Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামঢাকার হাল লজ্জাজনক

ঢাকার হাল লজ্জাজনক

সরদার সিরাজ

তিলোত্তমা ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি পুরানো তা পূরণ হয়নি। বরং অবনতি হতে হতে বসবাসের অযোগ্য শহরের খ্যাতি লাভ করেছে। ঢাকা সম্পর্কে সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক কিছু তথ্য হচ্ছে: অচিরেই ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি পেরিয়ে বিশ্বের ষষ্ঠ জনসংখ্যা বহুল রাজধানী শহর হবে। জাতিসংঘের হিসাবে স্বাস্থ্যকর শহরে প্রতি একর এলাকায় সর্বোচ্চ ১২০ জন বাস করতে পারে। ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় ৭০০-৮০০ জন মানুষ বাস করছে। জাতিসংঘের ইউএন হ্যাবিটেটের হিসাবে, একটি আদর্শ বড় শহরে কমপক্ষে এলাকা থাকতে হয় ২৫% সবুজ, ১৫% জলাভূমি ও ২০% সড়ক। বর্তমানে ঢাকায় রয়েছে, সবুজ-২%, জলাভূমি-১.২৬% ও সড়ক-৮%। নামবিও’র যানজটের সূচক-২০২১ মতে, বিশ্বের ২৫০টি শহরের মধ্যে ঢাকা নবম। বিআইডিএস’র তথ্য মতে, ঢাকা শহরের যানজটের কারণে বছরে দেশের জিডিপির ৬% ক্ষতি হচ্ছে। ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বাসযোগ্য শহরের সূচক-২০২১ মতে, বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকা ১৩৭তম। গড় নম্বর ৩৩.৫ ( স্থিতিশীলতায় ৫৫, স্বাস্থ্যসেবায় ১৬.৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৩০.৮, শিক্ষায় ৩৩.৩ ও অবকাঠামোতে ২৬.৮ নম্বর)। এ সংস্থার নিরাপদ শহরের সূচক-২০২১ মতে, ৬০টি শহরের মধ্যে ঢাকা ৫৪তম। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মার্সার ‘কস্ট অব লিভিং সিটি-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ২০৯টি শহরের মধ্যে ঢাকা ৪০তম। জাতিসংঘের তথ্য মতে, ঢাকার ৪টি নদী বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক দূষিত। অন্যদিকে, নতুন করে যে কয়েকটি ইউনিয়নকে ঢাকা নগরীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখানে মহানগরের কোনো ছায়াই পড়েনি। ঢাকার সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে দেশের প্রখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত সম্প্রতি বলেছেন, ঢাকা এখন ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছে।

হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ও মধ্য আয়ের দেশের রাজধানী। ঢাকার বর্ণিত অবস্থা চরম লজ্জাজনক। তবুও মানুষ তিলোত্তমা ঢাকার স্বপ্ন ত্যাগ করেনি, এ স্বপ্ন বরং নতুন করে দেখতে শুরু করেছে ড্যাপ, মেট্রোরেল ও নতুন বাস পদ্ধতি নিয়ে। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় সংশোধিত ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন এটি প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করলেই তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়ে বাস্তবায়ন শুরু হবে। ড্যাপের আওতা হচ্ছে, উত্তরে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকা, দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এলাকা, পশ্চিমে সাভারের বংশী নদী, পূর্বে কালীগঞ্জ-রূপগঞ্জ বা শীতলক্ষ্যা নদী এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কেরানীগঞ্জ এলাকা। ড্যাপের মোট আয়তন হবে ১,৫২৮ বর্গকিলোমিটার, যার জনঘনত্বের বিবেচনায় কেন্দ্রীয়, বহিস্থ ও অন্যান্য-এ তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। নতুন ড্যাপের নগর এলাকা হবে ৬০% (তন্মধ্যে আবাসিক ৪.৩৬%, মিশ্র ব্যবহার (আবাসিক প্রধান) ৩২.৫০%, মিশ্র ব্যবহার (আবাসিক-বাণিজ্যিক) ০.৪৫%, বাণিজ্যিক ০.১৬%, মিশ্র ব্যবহার (বাণিজ্যিক প্রধান) ১.৪৩%, মিশ্র ব্যবহার (শিল্প প্রধান) ৭.৯০%, প্রাতিষ্ঠানিক ৪.০১%, ভারী শিল্প ১.৬৩%, পরিবহন যোগাযোগ ২.৩৫%, কৃষি এলাকা ২৯.২২%, জলাশয় ৭.৯৫%, বনাঞ্চল ১.৪১%, উন্মুক্ত স্থান ১.৩৮%)। রাজউকের উদ্যোগে ড্যাপ বাস্তবায়ন হবে ২০ বছরে (২০১৬-৩৫)। ড্যাপকে ৬টি অঞ্চল তথা কেন্দ্রীয় অঞ্চল (মূল ঢাকা), পূর্ব অঞ্চল (রূপগঞ্জ ও কালীগঞ্জ), উত্তর অঞ্চল (গাজীপুর), দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল (কেরাণীগঞ্জ), দক্ষিণ অঞ্চল (নারায়ণগঞ্জ) ও পশ্চিম অঞ্চল (সাভার-এ ভাগ করা হবে। ড্যাপের লক্ষ্য হচ্ছে, ঢাকা নগরীকে আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও বাসযোগ্য এবং সব ধরনের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা। দেশের প্রথম মেট্রোরেল এ বছরের ডিসেম্বরে চালু হবে ঢাকায়।এর আওতা হচ্ছে, মিরপুর থেকে আগারগাঁও-ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত। এতে ঘণ্টায় ৬০ হাজার মানুষ যাতায়াত করতে পারবে। এছাড়া, বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল ও গাবতলি থেকে গুলশান হয়ে ভাটারা পর্যন্ত আরও দুটি মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আর গাবতলি থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপান।পাতাল সড়ক এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা-টঙ্গী ডবল রেললাইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া, কয়েকটি দ্বিতল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব কাজ সম্পন্ন হলে ঢাকার পরিবহন খাতে নব দিগন্তের সূচনা হবে। সর্বোপরি পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত ২৬ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে রাজধানী হয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর রুটে পরীক্ষামূলকভাবে বাস রুট রেশনালাইজেশন শুরু হয়েছে।

বাস রুট রেশনালাইজেশন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সকলেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। এ ব্যাপারে পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বাসের নতুন পদ্ধতির রুটের যাত্রীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। কারণ, নতুন এই পদ্ধতিতে যাত্রীদের দাঁড়িয়ে যেতে হয় না, দৌড়ে ওঠা লাগে না, উঠতে-নামতে ঠেলাঠেলি নেই। সব কিছুই হয় লাইন ধরে। যাত্রীর অপেক্ষায় বাস বসে থাকে না, নির্দিষ্ট সময়ে একটার পর একটা আস-যাওয়া করে। ভাড়া নিয়ে কোনো বাকবিতণ্ডা নেই। কাউন্টারে গিয়ে গন্তব্য জানাতেই টিকিট বিক্রেতা ‘পস মেশিনে’ টিপ দিতেই নির্ধারিত ভাড়ার ই-টিকিট বেরিয়ে আসে। শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নেয়া হচ্ছে। নারীদের আসনে পুরুষরা বসছে না। বাসের ধাক্কাধাক্কি ও চলার প্রতিযোগিতা নেই। বাসের চালক ও হেলপাররাও সন্তুষ্টি জানিয়েছে। কারণ, তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে তাদের আর চুক্তিভিত্তিক থাকতে হবে না। মালিককে দিন শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দেওয়ার তাড়া নেই। মালিকরা মাস শেষে ঢাকা পরিবহন সমম্বয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে ভাড়া পাবে। চাঁদাবাজি করার কোনো সুযোগ নেই। ডয়চে ভেলের সাথে সাক্ষাৎকারে ঢাকা পরিবহন সমম্বয় কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, রেশনালাইজেশনের মাধ্যমে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় নির্ধারিত ৪২টি রুট এবং তা সরকার নিয়ন্ত্রিত ২২টি কোম্পানির অধীনে থাকবে। ঢাকা শহরকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করা হবে। বাসগুলো হবে ছয় রঙের। অপ্রয়োজনীয় বাস রুট বন্ধ করে দেয়া হবে। ২০১৯ ও এর পরে ২০২১ সালের মডেলের বাস চালাতে হবে। মিনিবাস উঠে যাবে। নতুন বাস নামানোর জন্য ৫% সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাস ছাড়ার সময় নির্ধারিত থাকবে। অতিরিক্ত যাত্রী তোলা যাবে না। টিকেট ছাড়া যাত্রী থাকবে না। ভাড়া কমে যাবে। পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্যাহ বলেছেন, আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এটা ভালো না খারাপ হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। একটি রুট শুরু হয়েছে দেখি কি হয়। উল্লেখ্য যে, ঢাকায় বাসের এই রেশনালাইজেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। এতদিন তা আলোর মুখ দেখেনি। এখন পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু হয়েছে (গত ২৬ ডিসেম্বর), তাও মাত্র একটি রুটে। এখন বাকী রুটগুলোতে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন হবে কি-না, হলেও কবে হবে তা বলা কঠিন। বাসের এ নতুন পদ্ধতি সঠিকভাবে ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতেই হবে। সে জন্য বিআরটিসির প্রয়োজনীয় বাস প্রস্তুত রাখতে হবে। কারণ, বেসরকারি বাস মালিকরা পর্যাপ্ত বাস না দিয়ে এ পদ্ধতি অকার্যকর করার চেষ্টা করতে পারে।সেটা হলে শূন্য স্থান পূরণ করতে হবে বিআরটিসির বাস দিয়েই।

অবশ্য, মেট্রোরেল ও দ্বিতল সড়ক চালু এবং বাস রেশনালাইজেশন করলেই যে ঢাকার যানজট দূর হবে তা নয়। তবে, এতে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। যাত্রীদের ভোগান্তি, ভাড়া ও দুর্ঘটনা কিছু কমবে। কিন্তু যানজট দূর হবে না। কারণ, ঢাকায় যে পরিমাণে সড়ক থাকা দরকার তা নেই। উপরন্তু যেটুকু আছে, তার বেশিরভাগ ভাঙ্গা। রাস্তার দু’দিকে অবৈধ দোকান, স্থাপনা, নির্মাণ সামগ্রী ও যানবাহনে ভরপুর। রাস্তার ঠিক স্বাভাবিক অবস্থা নেই। তাই এসব রেখে যানজট, আর্থিক ক্ষতি ও মানুষের ভোগান্তি দূর হবে না। এসব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য রাস্তার পরিমাণ বৃদ্ধি,ভাঙ্গা রাস্তা মেরামত এবং সব রাস্তাকে শতভাগ মুক্ত করে স্বাভাবিক ও নির্বিঘ্নে চলার পথ করতে হবে। রাস্তা থেকে হকার ও ছোট দোকানদারদের উচ্ছেদ করতে গেলে বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবী উঠে। দাবিটি যৌক্তিক। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। তাই তাদের জন্য স্থান ও দিন-সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। তাহলে উভয়কূল রক্ষা হবে। ঢাকার যানজটের আরও কারণ হচ্ছে, আন্তঃজেলার বাস-ট্রাক শহরের ভেতরে যত্রতত্র ও এলোপাতাড়ি করে রাখা হয় এবং ব্যাপক অবৈধ যানবাহন চলে। দক্ষিণের মেয়র বলেছেন, এটা বন্ধ করা হবে। আন্তঃজেলা বাস ও ট্রাকের টার্মিনাল করা হবে ঢাকার বাইরে। কবে হবে তা তিনি বলেননি। যত তাড়াতাড়ি হবে ততই মঙ্গল। গত ২ জানুয়ারি থেকে অবৈধ রিকশা, অনুমোদনহীন রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। তবে নিষিদ্ধ ঘোষিত ও আনফিট যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এসব রেখে যানজট ও দুর্ঘটনা দূর হবে না।

বায়ু দূষণ: ঢাকায় ব্যাপক বায়ু দূষণের কারণে বহু মানুষ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকেই মারা যাচ্ছে। তাই ঢাকার বায়ুদূষণ বন্ধ করা আবশ্যক। এ বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে, ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহু অনুমোদনহীন ইটভাটা রয়েছে। যেগুলোর অনুমোদন রয়েছে, তারও অধিকাংশই সেকেলে। এসব বন্ধ করতে হবে দ্রুত। বাড়ি ও স্থাপনা নির্মাণের ইট-বালি এবং যানবাহন ও শিল্প-কারখানার কালো ধোঁয়ায়ও বায়ুদূষণ হচ্ছে। তাই স্থাপনা নির্মাণ স্থানে নিয়মিত পানি ছিটানোর এবং যানবাহন ও শিল্পের কালো ধোঁয়া বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যাপ্ত গাছ না থাকার কারণেও বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই নগরব্যাপী প্রয়োজনীয় গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, ঢাকার বায়ুদূষণ বন্ধ করার জন্য গত বছরের ২০ নভেম্বর হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।

দুর্গন্ধ: ঢাকার প্রায় সর্বত্রই ব্যাপক ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। এতে যাতায়াতের খুবই অসুবিধা হওয়া ছাড়াও চরম দুর্গন্ধ নির্গত হয়। ময়লাগুলো যেখানে ফেলা হয়, সেখানে ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা চরম দুর্গন্ধময় হয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। এ অবস্থায় আমিনবাজারে ময়লা রিসাইকেলিং করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য চীনের সাথে চুক্তি হয়েছে সম্প্রতি। ময়লার গাড়ি দিনে চলাচল ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জুরাইনেও ময়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার চেষ্টা চলছে। এসব উদ্যোগ ভাল। কিন্তু বাসা-বাড়ি ও রাস্তার ময়লা প্রায় সারাদিনই নেয়া হয়। এতে চলাফেরা করতে দুর্গন্ধের কবলে পড়তে হচ্ছে মানুষকে। তাই সকাল ৮-৯টার মধ্যে ময়লা নেয়ার কাজ সম্পন্ন করার নিয়ম করে তা বাস্তবায়ন করা দরকার। এসব হলে নগরের পরিচ্ছন্নতার অনেক উন্নতি হবে। মানুষ দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পাবে। মশা-মাছি অনেক কমে যাবে।

শব্দদূষণ: শব্দ দূষণে মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাই এটা বন্ধ করা জরুরি। গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন, মটর সাইকেলের বিকট শব্দ ও মাইকের উচ্চ আওয়াজে শব্দদূষণ হচ্ছে। এসব বন্ধ করা হলে শব্দদূষণ শেষ হয়ে যাবে। বিদ্যুতের লাইন মাটির নিচ দিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। এটা সর্বত্রই নেয়া হলে তারের জঞ্জাল শেষ হয়ে যাবে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ফায়ার হাইড্র্যান্ট স্থাপন করার কাজ চলছে। এটা সম্পন্ন হলে অগ্নিকান্ডের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে যাবে।

পানিজট: একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার প্রায় সব এলাকা ডুবে যায়। মানুষ ও যানবাহন চলাচলে চরম বিঘ্ন ঘটে।কোথাও কোথাও বাড়ি, অফিস ও দোকানে পানি ঢুকে জিনিসপত্র নষ্ট হয়। সমগ্র নগর স্থবির হয়ে পড়ে। নৌকা ব্যবহার করতে হয়। বৃষ্টির পানি দ্রুত নামতে না পারার কারণেই এই দুর্গতি হয়। বহু স্থানে স্যুয়ারেজ লাইনের ময়লা পানি উপচে রাস্তায় পড়ে। এসবের প্রধান কারণ হচ্ছে, বেশিরভাগ ড্রেন মজে গেছে। স্যুয়ারেজ লাইনের পাইপ ছোট ও ভেঙ্গে গেছে। তাই এসবের পরিবর্তন করে আধুনিক করতে হবে এবং ড্রেন ও স্যুয়ারেজ লাইন ঘনঘন পরিষ্কার করতে হবে। ড্রেনগুলো দিয়ে পানি দ্রুত নামতে না পারার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, ড্রেনগুলো পলিথিন ও প্লাস্টিকে ভরপুর। এ জন্য ঢাকার সব নদীও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে বহু বছর আগে।কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি!তাই এটা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।এছাড়া,রিসাইকেল হয় না এমন প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং তা কার্যকর করা প্রয়োজন। ঢাকায় বহু খাল-বিল ছিল। দিনে দিনে বেশিরভাগ হারিয়ে গেছে।বর্তমানে যে কয়েকটি আছে, তারও অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। বাকীগুলো মজে গেছে। ফলে নগরের পানি ধারণ ও নামতে পারে না। পানিজট সৃষ্টি হয়। তাই ঢাকার সব খাল পুনরুদ্ধার ও পুনঃখনন করা জরুরি। সব খালকে পুনরুদ্ধার করার জন্য আর্মিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং গত নভেম্বর থেকে তাদের অভিযান চালনার কথা শোনা গেলেও এখনো তা হয়নি। খালের দু’ধারের সীমানা চূড়ান্ত না হওয়ায় উন্নয়ন কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা ওয়াসার এমডি গত ৪ ডিসেম্বর বলেছেন, ঢাকা মহানগরীর ৮০ ভাগ আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবনে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। তাই সিটি কর্পোরেশনের নালায় সরাসরি সংযোগ দেয়া হয়েছে।অথচ রাজউক আইনে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিধান রয়েছে। তাছাড়া ঢাকা নগরীর অধিকাংশ বাড়ি ও অফিসে রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী গ্যারেজ করা হয়নি। তাই গাড়ি রাখা হয় রাস্তায়। আরও অনেক ত্রুটি রয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে, নিয়ম মোতাবেক যায়গা না ছাড়া এবং অনুমোদনের অতিরিক্ত ফ্লোর করা। এসব চরম অন্যায়,পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এসব বেআইনি কর্ম বন্ধ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।

নদীদূষণ: ঢাকায় ৪টি নদী (তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা) রয়েছে। এসব নদী দখল হয়ে ছোট হয়ে গেছে। এ দখলদারের সংখ্যা প্রায় নয় হাজার বলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অভিমত। উপরন্তু নদীগুলোতে অনবরত কলকারখানার বর্জ্য ও নগরের ময়লা-আবর্জনা পড়ে পানি চরম দূষিত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্ত করে ঢাকার নদীগুলোকে জীবন্ত করতে হবে। সে জন্য আগে দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত করতে হবে। ঢাকার নদীগুলো থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য মাঝে-মধ্যেই অভিযান চালানো হয়। কিন্তু তা কাজ হয় না, পুনর্দখল হয়ে যায় কিছু দিনের মধ্যেই। দখলদারদের শাস্তি দেওয়া হয় না। তাই কঠোর পন্থা অবলম্বন করে সব নদীকে দখলমুক্ত করে স্থায়ী তথা পরিকল্পনা অনুযায়ী তীরভূমিতে সীমানা পিলার স্থাপন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণসহ পার্ক, বাগান ও হাঁটার পথ তৈরি করতে হবে। দূষণমুক্ত করার জন্য নদীগুলোকে নিয়মিত সংস্কার করে পলিথিন, প্লাস্টিক, রাস্তা ও বাড়ির আবর্জনা এবং শিল্পের বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। এসব হলেই নদীগুলোর ঐতিহ্য ফিরে আসবে। আমিন বাজার থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ওয়াটার বাস চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বর্ষার সময় ১০টি স্থানে পানি থেকে ব্রিজের উচ্চতা কম হওয়ায় ব্রিজের নিচ দিয়ে ওয়াটার বাস চলতে না পারায় সে প্রচেষ্টা আটকে গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্রিজের উচ্চতা দ্রুত বাড়ানো দরকার। কারণ, ওয়াটার বাস চালু করতে পারলে পণ্য ও মানুষ পরিবহণের ব্যয় হ্রাস পাবে এবং রাস্তার উপর থেকে চাপ কমবে। স্মরণীয় যে, ঢাকার চারিদিক দিয়ে বৃত্তাকার নৌ সার্ভিস গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের, যা বাস্তবায়ন করা জরুরি। সর্বোপরি ঢাকার সরকারী যেসব জায়গা বেদখল হয়ে রয়েছে তা দ্রুত দখলমুক্ত করতে হবে। ঢাকায় প্রয়োজনীয় খেলার মাঠ ও পার্ক নেই। যা আছে, তার অনেকগুলো দখল হয়ে রয়েছে। ফলে খেলার ও বিনোদনের অসুবিধা হচ্ছে। এগুলো শীঘ্রই দখলমুক্ত ও পার্কে বখাটেদের উৎপাত বন্ধ করতে হবে।

আবাসন সংকট: ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় সর্বাধিক। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আবাসন সংকট। বাড়ি ভাড়া অত্যধিক। মানুষের উপার্জনের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় বাড়ি ভাড়ায়। তাই বাধ্য হয়ে গরিব মানুষ বস্তিতে বাস করে অতি মানবেতরভাবে।যাদের সংখ্যা মোট বাসিন্দার প্রায় ৩০%। আবাসন সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে,ঢাকার বেশিরভাগ বাড়ি একতলা। এছাড়া, বহু যায়গা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। নগরীর পূর্বদিকে বিরাট খোলা জায়গা রয়েছে। তার বেশিরভাগ স্থানে কোন বাড়ি/স্থাপনা করা হয়নি। কারণ, এলাকাটি বন্যা কবলিত। অথচ, বালু নদীর পশ্চিম দিক দিয়ে বাধ নির্মাণ করা হলে এলাকাটি বন্যামুক্ত হতো। লাখ লাখ বাড়ি/স্থাপনা নির্মাণ হতো। এই অবস্থায় ঢাকা নগরীর আবাসন সংকট দূর করার জন্য একতলা বাড়ি এবং ফাঁকা জায়গায় বহুতল বিশিষ্ট বাড়ি করার ব্যবস্থা করতে হবে। উপরন্তু ডিএন্ডডি থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বালু নদীর পশ্চিম দিক দিয়ে বাঁধ কাম রাস্তা করার যে পরিকল্পনা রয়েছে তা দ্রুত নির্মাণ করতে হবে। তাহলে ঢাকা নগরীর আবাসন সংকট অনেকটা দূর হবে। সচিবালয়সহ সরকারী প্রায় সব অফিসের এবং বেসরকারী অফিসের সদর দপ্তর ঢাকায়। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা অফিসও রয়েছে অনেক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশের নিজস্ব কোয়াটার নেই। তাই অফিসের লোকদের অধিকাংশের ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়। তাই ঢাকার সব সরকারি অফিসের প্রয়োজনীয় কোয়ার্টার নির্মাণ করতে হবে। রাজউকের চেয়ারম্যান গত ২৮ আগস্ট বলেছেন, ঢাকার দুই সিটিতে সাড়ে ৩ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ভবন রয়েছে। এ ছাড়া আরও ১ হাজার ভবন তদন্তাধীন রয়েছে। আসছে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মোবাইল কোর্ট দিয়ে অভিযান পরিচালনা করে যেসব ভবনের সেটব্যাক অবৈধ সেগুলো ভাঙার ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, পুরানো ঢাকাকে প্ল্যানে নিয়ে আসতে হলে এখানে কোন বিল্ডিংয়ের অস্তিত্ব থাকবে না, সব ভেঙে ফেলতে হবে। সেপ্টেম্বরের পরও তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তুঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ভবন ভাঙ্গার খবর পাওয়া যায়নি! সব ভবন দ্রুত ভেঙ্গে ফেলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের স্থলে বহুতল ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত পুরানো ঢাকার বাড়ি/স্থাপনাগুলো বহু পুরাতন। তাই এগুলোর অধিকাংশই জীর্ণ-শীর্ণ ও একতলার। রাস্তাও তেমন নেই। সর্বোপরি বহু বাড়িতে রয়েছে রাসায়নিকের গুদাম। তাই প্রায়ই আগুন লেগে বহু মানুষ নিহত-আহত হয়। নিমতলী ও চুরিহাট্রায় দুর্ঘটনা ইতিহাসখ্যাত। তাই সেখানকার সব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যা কার্যকর হয়নি! ঢাকার বাইরে রাসায়নিকের জোন করার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর নির্মাণ ও বণ্টন ব্যবস্থা খুব দ্রুত করা দরকার। পুরানো ঢাকাকে আজ হোক কিংবা ১০ বছর পর হোক, পরিকল্পনা মাফিক আধুনিক করতেই হবে। নতুবা সেখানে যে অবর্ণনীয় সংকট চলছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই। যে কোন সময়ে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেখানের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। ড্যাপের পরিকল্পনায়ও পুরানো ঢাকাকে আধুনিক করার কথা বলা হয়েছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে খুব দ্রুত পুরানো ঢাকাকে পরিকল্পনা মাফিক আধুনিক করা এবং সব বাড়ি বহুতল করা প্রয়োজন। তাহলে বহু মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা হবে। অন্যদিকে, ঢাকার বাইরে গার্মেন্ট শিল্প জোন প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চলছে।এটা হলে ঢাকা থেকে ২৫-৩০ লাখ মানুষ কমে যাবে।তাতে আবাসনের সংকট কিছুটা কমবে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং ড্যাপ বাস্তবায়ন করা হলেও ঢাকার উপর চাপ কমবে।তাতেও আবাসন সংকট কিছুটা লাঘব হবে। বর্ণিত কাজগুলো হলে যথা সময়ে ঢাকা অনেকটাই বাসযোগ্য নগরে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments