Thursday, April 18, 2024
spot_img
Homeজাতীয়তীব্র রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝেও বাংলাদেশের সাফল্যের চাবিকাঠি কি ?

তীব্র রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝেও বাংলাদেশের সাফল্যের চাবিকাঠি কি ?

বাংলাদেশ তার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। একসময় হেনরি কিসিঞ্জার যার সমালোচনা করেছিলেন এখন সেই বাংলাদেশই রোল মডেল হিসাবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০ গুণ বেড়েছে, মাথাপিছু আয় ২৫ গুণ (ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি) এবং খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ। জনসংখ্যা ২.৫ গুণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মাথাপিছু খাদ্য প্রাপ্যতার হার। রপ্তানি ১০০ গুণ বেড়েছে এবং দারিদ্র্যতা ১৯৯০ সালে ছিল ৬০ শতাংশ , তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশে । দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২ হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা ছাড়া বেশিরভাগ সামাজিক সূচক আঞ্চলিক দেশগুলোর তুলনায় বেশ ভালো। মানব উন্নয়ন সূচকের মান বেড়েছে ৬০ শতাংশ।এই অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে গত তিন দশকে। কারণ তার আগে অনেক রাজনৈতিক অস্থিরতার সাক্ষী থেকেছে বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ ছিল কিন্তু আজ তা কমে মাত্র সাত-দশমাংশে নেমে এসেছে।

২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, কোভিড আঘাত হানার আগে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে ছিল – যা পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দ্রুতহারে বেড়েছে। বাংলাদেশের গল্পটি বেশ আকর্ষণীয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য এত ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ কীভাবে তার উন্নত প্রতিবেশী – ভারত এবং পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক সূচককে ছাড়িয়ে যেতে পারে?

বাংলাদেশ বেশ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে। একটি নতুন প্রশাসন গঠন, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের হত্যাকাণ্ড এবং বেশ কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান মোকাবেলা করেছে। সামরিক বাহিনী ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল যখন জেনারেল এরশাদ সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার বিএনপি ১৯৯১ সাল থেকে ক্ষমতায় এসেছে।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ শাসন করেছে, টানা তিনটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তারা। এতো কিছুর মধ্যেও বেগমদের যুদ্ধ তীব্র ও তিক্তই থেকে গেছে।

খালেদা জিয়া নির্বাচন বয়কট করেছেন এবং তার দলের অনেক নেতাসহ বেশ কিছুদিন কারাগারে রয়েছেন। এই ধরনের প্রচণ্ড রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অস্থিতিশীলতার সাথে লড়াই করে কীভাবে দেশটি যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি করতে পারে তা সত্যিই লক্ষ্যণীয় ।

প্রথমত, ভারত ও পাকিস্তানের বিপরীতে, বাংলাদেশ একই ভাষা, জাতিসত্তা ,সংস্কৃতি বহন করে। দেশে কোনো ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, উপজাতিক বিভাজন নেই। গ্রামীণ-শহুরে বিভাজন রয়েছে বটে কিন্তু সেখানে দ্রুত উন্নয়ন হওয়ায় মানুষের মধ্যে অসন্তোষ কম। আরও ভাল করার সাধনা একটি শক্তিশালী সামাজিক নীতি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে কোনো গুরুতর বাহ্যিক হুমকির সম্মুখীনও হতে হয়নি।

দ্বিতীয়ত, সরকারের একক ক্ষমতা প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, আইন এবং আর্থিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রদান করেছে। নীতি এবং এর বাস্তবায়ন একটি চেইন সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে চলেছে, যা সুসংহত। একটি দুর্বল বিরোধী দল এবং শীর্ষে শক্তিশালী নেতৃত্বের অবস্থান মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার মত ক্ষমতা রাখে।

তৃতীয়ত, ১৯৭১ সালের আগেও নারীর ক্ষমতায়ন প্রবল ছিল কিন্তু এনজিও মারফত পরিবার পরিকল্পনা, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ক্ষুদ্রঋণের জন্য সকল স্তরে অব্যাহত প্রচারাভিযান বিষয়টিকে আরো মসৃন করেছে। BRAC, Grameen Bank, ASA ইত্যাদি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রসারে এবং নারীদের ক্ষুদ্রঋণের সুযোগ প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। নিজস্ব ত্রুটিগুলি সম্পর্কে সচেতন সরকার সুশীল সমাজ সংস্থাগুলিকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে এবং এনজিওগুলিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। মহিলাদের কাজে অংশগ্রহণের হার বেড়েছে এবং লিঙ্গ ব্যবধান হ্রাস করেছে।

চতুর্থত, তিক্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক নীতি, প্রকল্প ও কর্মসূচিতে ধারাবাহিকতা রয়েছে। দলগুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর্থিক বিচক্ষণতা, বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ততা, বেসরকারী খাতকে উত্সাহিত করা এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। দেশের পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় যে সরকারের পরিবর্তন হলেও বিনিয়োগকারী এবং বাজারের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

পঞ্চমত , বাণিজ্যিক উদারীকরণ, উদার অর্থনীতি , বিদেশ থেকে প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণ এবং রপ্তানিকারকদের নগদ প্রদানের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে। পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনের ঠিক পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। বেশিরভাগ বৈশ্বিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশে থেকে তাদের উৎপাদন আউটসোর্স করেছে। শিল্পে নারীর কর্মসংস্থান নারীর সামাজিক মর্যাদা এবং পরিবারের মধ্যে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রবেশ ঘটেছে । উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে।

ষষ্ঠত, স্থিতিশীল উচ্চ প্রবৃদ্ধি তখনই সম্ভব হয়েছিল যখন দেশীয় সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের হার ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশে পৌঁছায়। উৎপাদন খাতে ব্যক্তিগত পুঁজির এই বিশাল আধিপত্য এবং পরিকাঠামোতে সরকারি ব্যয় দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধির সহায়ক হয়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স সম্প্রসারণের মাধ্যমে কমানো গেছে আর্থিক ঘাটতি।

এরকম আরো অনেক কারণ আছে। বেসরকারী সেক্টর , রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের মধ্যে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। রাজনীতিবিদরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ পেতেন, আমলারা তাদের স্বল্প বেতনকে উপহার এবং পারিশ্রমিক দিয়ে পরিপূর্ণ করতেন। সেই সুযোগে ব্যবসায়ীরাও তাদের লভ্যাংশ বাড়িয়ে নিতেন। কিন্তু তারা কেউই বিদেশে টাকা নিয়ে যাননি।

বর্তমানে দেশে ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। সরকারকে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতা অবলম্বন করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতির ধারাবাহিকতা, রপ্তানির উন্নয়ন, মানব পুঁজিতে বিনিয়োগ (বিশেষ করে নারী) এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের একসঙ্গে কাজ করা বাংলাদেশের সাফল্যের প্রধান উপাদান।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments