Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeজাতীয়বাংলাদেশে ড্রাগন ডিপ্লোম্যাসি এবং...

বাংলাদেশে ড্রাগন ডিপ্লোম্যাসি এবং…

বিশ্ববাণিজ্য এবং রাজনীতিতে চীন স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছে বহু আগেই। জাতিসংঘে ভেটো পাওয়ারের অধিকারী চীনই একমাত্র রাষ্ট্র যাদের কারণে বৈশ্বিক ফোরামে পশ্চিমা দুনিয়ার উত্থাপিত প্রস্তাব আটকে যায় অহরহ। যদিও এটা অনেক সময় বাংলাদেশ তথা 
দক্ষিণ এশিয়ার স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। কিন্তু এশিয়া তো বটেই, গোটা দুনিয়াকেই তা মেনে নিতে হয়। কয়েক দশকে চীনের অভাবনীয় উত্থান বিশেষত ড্রাগন ডিপ্লোম্যাসির প্রভাব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীরা তো বটেই, খোদ দেশটির বন্ধু-অংশীদারদের মাঝেও উদ্বেগ রয়েছে। ঋণের শর্তাদি কঠিন হওয়া, আদায়ে কঠোরতা, বড় মাশুল প্রদানের ভয় থেকে ওই উদ্বেগের সৃষ্টি। কিন্তু তারপরও বদলে যাওয়া দক্ষিণ এশিয়ায় ড্রাগনের প্রভাব ক্রমশই বাড়ছে। এর নেপথ্যে অর্থনৈতিক প্যাকেজ। কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে চীনের অস্বাভাবিক তৎপরতার বিষয়ে সতর্ক যুক্তরাষ্ট্র।

ঢাকা সফরকালে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের নজরে এনেছিলেন বলে ওয়াকিবহাল সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য ঢাকায় দায়িত্ব পালন করে যাওয়া চীনের বহুল আলোচিত রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের ভাষায় চীনের অর্থে বিষ নয় বরং আছে নিরাময়। দেশে দেশে চীনের ঋণের ফাঁদ নিয়ে যে নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি এমন নিবন্ধ লিখেছিলেন। বলেছিলেন- বাংলাদেশসহ অন্য দেশের প্রয়োজনে চীন অর্থায়ন করে। তাদের অর্থে রয়েছে আরোগ্য লাভের উপায়। তার ভাষায় উন্নয়নে অর্থের সংস্থান জরুরি। কিন্তু না, নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানি সেদিনও দেখিয়েছেন চীনের ঋণের ফাঁদে কে কীভাবে আটকেছে। তিনি ফাঁদে আটকে যাওয়া কেনিয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। চীনের কাছ থেকে বেল আউট হিসেবে ঋণ নেয়া আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার করুণদশা তুলে ধরেছেন। জানিয়েছেন, লাওসের কথাও। লাউস মহামারির ধাক্কা সামলে ওঠলেও দেনার দায়ে তার জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের বেশির ভাগের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। দেনা থেকে বাঁচতে তার সামনে চীনের হাতে তার ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দেয়া ছাড়া খুব সামান্যই বিকল্প রয়েছে। ঋণের কারণে তাজিকিস্তান পামির পর্বতমালার ১ হাজার ১১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা চীনের কাছে সমর্পণ করেছে এবং বেইজিংকে তার ভূখ-ে সোনা, রৌপ্য এবং অন্যান্য খনিজ আকরিকের খনির অধিকার দিয়েছে। চীনের ঋণের অর্থ শোধ করতে না পেরে শ্রীলঙ্কা তার মহাসাগর অঞ্চলের সবচেয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হাম্বানটোটা এবং তার আশপাশের ৬ হেক্টরের বেশি জমি বেইজিংকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে বাধ্য হয়েছে। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশে চীনের মোহনীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। হেন অফার নেই যা করছে না চীন। সমালোচকরা বলছেন, চীনের খাতির এমন পর্যায়ে গেছে যে, ঢাকার দুুর্দিনের বন্ধু ভারতকেও তারা ছাড়িয়ে যাচ্ছে! বাংলাদেশের স্থল, জল এবং আকাশ পথের অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে পুঁজিবাজার কোথায় নেই চীন? সর্বশেষ- অব্যাহত ডলার সংকটের মুখে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে চীনের মুদ্রা ইয়েনে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেয় বেইজিং। শুধু তাই নয়, এখানকার অনেকগুলো মিডিয়া হাউজের শেয়ারও নাকি নড়াচড়া হচ্ছে। অবশ্য চীন তার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে দেয় না। কিন্তু অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে ভুল করে না। সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে হৈচৈ, তোলপাড় হলেও চীন ওইসব তোয়াক্কা করে না। এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রো-ইন্ডিয়ান, বা প্রো-আমেরিকান টার্ম চালু ছিল। এ নিয়ে রাজপথে মিছিল-মিটিং হতো। নতুন করে এখানে প্রো-চীন খেতাব যুক্ত হয়েছে। অবশ্য দুই দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে আস্থা অত্যন্ত সন্তোষজনক। কেবল একটাই অস্বস্তি। তা হলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইপিএস বা কোয়াডে বাংলাদেশের যোগদান প্রশ্নে ওই অস্বস্তি। যদিও ঢাকার তরফে এ নিয়ে এখনো অস্পষ্টতা বিদ্যমান। চীন মনে করে আইপিএস এ অঞ্চলে বেজায় অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। আইপিএস নিয়ে চীনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত লি জিমিং প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে হুমকি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে এই মন্তব্য করেছিলেন। অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। চীনের দূতকে সমনও করা হয়েছিল। তখন ঢাকার তরফে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির আচরণকে সম্মান না করে বেইজিং তার কাক্সিক্ষত বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। চীনা দূত লি জিমিং অবশ্য বিদায় বেলা ইতিবাচক কথা বলে গেছেন। নতুন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও সম্পর্ক উন্নয়নে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, সম্পর্ক যেভাবে এগুচ্ছে তাতে চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি ভূ-রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ইতিবাচক বয়ান রেখে গেছেন। করোনা সংক্রমণের পুরো পর্বে দুই দেশ হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। চীনের সংকটে পাশে ছিল ঢাকা, বিনিময়ে চীনও সাধ্যমতো সাহায্য করেছে বাংলাদেশকে। কিছু টিকা উপহার হিসেবে দিয়েছে চীন। অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে বেশি টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। চীন থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে মোট সাড়ে ১৭ কোটি ডোজ টিকা কিনেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই টিকা কতো ডলারে কেনা হয়েছে তা এখনো অজানা। টিকা ছাড়াও মহামারির বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইয়ে চিকিৎসাকর্মী, পিপিই ও অন্যান্য সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল চীন। পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনের সহায়তা যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। এটি দুই দেশের বোঝাপড়াকে আরও পোক্ত করেছে। চট্টগ্রামে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। সেখানে অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল হবে। অঞ্চলটিতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, সৌর ব্যাটারি, সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানসহ সম্ভাবনাময় কিছু প্রকল্প হবে। চীন কেবল বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক অংশীদারই নয়, চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানির গন্তব্য বাংলাদেশ।  প্রতিবেশী দেশের উদ্বেগ সত্ত্বেও বাংলাদেশকে দুটি অত্যাধুনিক সাবমেরিন দিয়েছে চীন। সমুদ্র উপকূলীয় কক্সবাজার জেলার পেকুয়ায় এ সংক্রান্ত বেজ নির্মাণে সহায়তা দিচ্ছে বেইজিং। মহেশখালিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণে সহায়তা ছাড়াও কক্সবাজার এবং সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর দু’টির উন্নয়নে কাজ পেয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান। বাণিজ্য আর বিনিয়োগের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির শিল্পকে লক্ষ্য ধরে বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার চীন তাদের বাজারে এ দেশের ৯৮ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা আগেই দিয়েছে। তারপরও বাণিজ্য বৈষম্য বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ প্রায় ৮০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য চীনে রপ্তানি করে। আর চীন থেকে আমদানি করা হয় ১৩শ’ কোটি ডলারের পণ্য। চীনের বিআরআই প্রকল্পের সমর্থক বাংলাদেশে পদ্মা রেল সেতু প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে বেইজিং। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম বিআরআইতে যুক্ত হয়। বিআরআই’র সমর্থন বাংলাদেশকে ৩৮.৫ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ এনে দিয়েছে। যা এ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ। বিআরআই’র আওতায় আরও বেশি সবুজ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিনিময় হতে পারে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশে ঐতিহাসিক সফরে ২৭ প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের সিদ্ধান্ত এসেছিল। যদিও ছয় বছর পর ওই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন খুব ধীরগতি এবং অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও সন্তোষজনক নয়। চীন অবশ্য মনে করে যে, সমঝোতা সই হয়েছিল, তা শুধু বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের ঋণের প্রতিশ্রুতি নয়। এটি বাস্তবায়নে দুই পক্ষের দায় রয়েছে। শুধু চীনের একার নয়। রিপোর্ট বলছে, ২৭ প্রকল্পের এক-তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে অথবা নির্মাণাধীন। অন্য দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে অর্ধেক প্রকল্প বিবেচনাধীন এবং বাকি অর্ধেক এখনো স্থগিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বোঝাপড়া বেশ পোক্ত। তাদের মধ্যে নিয়মিত বিরতিতে নানা পর্যায়ে যোগাযোগ হয়। পারস্পরিক আস্থা অত্যন্ত সন্তোষজনক। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের মধ্যে ফোনে সরাসরি আলাপ, চিঠি বিনিময়, ভিডিও বার্তা আদান-প্রদান হয়। চীনের বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নতুন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংহি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয়ের পাশাপাশি তারা ভূ-রাজনীতির বিষয়ে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বর্তমান সরকারের কার্যক্রমে তারা সন্তোষ ব্যক্ত করে গেছেন। দুই দেশের জনগণের পর্যায়েও ক্রমবর্ধমান বিনিময় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত চীনের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলা ভাষা’র কোর্স চালু করেছে। বাংলাদেশের ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করছে। চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি প্রাদেশিক সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে। ঢাকায় চীনা অধ্যয়নকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলছে। চীনা অধ্যয়নের বিষয়ে দখল আছে- এমন আরও বেশি সংখ্যায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষক তৈরি করতে চাইছে চীন। কেবল বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবক’টি দেশে তারা নিজস্ব বলয় তৈরি করতে চাইছে। এতে বেইজিংয়ের আগ্রাসী মনোভাব দেখা যাচ্ছে। চীনের আকর্ষণীয় প্যাকেজ এবং বহুমুখী তৎপরতায় এ অঞ্চলের দেশে দেশে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। যার কারণে নেপালের (সাবেক) বিদেশমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গ্যায়ালির মুখে ভারতের তীব্র সমালোচনা শুনে এখন আর কোনো বিস্ময় তৈরি হয় না। অথচ একসময় এটা ভাবাই যেতো না! ভারত-পাকিস্তান শত্রুতা কিংবা চীন-পাকিস্তান দোস্তি- কোনোটাই এ অঞ্চলে নতুন নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এমন অনেক ঘটনা ঘটছে, যা একেবারেই অভিনব, হিসাবের বিপরীত। অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, এ অঞ্চলে চীন যেন নতুন ‘দাদা ভাইয়ের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে। আফগানিস্তানে তো রীতিমতো চালকের আসনে ‘ড্রাগন ডিপ্লোমেসি’। ভারতের পুরনো বন্ধু মালদ্বীপের সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতুটি ক’বছর আগে তৈরি করে দেয় চীন। ওই সেতুর বর্ণাঢ্য উদ্বোধনীতে চীনের রাষ্ট্রদূতের গাড়ি ছাড়া অন্যদের আরোহণ সম্ভব হয়নি। যার প্রতিক্রিয়া হয় ভারত, বাংলাদেশসহ অন্যান্য রাষ্ট্রদূতদের মাঝে। লাদাখ সীমান্তে চীন-ভারত উত্তেজনা ছাই চাপা পড়লেও ওই অঞ্চলে টেকসই শান্তি এখনো অধরা। সেই পটভূমিতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনীতির সমীকরণ দিনে দিনে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে থাকা বাংলাদেশ নিয়ে এখন অন্তহীন আলোচনা। এখানে ড্রাগনের প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো তথা দুনিয়াজুড়েই কথাবার্তা হচ্ছে। ঢাকার সামনে এটা এখন এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের মিত্র। এ দেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দিল্লি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ভারতের প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তিস্তা, সীমান্ত হত্যা, রোহিঙ্গাসহ স্পর্শকাতর অনেক ইস্যুতে দুই বন্ধু রাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় ধরার আলামত পাওয়া যাচ্ছে।  চুক্তি সত্ত্বেও করোনাকালে ভ্যাকসিন না পাওয়ার বিষয়টি ঢাকাকে চরম অস্বস্তিতে ফেলেছিল। সেই সময় উপহার হিসেবে কোটি কোটি ভ্যাকসিন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর সাশ্রয়ী মূল্যে তা সরবরাহ করে চীন। অবশ্য এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার দিয়েছিল ভারত, যখন দুনিয়ার বহু দেশের ভ্যাকসিন অনুমোদনই পায়নি। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের মধুরতার কারণেই এ অঞ্চলের অনেক দেশে পাঠানো ভ্যাকসিন উপহারের তালিকায় অগ্রাধিকার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিস্তাসহ দ্বিপক্ষীয় অনেক ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে হতাশা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অতৃপ্তি বা অপ্রাপ্তি বাংলাদেশ-চীনকে কাছাকাছি করেছে। তবে এটিই ঢাকা- বেইজিং সম্পর্কের মূল ভিত্তি নয়। এ সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি অর্থনীতি। যদিও চীন এখন তার কার্যক্রমকে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সীমাবদ্ধ রাখছে না। ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করেছে রাজনীতিকেও। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে হিসাব পাল্টে গেছে। যদিও ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, ঢাকা- বেইজিং হৃদ্যতা দিল্লিকে অগ্রাহ্য করে নয়। এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে ঢাকা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট, যে সংবাদটি দিল্লিকে বেজায় অস্বস্তিতে ফেলেছে তা হলো তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের উন্নয়নে চীনের একটি সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ! যা ঠেকাতে দিল্লির তরফে বেজায় তৎপরতা রয়েছে। তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তিস্তার সমস্যা আমাদের বহুদিন ধরে। তিস্তা বর্ষা মৌসুমে পানিতে ভরে যায় আর শীত মৌসুমে শুকিয়ে যায়। শীতের মৌসুমে যেন তিস্তা শুকিয়ে না যায় এ জন্য পানিটা ধরে রাখতে হবে। এ কারণে তিস্তার অবকাঠামো নির্মাণে অর্থায়ন দরকার। এই অর্থায়ন যদি চীন দিয়ে থাকে এটা তো ভারতের মাথাব্যথা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়ার মূল্যায়ন ‘চীন আসলেই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঋণ হিসাবে এক বিলিয়ন ডলার দেবে তারা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা অবশ্য বলছেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয়টি ঝুলে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে পানির প্রবাহ বাড়াতে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ নামক ওই প্রকল্প প্রস্তাব করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রায় আট হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্প এখনো ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির পর্যায়ে রয়েছে, যা চীন বিনা পয়সায় করে দিচ্ছে। ভারতকে কাউন্টার করতে কোনো প্রকল্প গৃহীত হয়নি।

৬ বছরে প্রতিশ্রুতির ১৪ শতাংশ অর্থ ছাড় করেছে চীন: ২০১৬ সালে চীনের প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সফরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তার ঘোষণা দেন সফরকারী প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। হাই প্রোফাইল ওই সফরের মধ্যদিয়ে দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক কৌশলগত সম্পর্কে রূপান্তর হয়। শি’র সফরে ২৭টি প্রকল্পে ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি মিলে। এ নিয়ে সমঝোতা স্মারকও সই হয়। ২৭ প্রকল্পে ২৪০০ কোটি ডলারের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল। আট প্রকল্পের ঋণচুক্তি সই, ছাড় হয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। ২৭ প্রকল্পের মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩০ শতাংশের কাজ এগিয়েছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত ওই ২৭টি প্রকল্প ছিল। এর মাত্র ১৪ শতাংর্শে অর্থ ছাড় দিয়েছে। প্রকল্পের মধ্যে এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জন্য ছয়টি জাহাজ কেনা, দাসেরকান্দিতে পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প, মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন ও ‘মুরিং’ স্থাপন, বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে তৃতীয় ধাপের উন্নয়ন এবং টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন-এই আট প্রকল্পের জন্য ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি সই হয়। গত অর্থবছরে চীনের সঙ্গে সব মিলিয়ে একটি প্রকল্পে ঋণচুক্তি হয়। আড়াই বছর ধরে প্রকল্পটি নিয়ে দেন-দরবার হয়েছে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জন্য ছয়টি জাহাজ কেনার প্রকল্প নিয়ে এখন দরকষাকষি চলছে। এ বছরেই প্রকল্পটির জন্য ২৫ কোটি ডলার ঋণের বাণিজ্যিক চুক্তি হবে বলে আশা করছে ইআরডি। ঋণচুক্তি হলে আগামী চার বছরে জাহাজ আসবে।

ঋণের অপেক্ষায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প: চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭৮৩ একর জায়গার ওপর নির্মাণাধীন চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের কাজ স্থবির হয়ে আছে ৫ বছর ধরে। গত আগস্ট মাসে জোনটি স্থাপনে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনের (সিআরবিসি) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। যদিও, ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের ঋণ চুক্তি ২০২৫ সালের আগে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য পাইপলাইনে থাকা উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হলো: মোংলা বন্দর অবকাঠামোর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি স্থাপন, ছয়টি জাহাজ ক্রয়, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর সেকশনে বিদ্যমান এমজি লাইনের পাশাপাশি ডিজি ট্র্যাক নির্মাণ এবং পৌরসভাগুলোর জন্য পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, নিষ্কাশন ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নির্মাণ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments