Thursday, April 18, 2024
spot_img
Homeসাহিত্যফেসবুক হচ্ছে সাহিত্যের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট

ফেসবুক হচ্ছে সাহিত্যের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট

কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। নিজ গুণে গুণান্বিত এ কবি বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছেন পাকাপোক্তভাবে। ষাটের দশকের এ কবি বাংলা একাডেমিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন নিরলসভাবে। মানবজমিনকে জানিয়েছেন তার পরিকল্পনার কথা। বলেছেন, পূর্বসূরি বন্ধু হাবীবুল্লাহ সিরাজীর অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেয়ার কথা। তার মতে, প্রকাশনা শিল্পকে পেশাদারিত্বের দিকে যেতে হবে। গড়ে তুলতে হবে কমার্শিয়াল এন্টারপ্রাইজ হিসেবে।ফেসবুকে লেখালেখিকে তিনি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট বলে মনে করেন তিনি। কাট অ্যান্ড পেস্ট করে বই প্রকাশ পেশাদারিত্বের শতভাগ লঙ্ঘন এমনটাই বললেন নুরুল হুদা। বইমেলা, বর্তমান সময়ের লেখালেখি, সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন তিনি মানবজমিন-এর কাছে।
প্রশ্ন: একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে আপনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিলেন, সার্বিক অবস্থা কীভাবে মোকাবিলা করছেন?
সত্যিকার অর্থেই এ সময় দায়িত্ব নেয়াটা আমার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমার আগে যিনি এই দায়িত্বে ছিলেন আমার প্রিয় বন্ধু কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অনেক কাজ শুরু করেছিলেন যা অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তার এই অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করা আমার প্রথম দায়িত্ব। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী নিয়ে যে সকল প্রকল্প একাডেমি গ্রহণ করেছিল বিশেষত প্রকাশনা, সিরিজ অনুষ্ঠান এগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করা। এরপরে আসে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বিদায়ী বছরে কোভিড পরিস্থিতিতে তা যথাযথভাবে করা যায়নি। এবার কোভিড অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ হলেও শঙ্কামুক্ত নই। যদিও প্রকাশক এবং আমরা এই মেলা আয়োজনে উৎসাহী। একটি সফল মেলা আয়োজনে আমরা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছি। তবে দু’বছরের অসমাপ্ত কাজ এই তিন মাসের মধ্যে শেষ করা সত্যি দুরূহ। কখনো কখনো রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। তবু ভালো লাগছে আমার সহকর্মীরা আমাকে সহযোগিতা করছে।  
প্রশ্ন: বাংলা একাডেমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বড় জায়গা হচ্ছে বইমেলা, অনেকেই বলে থাকেন প্রাণের মেলা, এবার প্রস্তুতি কি?
গতবছর বাংলা একাডেমি নিজস্ব প্রক্রিয়ায় অনলাইনে বই বিক্রি শুরু করেছে। এবার তা আরও জোরদার করা হবে। বইমেলার এবারের আয়োজন মাঠেই হবে। আগের মতোই বড় পরিসরে এই আয়োজনের চেষ্টা চলছে। মেলায় প্রবেশের গেট তিনটার পরিবর্তে চারটা করা, খাবারের স্টলগুলো একপাশে থাকে এবার তা মেলার চারপাশে ছড়িয়ে দেয়ার কথা ভাবছি। যেন খাবার খেয়ে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের জগতে মনোনিবেশ করতে পারে। অনেক কিছুই সংযোজন-বিয়োজনের কথা ভাবা হচ্ছে। পুরোপুরি অনলাইন না হলেও হাইব্রিড পর্যায়ে অনলাইন চালুর কথা চিন্তায় আছে মেলাকে ঘিরে। সবকিছুর পরও বলতে হয় যদি কোভিডের আক্রমণ হঠাৎ ছড়িয়ে না পড়ে তবে আগের মতোই মেলা হবে। মেলা ফেব্রুয়ারিতেই হবে।
প্রশ্ন: করোনায় আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে মেলায় আর্থিক প্রণোদনা বা ছাড় দেয়ার বিষয়ে প্রকাশকদের মধ্যে নানান কথা হচ্ছে?
প্রকাশকদের একটি দাবি- দাওয়া সব সময়ই থাকে। তা কোভিড হলেও বা কোভিড না হলেও। এবারও আছে। আমরা বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এ মেলা শুরু হয়েছে ১৯৭২ সাল থেকে। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে পেশাদারিত্বের দিকে যেতে হবে। এটাকে কমার্শিয়াল এন্টারপ্রাইজ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একুশের বইমেলা তো শুরু হয়েছে আশির দশকে। তাহলে তার আগে প্রকাশকরা কি করতো? উদাহরণস্বরূপ মওলা ব্রাদার্স-এর কথা বলতে পারি। তারা কিন্তু মেলাকেন্দ্রিক নয়। সারা বাংলাদেশব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক আছে। ঐ নেটওয়ার্কের ফলে বছরজুড়ে তাদের বই চলে। কাজেই তিন চার দশকের যে স্থাপনা তা যদি একবছরেই ভেঙে পড়ে তাহলে তাকে যতই প্রণোদনা দেয়া হোক না কেন তা টিকবে না। আর যারা থাকবে তাদের শেকড় গেঁড়ে ফেলেছে; সুতরাং তারা টিকবে। প্রকাশকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমরা সরকারের সহযোগিতা নিয়ে যতোটা ক্রেতাবান্ধব, লেখকবান্ধব এবং প্রকাশকবান্ধব হওয়া যায় তার জন্য কাজ করছি। শুধু প্রকাশকবান্ধব হলেই তো একাডেমি তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। লেখার সঙ্গে প্রকাশনার একটি সম্পর্ক আছে। কিন্তু বাংলাদেশে লেখক এবং প্রকাশকের সঙ্গে যে সম্পর্ক তা সবচেয়ে বেশি অপেশাদারিত্বের। বাংলাবাজারে যে বইগুলো তৈরি তার বেশির ভাগই সৌখিনভাবে বা অ্যামেচারভাবে তৈরি হয়ে যায়। পাণ্ডুলিপি তৈরি থেকে শুরু করে সবকিছু। তার ফলে প্রতিবছর চার থেকে পাঁচ হাজার বই বের হয় শুনেছি। তার ভেতর পেশাদারিত্ব বিবেচনায় নিলে, কপিরাইট বিবেচনায় নিয়ে পাঁচশত বইও সত্যিকারের বই কিনা সন্দেহ আছে।    
প্রশ্ন: প্রকাশিত বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন বরাবরই আছে, এত এত টাইটেলের বই বের হয় কিন্তু ফি বছর ক’টি টিকে?
এ প্রশ্ন সবসময়ই হয়ে থাকে। তারপর যখন বিশেষ সময় বা বিশেষ ঘটনা থাকে তখন তো অন্যরকম দেখা যায়। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী চলছে। এ নিয়ে হঠাৎ করে কীভাবে এত লেখক এলো এবং সকলেই একই বিষয় নিয়ে লিখছেন। একই কথা দিয়ে একটির পরিবর্তে দশটি বই বের করা হচ্ছে। যেভাবে এক বিষয় নিয়ে কাট অ্যান্ড পেস্ট করে বই প্রকাশ হচ্ছে এটা কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন, সৃষ্টিশীলতার লঙ্ঘন, পেশাদারিত্বের শতভাগ লঙ্ঘন। এই জায়গাটিতে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মটি আগেও ছিল এবার আমরা আরও সতর্ক থাকবো যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে এর লেখকের সঙ্গে প্রকাশক চুক্তি সম্পাদন করেছেন কিনা? লেখক প্রকাশক যার যা প্রাপ্য তা বুঝে নিচ্ছেন কিনা? এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার লেখক প্রকাশ চুক্তি করা মানে এই নয় যে, লেখককে টাকা দিতে হবে। কোনো লেখক যদি মনে করেন তিনি টাকা নেবেন না সেক্ষেত্রে প্রকাশকের সঙ্গে সে বিষয়ে আলাদা চুক্তি করতে পারেন, এটা কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন নয়। আমরা এটাও জানি লেখক তাদের বইটি প্রকাশের জন্য প্রকাশককে কখনো কখনো টাকাও দিয়ে থাকেন। প্রকাশক কোনদিকে না তাকিয়ে তার বইটি প্রকাশ করেন। এটা কি কোনো পেশাদারিত্ব? কাজেই পেশাদারিত্ব ছাড়া কোনো প্রকাশনা শিল্প আকারে দাঁড়াতে পারবে না। তারপর আরেকটি বড় বিষয় হলো বইয়ের বানান ও সম্পাদনাগত বিষয়।  সম্পাদনা ছাড়া কোনো পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা যায় না। ছাপার আগে যে কোনো পাণ্ডুলিপি বেশ কটি স্তর অতিক্রম করতে হয়। এটা মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা করতেন। সত্তর দশকে আমি তরুণ লেখক হিসেবে মুক্তধারার একজন রিভিউয়ার ছিলাম। সেই রিভিউ টিমের প্রধান ছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বর্তমানে এ কাজটি কি কেউ করছে? আমরা কি করছি, গণহারে বই প্রকাশ করছি। সরকারের বিভিন্ন বই ক্রয়ের তালিকায় বইটিকে যদি  গোছাতে পারি তাহলে কাজ হয়ে গেল। এটা কোনো প্রকৃত প্রকাশকের কাজ হতে পারে না। বাংলাবাজারে দুই ধরনের প্রকাশক আছেন। একধরনের প্রকাশক যারা বাংলাবাজারকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করেন। আর নতুন প্রকাশকরাও বই প্রকাশ করে থাকেন। বাংলা একাডেমি এই দুই ধারার প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে পৃষ্ঠপোষকতা করে।
প্রশ্ন: বই বাজারের মান উন্নয়নে বাংলা একাডেমি আলাদা কোনো উদ্যোগ নেবে কিনা?
এ নিয়ে বাংলা একাডেমির আলাদা উদ্যোগ আছেই। কিন্তু কেউ তা মানতে চায় না। বাংলাদেশে আইন নেই এমন কোনো বিষয় নেই। সকল বিষয়েই আইন আছে। আপনি কক্সবাজার গেলে দেখবেন সেখান পর্যটকদের জন্য টুরিস্ট পুলিশ। এই টুরিস্ট পুলিশরা কি করবে তাদের জন্য পৃথক আইন রয়েছে। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন কোনো বিষয় নেই যার জন্য আইন নেই। এখন দরকার বাস্তবায়ন। আজ থেকে তিন চার দশক আগ থেকেই কপিরাইট বা ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টি রাইটস আইন রয়েছে কিন্তু অনেকেই তা মানছেন না। বাজারে অনেক অনূদিত বই দেখবেন যার কোনোটিই কপিরাইট নেই। আর এগুলো ইংরেজি থেকে বাংলা হয়নি হয়েছে বাংরেজ। এই অনাচারগুলো বন্ধ করতে হবে। অনেকেই বলে থাকেন পাঁচ হাজার বই হলে যে পরিমাণ বিক্রয় হবে পাঁচশত বই হলে কি তত বিক্রয় হবে? আমি বলি অবশ্যই হবে কারণ পাঁচ হাজার বইয়ের ভেতর থেকে সাড়ে চার হাজার তো কোনো বই-ই না। আর যে বইটি ভালো এমন বইয়ের প্রকাশ সংখ্যাও কম। আর এ বইগুলো একশ’ বিক্রি না হয়ে এক হাজার কপি বিক্রি হবে। দোকানে ১০টা শার্ট যদি তৈরি হয়ে থাকে তাহলে তাই চলবে। কথা হচ্ছে- অন্য সাড়ে চার হাজার বইয়ের যে কথা বলা হচ্ছে এগুলো তো স্টলেও ওঠে না। এগুলো শুধু টেলিভিশনে দেখানো হয়, লেখককে দেখানো হয় আর বিজ্ঞাপন হয়ে চলে যায়।
প্রশ্ন: একটি বিতর্ক আছে সব সময়। জনপ্রিয় ধারা আর চিরায়ত ধারা। প্রচুর বই চললেই ভালো লেখক কিনা?
এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এ সমস্যা আছে। পাশের দেশ কলকাতাতে নিমাই ভট্টাচার্য বা নীহাররঞ্জনের কতো বই বিক্রি হয়, একেবারে ছেলেবেলায় ডিটেকটিভ সিরিজের বই প্রচুর চলতে দেখেছি, শরৎচন্দ্রের বইয়ের চেয়ে নিমাই ভট্টাচার্যের বই বেশি চলতে দেখেছি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এমনটি দেখা গেছে। ভিক্টোরিয়ান সময়ে রেনল বলে এক লেখক ছিলেন তার বই মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হতো। স্কট বলে এক লেখকের বই ঠিক ওভাবেই বিক্রি হতো। কিন্তু চার্লস ডিকেন্সের বই তেমন একটা বিক্রি হতো না। কিন্তু ডিকেন্স কি সেই প্রতাপে হারিয়ে গেছে না আজও ভালোভাবে টিকে আছে। অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে সৃষ্টিশীল এবং যত্নশীল প্রকাশনা যে বই তা অনেকদিন ধরে বিক্রি হয়ে থাকে। শেক্সপিয়র বিক্রি হচ্ছে এখনো। তার বই কোটি কোটি কপি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু প্রথম ছাপায় হয়তো হাজার কপিও যায়নি। আমাদের জনপ্রিয় ধারার যেসব বই প্রকাশের পর কাটতি থাকে সেসব বই পাঁচ বছর পর মানুষ নামও মনে রাখে না। ফলে এই ধারা সারা পৃথিবীতেই রয়েছে- আমাদের এখানেও তাই।
প্রশ্ন: আপনাকে জাতিসত্তার কবি বলা হয়ে থাকে, লেখালেখির মাধ্যমেই আপনি সমহিমায় পরিচিত। এ সময়ের লেখালেখি নিয়ে কি বলবেন?
জাতিসত্তার কবি- আমি বলি  না, যারা বলেন এর উত্তর তারা দেবেন। আমি শুধু আমাদের জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে, বাঙালির চেতনাকে ধারণ করতে চেয়েছি আমার কবিতায়। এটা জাতিসত্তার না মানবসত্তার এটা পাঠকের বিবেচনা। আমাকে নিয়ে কেউ পক্ষে বলবে বা কেউ বিপক্ষে বলবে, আমি শুধু ক্যাটালিস্ট মাত্র। আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবো, এ সময়ের লেখালেখি নয়- সব সময় দেখা যায় লেখালেখিতে দু’ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এক পক্ষ লিখতে চায়, কিন্তু জানতে চায় না, পড়তে চায় না। সৃষ্টিকর্তা পবিত্র কোরআন শরীফ শুরু করেছেন, ইক্বরা দিয়ে। না পড়ে কিছু করা যায় না। পাঠ মানে শুধু একটি বই পড়া নয়। ধরা যাক, আমি একটি ফুলের টব নিয়ে কিছু লিখতে চাই। তাহলে আমাকে ফুলের টব নিয়ে পাঠ করতে হবে। আমাকে এই ফুলের টবের ভেতর অবিমিশ্রভাবে দেখতে হবে এর গঠন প্রণালি। তাহলে প্রাকৃতিকভাবেই আমার ভেতর একটি বার্তা আসবে। রসুল কোরআন রচনার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অর্থাৎ তিনি ধ্যানের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের মধ্যে পৌঁছেছিলেন। ধ্যানের মধ্য দিয়ে জ্ঞানে পৌঁছাতে হলে আগে পাঠ লাগবে। আমরা যাকে বলি ইন্টারটেকচ্যুয়ালিটি। প্লেটো বলেছিলেন, অনুকরণের অনুকরণ। আমি তো অনুকরণের অনুকরণ, অনুকরণের অনুকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ পাঠ ছাড়া কিছুই হবে না। মানুষ বর্তমানে শোনে বেশি, কানে কিছু একটা দিয়ে বসে থাকে। চোখ পিক্সেলের ভেতর চলে যায়। তারা পাঠ করে না। আমার ধারণা অন্তর্জালেও পাঠ করা যায় কিন্তু সেই পাঠ অন্তর্জালের মতো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি হাতে পাঠ করবো। আমি মূর্ত মানুষ। আরেকজন মানুষকে জন্ম দিতে হলে আমাকে মূর্ত প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। কাজেই মূর্ত লেখককে যদি ফিরে আসতে হয় তাহলে তার বইয়ের সঙ্গে, পাতার সঙ্গে সংশ্রব থাকতে হবে, বইকে ভালোবাসতে হবে। বইকে সৃষ্টিশীলতার জন্য শৃঙ্গার করতে হবে।
প্রশ্ন: আমরা প্রায়ই বলি সৃষ্টিশীল লেখক বাংলাদেশে কমে যাচ্ছে। কোভিডে আমরা বেশ ক’জন বড় লেখককে হারিয়েছি।
এ প্রশ্নটিতে আমি দ্বিমত পোষণ করি। এরই মধ্যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আনিসুজ্জামান স্যার, শামসুজ্জামান খান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, হাসান আজিজুল হক সবশেষ জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। সকলেই চলে যাবেন- এটাই হয়তো অমোঘ সত্য। আপনি যদি শতবর্ষ পেছনে ফিরে তাকান কি দেখবেন? কারা চলে গেছেন? দীনেশ চন্দ্র সেনের মতো মানুষরা এই বঙ্গ থেকে বিদায় নিয়েছেন। মূল বিষয়টি অন্যত্র। আমি তো বলেছি, বর্তমানে পাঠ কমে যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিক সৃষ্টিশীলতা এবং মননশীলতা এই দুটি আলাদা বিষয়। সৃষ্টিশীল অনেক সময় মননশীলতার কাছে না গিয়েও অনেক সময় মননশীল হয়ে যায়। কিন্তু মননশীলতার জন্য পাঠ এবং সৃষ্টিশীলতার কোনো বিকল্প নেই। সে বিষয়টি আমাদের এখানে কমে যাচ্ছে। আমাদের এখানে ক’দিন আগেও স্লোগান ছিল জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। সেটি এখন কমে গেছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ যতদিন না হবে ততদিন একটি জ্ঞানভিত্তিক বিদ্যোৎসমাজ গড়ে উঠবে না।
প্রশ্ন: তাহলে লেখালেখি কেবল ফেসবুক স্ট্যাটাস, লাইক আর কমেন্টে চলে গেল কিনা?
প্রায় যাচ্ছে বটে তবে আমার ধারণা এটা বেশিদিন অব্যাহত থাকবে না। ফেসবুক হচ্ছে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট, সাহিত্যের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট। এখন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে যা ফেলা হয় তা থেকেও কিছু বেরিয়ে আসে। ফেসবুকে যা লেখা হয় তার ৫ ভাগের বেশি তুল্যমূল্য লেখা না। কারণ লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগে তা সম্পাদিত হতে হয়। তা না হলে নিজের স্ব-সম্পাদিত বা সেলফ এডিটিং করতে হয়। আমাদের এখানে তা একেবারেই হচ্ছে না। তরুণ সমাজের ভেতর তা নেই বললেই চলে। কারণ, তাদের যদি বলা হয় তোমার লেখায় ছন্দ নেই। তাহলে বলবে, আমার ছন্দ জানার দরকার নেই। তাহলে আপনি কি বলবেন? কথা হচ্ছে, ছন্দ যদি ভাঙতে চাও তাহলে ছন্দ জেনে ভেঙে দাও। রবীন্দ্রনাথ কি ছন্দ না জেনে ভেঙেছিলেন? নজরুল কি করেছেন? কাঠামোর বাইরে কে যাবে? আমরা বলি পোস্ট স্ট্রকচার। আগে তো স্ট্রাকচার থাকতে হবে। আগে তো মর্ডানিজম হবে তারপর তো পোস্ট মর্ডানিজম। তারপর পোস্ট পোস্ট মর্ডানিজম। জানতে হলে মানতে হবে, মেনে ভাঙতে হবে। আমি জানি আমি যা সৃষ্টি করছি তা তরুণরা ধ্বংস করে দেবে কিন্তু প্রলয় করে যা সৃষ্টি অর্থাৎ নতুনের কেতন তো তরুণদের উড়াতে জানতে হবে।
প্রশ্ন: মননশীল মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান তো বাংলা একাডেমি। এক সময় তরুণ লেখক প্রকল্প ছিল আবার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা?
আশা করি নতুন উদ্যোগ আসবে। আমাদের যে প্রশিক্ষণ বিভাগ তার দুটি বিভাগ একটি ভাষা প্রশিক্ষণ আর অন্যটি কারিগরি প্রশিক্ষণ। এই দুটি বিভাগকে যুক্ত করে আমরা ২৭ বছরে আগে তরুণ লেখক প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। সেই পদ্ধতিটি আবারো আমরা নতুনভাবে এখানে প্রবর্তনের চিন্তা করছি। ভাষা প্রশিক্ষণের একটি বড় কাঠামো হয়ে যাবে লেখক প্রশিক্ষণ। বাংলা একাডেমির বড় বিষয় হলো ভাষাকে প্রমিত রাখা। ভাষা যেহেতু চলমান এটিকে এক জায়গায় আটকে রাখা যায় না। এটিকে বারবার রিভাইস করতে হয়। এটি এক জায়গায় থেমে গিয়েছিল। এটিও আমরা আবার শুরু করতে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: ভালো লিখতে হলে তরুণদের জন্য আপনার কি পরামর্শ আছে?     
পড়ুন, পড়ুন, পড়ুন তারপর লিখুন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments