Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামতরুণদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ কতদূরে?

তরুণদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ কতদূরে?

ড. মো. কামরুজ্জামান 

আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের বয়স হলো ৫০ বছর। এই ৫০ বছরে দেশের অর্জন কম নয়। কিন্তু দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। তরুণরা মনে করে, দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। আর রাজনীতিক, আমলা ও বিভিন্ন সেক্টরের ক্যাডাররা এর সঙ্গে জড়িত। তাদের মতে, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, মুটে-মজুররা এর সঙ্গে মোটেই জড়িত নন।

দেশের অনেক রাঘববোয়াল যে এর সঙ্গে জড়িত, ইতোমধ্যে নানা ঘটনায় তার প্রমাণ মিলেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে টাকা উধাও হওয়া রাষ্ট্রীয় চরিত্রের দৈন্যেরই প্রকাশ। সর্বশেষ অপসারিত তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের কর্মকাণ্ডে আমাদের সাংস্কৃতিক মানের একটি পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। এতে বোঝা যায়, দুর্নীতির সর্বগ্রাসী কালো থাবা গোটা দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে।

গত ১৬ ডিসেম্বর পালিত হলো দেশের বিজয়ের ৫০ বছর। প্রতিবছর অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে দেশে বিজয় দিবস পালিত হয়ে থাকে। তরুণদের মতে, বিজয় মানেই হলো বাঁধভাঙা উল্লাস। শিশুদের মতো ভয়হীন পথচলা; যেখানে সেখানে দুরন্তপনা করে বেড়ানো। সব বয়সি ও শ্রেণি-পেশার নারীদের নিরাপদে পথচলা। বিজয় অর্থই হলো স্বস্তি, শান্তি, নিরাপত্তা আর বুক ভরে নিশ্বাস গ্রহণ। বিজয়ের প্রত্যাশা হলো দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত বাংলাদেশ।

বিজয় অর্থ মাদকমুক্ত তারুণ্য আর বেকারত্বমুক্ত বাংলাদেশ। কর্মমুখী ও মানসম্পন্ন শিক্ষা আর শিক্ষাবান্ধব সরকারই হলো তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষা। তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষা হলো, শিক্ষার্থীর সব সুবিধা নিশ্চিত থাকা; লেখাপড়া শেষে একটি চাকরি পাওয়া। আর এ চাকরি পেতে ঘুসের কাছে হার না-মানা। স্বাধীন দেশের অর্থই হলো মেধাবী নতুন প্রজন্মকে মূল্যায়ন করা; দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করে গড়ে তোলা প্রভৃতি।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন তরুণকে চার বছর অনার্স করতে হয়। চার বছর অনার্স করে নতুনভাবে আবার তাকে চাকরির জন্য লেখাপড়া করতে হয়। এর মানে দাঁড়ায়, অনার্সে পড়া চারটি বছর তার কোনো কাজে লাগল না। অর্থাৎ জীবন থেকে চারটি বছর এমনি এমনি ঝরে গেল! অথচ পৃথিবীর কোনো দেশেই উদ্দেশ্যহীন অনার্স পড়ার নজির নেই। আর দেশে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনার্সের পর এক বা দেড় বছর ধরে মাস্টার্স করে থাকে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিতেই তার জীবন থেকে পাঁচ-ছয় বছর চলে যায়। তাকে যদি নতুন করে আবার চাকরির জন্য লেখাপড়া করতে হয়, তাহলে এই পাঁচ-ছয় বছরের লেখাপড়া তার কী দরকার ছিল?

বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা সময়ই কি তার বৃথা গেল না! লেখাপড়া তার বাস্তব জীবনে কোনো কাজে এলো না। জাতীয় জীবন থেকে অর্থ ও সময় দুটিই অপচয় হলো। তারুণ্য থেকে এতগুলো বছর কালের গহ্বরে অকারণে হারিয়ে গেল! এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তারুণ্যের কাছে এটা মোটেই প্রত্যাশিত নয়। তরুণরা এমন লেখাপড়া চায় না। তারা বাস্তবসম্মত-কর্মমুখী ও প্রায়োগিক লেখাপড়া চায়।

তরুণ বলতে সাধারণত ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের বোঝায়। দেশের মোট ভোটার ১১ কোটির ওপরে। এর মধ্যে তরুণ-তরুণী ভোটার সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। দেশের প্রায় অর্ধেক জনশক্তি তারুণ্যে ভরপুর। এক তথ্যানুযায়ী, এই বিশাল তরুণদের ৮০ শতাংশই রাজনীতিবিমুখ। এসব তরুণের কাছে কোনো রাজনৈতিক আইডল নেই। দেশের রাজনীতি মানেই এখন লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, মারামারি, মাদকতা ইত্যাদি। বিড়ি, সিগারেট, গাঁজা, মদ ইত্যাদি না খেলে নেতা হওয়া যায় না! নেতা হতে হলে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নিজের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হয়। এসব কারণে তরুণদের কাছে রাজনীতি এখন অপছন্দ।

আবার রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া দেশে এখন চাকরি নেই। রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি ঘুস দেওয়া-নেওয়া এখন ওপেন সিক্রেট। গ্রামে কেউ সরকারি চাকরি পেলে ঘুসের বিনিময়ে চাকরি হয়েছে বলেই সবাই মনে করে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেকে তাই বলেন, ‘লেখাপড়া করে কী হবে? আইএ-বিএ পাশ করে কী লাভ? আমাদের টাকা নেই, লোক নেই, মামা-খালু নেই, ধজ-গজ নেই; তাই আমাদের লেখাপড়ার দরকার নেই।’ এসব পরিবারের অর্ধ ও অশিক্ষিত বেকাররা বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। বিদেশ যেতে গেলেও দালালদের শরণাপন্ন হতে হয়, তাদেরকে ঘুস দিতে হয়।

অনেকে আবার অসাধু দালালদের খপ্পরে পড়ে ভিটেমাটি পর্যন্ত হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। অর্থনৈতিক ফোরামের এক জরিপ অনুযায়ী, উন্নত জীবনযাপন ও উন্নত পেশার জন্য দেশের তরুণ সমাজের ৮২ শতাংশ বিদেশে পাড়ি দিতে চায়। গত পাঁচ বছরে প্রায় দেড় হাজার তরুণ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছে। বিগত ৩০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ লাখ তরুণী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। মাসিক ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা উপার্জনের চুক্তিতে তারা দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু বিদেশে গিয়েও তারা ভালো নেই। বিদেশে গিয়ে তারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তারা লাঞ্ছিত-অপমানিত ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।

এটি দেশের জন্য লজ্জা ও অপমানের। বিগত তিন বছরে (২০১৯, ২০২০, ২০২১) বাংলাদেশ থেকে বিদেশের শ্রমবাজারে চাহিদা ছিল ৩০ লাখ জনশক্তি। কিন্তু পাঠানো গেছে মাত্র ১১ লাখ। বাকি ১৯ লাখ শ্রমিক হতাশায় নিমজ্জিত। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমবাজার নতুন বছরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষিত বেকার রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, দেশের তরুণদের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশই বেকার। এ সংস্থাটির হিসাবমতে, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মক্ষমদের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তাদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।

এ বিশাল জনশক্তির মধ্য থেকে খুব কমসংখ্যক তরুণ-তরুণী ছোট-বড় চাকরি পেয়ে থাকে। বাকি সবাই বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। তারা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ২০১৮ সালের অক্টোবরে বেকারত্বের টেনশনে আত্মহত্যা করেছেন। এসব তরুণ-তরুণীর বেকারত্ব ঘোচাতে দেশীয় বাজার সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। বেকারত্বের ভারে তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে। তাদের বৈবাহিক জীবনে মারাত্মক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পিতারা তাদের কন্যাকে বেকার তরুণদের সঙ্গে বিয়ে দেন না। অন্যদিকে তরুণীদের কাছেও বেকার তরুণরা অপছন্দ। ফলে তরুণ-তরুণীদের বিয়ের বয়সসীমা পার হলেও তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারছে না। এতে সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের শতকরা ৬.৮ ভাগ শ্রমের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশুশ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ শিশু আছে, যারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে রয়েছে বাসের হেলপার, কেমিক্যাল কারখানার কর্মী, লেদ মেশিনে কাজ করা শ্রমিক, মাছ ধরা জেলে, শুঁটকি শ্রমিক ইত্যাদি। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এসব শিশু প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে।

এ আলোচনা থেকে এটাই বোঝা যায়, তরুণদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে। বাঙালি জাতি স্বাধীন হলেও এবং দেশের অনেক উন্নতি হলেও এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারছে না। মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানরা এর সুফল ভোগ করছে, যা স্বাধীনতার চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচার ছিল স্বাধীনতার চেতনা। এ চেতনা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে আমাদের সমাজ। প্রভাবশালীদের অনৈতিক কার্যকলাপ আমাদের স্বাধীনতাকে কালিমাযুক্ত করছে। তরুণরা কখনো এটা প্রত্যাশা করে না।

তাদের প্রত্যাশা হলো, দেশে স্বাধীনতার মৌলিক চেতনা ফিরে আসুক। সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদায় সিক্ত হোক আমাদের সমাজ। প্রত্যেকের মাঝে জাগ্রত হোক মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধ। স্বাধীন দেশ হয়ে উঠুক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। প্রত্যেক নাগরিক হয়ে উঠুক মানবিক মানুষ। আর এর মাধ্যমেই আগামী দিনের দেশনায়ক শিশু-কিশোররা ফিরে পাবে অনাবিল শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপদ জীবন।

ড. মো. কামরুজ্জামান : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments