Friday, April 19, 2024
spot_img
Homeজাতীয়বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর বছর

বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর বছর

দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার কারাবন্দী, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধ্বস পরাজয়ে পর কিছুটা থমকে দাঁড়িয়েছিল বিএনপি। পরবর্তীতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেবল সংগঠন শক্তিশালী করতে মনোযোগী হন। বিএনপির স্থায়ী কমিটি থেকে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত কমিটিকে ঢেলে সাজান তিনি। একইভাবে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, ছাত্রদলসহ অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আসে পরিবর্তন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাবেক ছাত্র নেতা ও ত্যাগীদের হাতে তুলে দেয়া হয় দল ও সংগঠনের দায়িত্ব। সংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষে ২০২২ সালের জুলাই থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামে বিএনপি। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌর, থানা, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় সকল পর্যায়ে সংগঠনের শক্তি পরীক্ষা করতে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালন করা হয়। রাজপথ দখলের লড়াই-সংগ্রামে ফের প্রাণ ফিরে পেয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি। এসব কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে গত ৫ মাসে ১৬ জন নেতাকর্মী নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে বিএনপি। সারাদেশে ধারাবাহিক কর্মসূচি এবং এসব কর্মসূচিতে বিপুল সংখ্যক কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন দলের নেতারা।

বিশেষ করে বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোতে পথে পথে বাধা, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, পরিবহন ধর্মঘটের পরও লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রমের কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ নিময়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মূল্যায়ন বছর শেষে রাজপথ দখলের শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিএনপি

গতবছরের শুরুতে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে ৩৮ জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে বিএনপি। ফেব্রুয়ারি থেকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে এবং সরকারবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সকল বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ন্যূনতম ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক শুরু করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। মার্চ-এপ্রিলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। মে থেকে বিএনপির সঙ্গে বিরোধী দলগুলো একই সূরে কথা বলতে শুরু করে। এসব দলের নেতারা বলেন, শেখ হাসিনা এবং ইভিএমে কোন ভোট হবে না, হতে দেয়া হবে না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোন নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না। সরকার পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেয়ার পরই নির্বাচনের বিষয়ে চিন্তা করবেন তারা।

জুন থেকে ২০ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ জোটের বাইরে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেন। আলোচনা চলাকালে ন্যূনতম ইস্যুতে এসব দলের নেতারা যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে সম্মত হন। জুলাই মাসে সারাদেশে লোডশেডিং, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মাঠে নামে বিএনপি। ৩১ জুলাই সারাদেশের জেলা শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে গেলে ভোলায় পুলিশের গুলিতে ২জন নেতা নিহত হন। ২২ আগস্ট থেকে লোডশেডিং, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বেগম খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌর, থানা এবং পরবর্তীতে জেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বিএনপি। এসব কর্মসূচি পালনকালে প্রায় প্রতিটি সমাবেশেই বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দেখাতে সক্ষম হয় দলটি। এরই মধ্যে ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনকালে নারায়নগঞ্জে শাওন নামে যুবদল কর্মী নিহত হন এবং পরবর্তীতে মুন্সিগঞ্জেও শাওন নামে বিএনপি কর্মী নিহত হন। আগের দাবিগুলোর সঙ্গে নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে ১২ আগস্ট থেকে ১০ বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশের ঘোষণা দেয় বিএনপি

১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম দিয়ে এই সমাবেশ শুরু হয় এবং শেষ হয় গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গোলাপবাগের সমাবেশ দিয়ে। এসব সমাবেশের প্রায় প্রতিটিতেই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন বিএনপি নেতারা। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে নেতাকর্মীদের আসার পথে বাধা প্রদান, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি, অভিযান, সড়ক ও নৌ পরিবহন ধর্মঘটের ঘটনা ঘটে। ফলে নেতাকর্মীরা পায়ে হেটে, রিক্সা, ভ্যানে, সাইকেলে, নৌকায় যে যেভাবে পেরেছে দুই-তিন দিন আগে থেকেই বিএনপির সমাবেশস্থলে এসে উপস্থিত হয়। নেতাকর্মীদের উপস্থিতির কারণে এক দিনের বিভাগীয় সমাবেশ রূপ নেয় তিন দিনের সমাবেশে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর, বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী ও ঢাকা সবগুলোতেই দেখা গেছে একই চিত্র।

তবে এসব সমাবেশের মধ্যে ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশ ভিন্ন মাত্রায় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ঘোষণা করেন ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে বেগম খালেদা জিয়ার কথায় এবং কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানে দেশে ফিরবেন। বিএনপির এই ঘোষণার পর ঢাকার গণসমাবেশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। যার ফলে গত ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশ-বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে নয়াপল্টন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই ঘটনার পর ওই রাতেই নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিএনপির সিনিয়র নেতা আমান উল্লাহ আমান, আব্দুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ফজলুল হক মিলনসহ সাড়ে ৪শ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই রাত থেকেই ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয়াপল্টন সড়ক ঘিরে রাখে পুলিশ। এসময় কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হয়। এদিকে নয়াপল্টনের ঘটনার পর ঢাকার গণসমাবেশ স্থল নিয়ে শুরু হয় নানা নাটকীয়তা। পুলিশের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলেও বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করার বিষয়ে অনড় থাকে। পরবর্তীতে দফায় দফায় বৈঠকের পর গোলাপবাগে অনুমতি পায় বিএনপি। কিন্তু এর আগে ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উত্তরার বাসা থেকে এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে তার শাহজাহানপুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থা-ডিবি। পরবর্তীতে তাদেরকে নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় উস্কানিদাতা হিসেবে মামলার আসামী দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের জামিনের জন্য ৪বার আবেদন করা হলেও প্রতিবারই নামঞ্জুর করে দেন আদালত।

সংঘর্ষ পরবর্তীতে রাজধানীজুড়ে পুলিশের কঠোর অবস্থান এবং বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মোড়ে মোড় পাহাড়ার মধ্যেই ১০ ডিসেম্বর রাজধানী গোলাপবাগে গণসমাবেশ করে বিএনপি। অনুমতি পাওয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যেই ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে সমাবেশস্থল। পরেদিন গোলাপবাগকে কেন্দ্র করে বিএনপির গণসমাবেশ ছড়িয়ে পড়ে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মুগদা-বাসাবো, কমলাপুর পর্যন্ত। ওই সমাবেশ থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি ঘোষণা করা হয় এবং এই দাবী আদায়ে ২৪ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। একই দিন সমাবেশ থেকে সংসদে থাকা বিএনপির ৭ এমপি জাতীয় সংসদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ১১ ডিসেম্বর তারা পদত্যাগও করেন। যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও চলে নানা জোট গঠনের প্রক্রিয়া।

মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, আসম রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, গণঅধিকার পরিষদ ও গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতন্ত্র মঞ্চ।
জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, এনডিপি, বাংলাদেশ এলডিপি, মুসলীম লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জাতীয় দল মিলে গঠিত হয় ১২ দলীয় জোট।

একইভাবে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, জাগপা, ডেমোক্রেটিক লীগ, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, ন্যাপ ভাসানী, গণদল, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ মাইনোরিটি পার্টি মিলে গঠিত হয় ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট।
২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন থাকায় এবং রংপুরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কারণে ঢাকা ও রংপুর ছাড়া সকল জেলা শহরে গণমিছিল করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। আর বছরের শেষ দিকে ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীতে ব্যাপক শোডাউন দিয়েছে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। পৃথকভাবে ওইদিন রাজপথে নামে বিএনপি, এলডিপি, জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমান জোট এবং গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য। গণমিছিল কর্মসূচি পালনকালে ওইদিন রাজধানীতে জামায়াতের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১০ ডিসেম্বরের পর ৩০ ডিসেম্বরেও রাজধানীতে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ গণমিছিল করে নিজেদের শক্তি জানান দিয়েছে বিএনপি। সেখান থেকে যুগপৎ আন্দোলনের দ্বিতীয় কর্মসূচি আগামী ১১ জানুয়ারি অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments