Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeধর্মবাঙালি নারীর সহায়তায় গড়ে ওঠা মক্কার প্রাচীন মাদরাসা

বাঙালি নারীর সহায়তায় গড়ে ওঠা মক্কার প্রাচীন মাদরাসা

১৯৩২ সালে আবদুল আজিজ আলে সৌদের নেতৃত্বে সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে মক্কা শহরে খুবই অল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। মুসলিমরা সাধারণত শিশু-কিশোরদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মসজিদে পাঠাত। এরপর মক্তব, এরপর স্থানীয়দের পরিচালিত কোনো মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো। আর পবিত্র মসজিদুল হারাম প্রাঙ্গণ ঘিরে অনেক বড় আলেমের দরস হতো। আশপাশে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানও ছিল। তবে তাদের পাঠদান কার্যক্রম সুসংগঠিত ছিল না। ফলে হারাম শরিফে বড় বড় আলেমদের হালকায় পাঠদানে এর প্রভাব থাকত।

তখন মক্কার বিখ্যাত কয়েকটি মাদরাসা হলো, ১২৯১ হিজরিতে প্রতিষ্ঠিত আল মাদরাসা আল সাওলাতিয়া। ১২৯৬ হিজরি শায়খ আবদুল হক কারি প্রতিষ্ঠিত আল মাদরাসা আল ফখরিয়া, শায়খ আবদুল খালেখ বাঙালি প্রতিষ্ঠিত দারুল ফায়িজিন ইসলামিয়া মাদরাসা ও আল মাদারিস আল হাশিমিয়াহ, দারুত তাওহিদ। এগুলোর মধ্যে মাদরাসা আল সাওলাতিয়া ছিল সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠান। যার শিক্ষা কার্যক্রম এখনো চলছে। ১২৯১ হিজরি মোতাবেক ১৮৭৩ সালে বিশ্বখ্যাত ভারতীয় আলেম আল্লামা রহমতুল্লাহ কিরানাবি (রহ.) ঐতিহ্যবাহী আল সাওলাতিয়া মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু থেকেই ভারতবর্ষের প্রচলিত দরসে নেজামির পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে সেখানে পাঠদান করা হয়।

মাওলানা রহমতুল্লাহ কিরানাবি (রহ.) ১৮১৮ সালে দিল্লির মুজাফফরনগর জেলার কাইরানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.)-এর বংশধর। তার বাবা মাওলান খলিলুর রহমান ছিলেন প্রাজ্ঞ আলেম ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তার পূর্বপুরুষ বিখ্যাত চিকিৎসক হাকিম আবদুল করিম মোগল সম্রাট আকবরকে সুচিকিৎসা দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজ সরকার সময়ের সচেতন আলেমদের গ্রেপ্তার শুরু করে। ১৮৫৪ সালে শায়খ কিরানাবি গ্রেপ্তার থেকে বাঁচতে মক্কায় আসেন। পবিত্র হারাম শরিফে এসে তিনি প্রবীণ আলেমদের মজলিসে অংশগ্রহণ শুরু করেন। শাফেয়ি মাজহাবের ইমাম ও হিজাজের গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা আহমদ বিন জাইনি দাহলানের দরসেও তিনি বসতেন। দরসের প্রশ্ন ও ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যমে তাদের মধ্যে পরিচয় হয় এবং তিনি তাঁকে মসজিদে হারামে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর প্রায় ৩০ বছর তিনি মসজিদে হারামে পাঠদান করেন।

মাওলানা রহমতুল্লাহ কিরানাবি (রহ.)-এর দেশত্যাদের পেছনেও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। তা হলো, ফান্ডার নামে এক খ্রিস্টান পাদ্রি বিভিন্ন অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে মুসলিমদের চ্যালেঞ্জ করা শুরু করে। সবশেষে বাধ্য হয়ে মাওলানা রহমতুল্লাহ তার সঙ্গে বিতর্ক করে তাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার পাদ্রির পক্ষাবলম্বন করে রহমতুল্লাহর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। তিনি আত্মগোপনে চলে গেলেও ব্রিটিশ সরকার তার সন্ধানে এক হাজার রুপি পুরস্কারের ঘোষণা দেয়। ফলে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন।

এদিকে ভারতে পরাজিত হয়ে সেই পাদ্রি কনস্টান্টিনোপলের পথেঘাটে ঘুরে মুসলিমদের মধ্যে ইসলাম বিষয়ে সংশয় তৈরি করতে থাকে এবং বিতর্কে আসার চ্যালেঞ্জ দিতে থাকে। আর উসমানীয় সুলতান মক্কার গভর্নরকে চিঠি পাঠান, যেন তিনি বিতর্ক করতে রহমতুল্লাহ নামে ভারত থেকে আসা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করেন। শায়খ দাহলান গভর্নরের নির্দেশনা মতে তাকে কনস্টান্টিনোপল পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু মাওলানা রহমতুল্লাহ সেখানে পৌঁছার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সেই ফানদার পালিয়ে যায়। সে আর প্রকাশ্যে আসেনি। এরপর সুলতানের অনুরোধে খ্রিস্টবাদ বিষয়ে অনবদ্য গ্রন্থ ‘ইজহারুল হক’ রচনা করেন। 

কিং আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শায়খ রহমতুল্লাহ হারাম শরিফে দরসের পাশাপাশি ১২৮৫ হিজরিতে নিজ উদ্যোগে প্রথমে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সেখানে সুষ্ঠুভাবে পড়াশোনার কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে জাবালে হিন্দি নামে পরিচিত জাবালে কাইনুকার পাদদেশে দারুস সাকিফায় প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হয়। ১২৮৯ হিজরি সাওলাতুন নিসা বেগম নামে কলকাতার এক নারী মক্কায় হজ পালনে আসেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক সম্পত্তি লাভ করেন। পবিত্র মসজিদে হারামে আঙিনায় ছাত্রদের জন্য একটি ঘর করতে চাইলেন। তার মেয়ের জামাতা শায়খ রহমতুল্লাহর কাছে পড়তেন। শায়খ এ মহীয়সী নারীর ইচ্ছার কথা জানতে পেরে তাকে ঘরের বদলে মসজিদ থেকে দূরে মাদরাসার জন্য একটি ভবন ওয়াকফ করতে বলেন। কেননা তখন মক্কার শিশুদের জন্য একটি সুশৃঙ্খল পরিপূর্ণ মাদরাসার খুবই অভাব ছিল। অতঃপর সেই নারীর সহায়তায় শাইবেক এলাকায় এক খণ্ড জমি কিনে মাদরাসার কার্যক্রম শুরু হয়। ১২৯০ হিজরি ১৫ শাবান আরব উপদ্বীপের পবিত্র কাবাঘরের কাছে খানদারিসা নামক স্থানে নেজামি পাঠক্রমের প্রথম মাদরাসা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। পরের বছর ১২৯১ হিজরি এতে শিক্ষ কার্যক্রম শুরু হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মক্কার স্থানীয় আলেম ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। ওই নারীর নাম অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি সাওলাতিয়া মাদরাসা নামে পরিচিত।

শায়খ রহমতুল্লাহ নিজের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে সেই গ্রন্থাগারেও শিক্ষার্থীরা পড়তে পারত। ১৩৪৪ হিজরি মোতাবেক ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসার পরিদর্শন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজ আলে সৌদি বলেছিলেন, ‘সাওলাতিয়া মাদরাসা আমার দেশের আল আজহারের মতো।’ ১৩০৮ হিজরি ২২ রমজান ৭৫ বছর বয়সে শায়খ রহমতুল্লাহ কিরানাবি (রহ.) ইন্তেকাল করেন।

প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে আছেন হিজাজে হাশিমি রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আল শরিফ হুসাইন, মক্কার শায়খুল উলামা শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজ। দরসে নিজামির ঐতিহ্য ধারণে সালাফদের ইলমচর্চাকে অনুসরণ করে অদ্যাবধি হাঁটু গেড়ে নিচে বসে ইলম অর্জন করেন এখানকার শিক্ষার্থীরা। এ মাদরাসায় শিশু শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে।

সাওলাতিয়া মাদরাসার শরিয়াহ বিভাগের প্রধান ড. ইসমাইল বিন আবদুস সাত্তার আল মাইমানি জানিয়েছেন, এ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। এর শিক্ষার্থীদের মধ্যে মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনও আছেন। মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইমাম মুহাম্মদ বিন সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সৌদি ও বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ মাদরাসার সনদকে সম্মান দেওয়া হয়েছে।

বাংলা পিডিয়ার একটি তথ্যে বলা হয়েছে, হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কি (রহ.) মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তাঁর শিষ্য সাওলাতুন নিসা এর জন্য অনুদান দিয়েছিলেন। ফেনী অঞ্চলের মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক মক্কায় গিয়ে আবদুল হক মুহাজির মক্কির কাছে দীর্ঘ ১১ বছর পড়াশোনা করেছিলেন।

তথ্যসূত্র : কিং আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন, আল আরাবিয়া, উকাজ, জারিদাহ রিয়াদ ইত্যাদি

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments