোঝা যায় অন্ধকার জগতে মার্কিন ডলারের চাহিদা কতটা বেড়েছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। এটা মোটেও বাস্তব অবস্থার চিত্র নয়। কারণ করোনা মহামারি সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছেন। তারা যে অর্থ প্রেরণ করছেন তা কোথায় যাচ্ছে? তারা দেশে অর্থ ঠিকই পাঠাচ্ছেন, কিন্তু সেই অর্থ বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে না এসে হুন্ডির মাধ্যমে আসছে।

কাজেই স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক রাখতে হলে প্রথমেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে মুদ্রা পাচারের প্রবণতা রোধ করতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বৈধ চ্যানেলে দেশে প্রেরণ করেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা করা ছাড়া কোনোভাবেই মুদ্রা বাজারের অস্থিতিশীলতা রোধ করা যাবে না।

এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments