Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeসাহিত্যজান্নাতুল নাঈমের গল্প: মুক্তির আনন্দ

জান্নাতুল নাঈমের গল্প: মুক্তির আনন্দ

ফাতেমা বেগম উঠানের কোণে কুলো দিয়ে ধান উড়াচ্ছেন। তার ছেলে মাইদুল ধনাগোদা নদী থেকে পুঁটি মাছ ধরে নিয়ে মাত্রই এলো। মেয়ে সুনন্দা পুকুরে সাঁতার কাটছে।

ফাতেমা বেগম উঁচুগলায় বললেন, ‘সুনন্দা তাড়াতাড়ি আয়। পুঁটি মাছগুলো কুটে আলু দিয়ে রেঁধে নে তো।’
মাইদুল বলল, ‘মা শুনছো, যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা গ্রাম-শহরে ডুকে পড়ছে।’
সুনন্দা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমাদের কী হবে? আমাদের গ্রাম ঘেঁষে ধনাগোদা নদী। মিলিটারিরা এই এলাকায় সহজেই চলে আসতে পারবে।’
মাইদুল বলল, ‘আজই মতলব গিয়ে রেডিও কিনে আনবো। যুদ্ধের খবর তো শুনতে হবে।’
ফাতেমা বেগম বললেন, ‘মতলব শহর অনেক গরম শুনলাম। কাক-পক্ষী সেখানে কেউ যায় না। বাবা, দরকার নেই। তোর রহিম চাচার একটা রেডিও আছে, ওখান থেকে শুনতে পারবি।’
মাইদুল ঠিক আছে বলে নৌকা আর জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

সন্ধ্যায় কুপি জ্বালিয়ে সুনন্দা কাঁথা সেলাই করছেন। ঠিক এমন সময়ে বাড়িতে কান্নাকাটি।
ফাতেমা বেগম বললেন, ‘সুনন্দা, দেখে যা তোর মামি আর রাশেদ এসেছে।’
সুনন্দা শুনলো তার মামাকে হানাদাররা ধরে নিয়ে গেছে। মামাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

কান্নাকাটি শুনে পাড়া-প্রতিবেশীর আগমন ঘটে।
কেউ কেউ বলছেন, ‘আমাদের গ্রামে কবে জানি পাকিস্তানি মিলিটারি ঢুকে পড়ে।’
রহিম চাচা ডেকে বললেন, ‘দামোদরদী গ্রামে মিলিটারি আক্রমণ হবে না। কাল মিলিটারির লঞ্চ এসেছিল। মিঞা বাড়ির বড়সাহেব হানাদারদের বলে দিয়েছেন, এই এলাকায় কোনো মুক্তিবাহিনী নেই। তবে আমাদের পাশের গ্রামে মিলিটারি ডুকে পড়েছে।’

মাইদুল শোল মাছ নিয়ে রাতে হাজির। মামির মুখে বৃত্তান্ত শুনে মন খারাপ করে বসে পড়ল।
সুনন্দা বলল, ‘ভাইয়া, খেতে আসেন। আজ কেউ খাবার খাবে না। কারো গলা দিয়ে খাবার নামবে না।’
মাইদুল বলল, ‘মা, আমি যুদ্ধে যাবো। কালই আমরা কয়েকজন পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণে যাচ্ছি।’
ফাতেমা বেগম কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, ‘না বাবা। আমাদের এলাকায় তো কোনো ক্ষতি হবে না।’
মাইদুল বলল, ‘মা, আমরা ভালো আছি। দেশ তো ভালো নেই। এভাবে চললে কয়েকদিন পর মানুষ গুলি আর না খেয়েই মরে যাবে। জোয়ান-বুড়ো সবাই যুদ্ধে যাচ্ছে। মা, মানুষ থেমে নেই। দেশের এই পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে ঘরে থাকবো বলো?’
এমন সময় মাইদুলের মামাতো ভাই রাশেদ বলল, ‘ভাইয়া, আমিও তোমার সাথে যাবো।’
রাশেদের মা রাবেয়া বললেন, ‘বাবা, তোকে আমি বাধা দেবো না। তোদের জন্য অফুরন্ত দোয়া থাকবে।’

খুব ভোরে মাইদুল আর রাশেদ রওনা দিলো। দামোদরদী গ্রামের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দেশ স্বাধীন হলো। যুদ্ধ শেষ। সবাই ফিরে এসেছে। মাইদুল ও রাশেদ ফিরছে না। সকাল-সন্ধ্যা তাদের পথ চেয়ে পরিবার অপেক্ষায় থাকে।

২০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পেরিয়ে সবে রাত হলো। ঠিক তখন মাইদুল ডেকে উঠলো, ‘মা-মা-মা।’
সুনন্দা এক দৌড়ে উঠানে এসে বলল, ‘ভাইয়া, কী যে আনন্দ লাগছে।’
রাবেয়া বেগম কুপি নিয়ে এসে বললেন, ‘আমার রাশেদ বাবা কোথায়?’
রাশেদ বলল, ‘মা, এই যে আমি।’

মাইদুল আর রাশেদকে জড়িয়ে ধরে রাবেয়া এবং ফাতেমা বেগম আনন্দে কাঁদলেন। পাড়া-প্রতিবেশী ততক্ষণে এসে পড়েছে। সবাই যুদ্ধের কথা শুনতে চান। আজ তারা কিছুতেই ঘুমাবেন না। আজ স্বাধীনতার গল্প শুনতে চান।
সুনন্দা বলল, ‘আপনারা সবাই বসেন। ভাইয়ারা রাতে ভাত খেয়ে তারপর গল্প শোনাবেন।’
জোছনার হিড়িক আজ উঠানজুড়ে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে বৃদ্ধরা ঝিমাচ্ছেন। তারা কাল গল্প শুনতে চান না। আজই গল্প শুনবেন।

মাইদুল যুদ্ধের কাহিনি বলছে। সবাই গল্প শুনছেন। গল্পের মধ্যখানে বলে উঠছে, ‘শালা মিলিটারি।’
কেউবা ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলছেন, ‘আহারে, কত মায়ের বুক খালি হলো।’
রাত বাড়ছে। কুয়াশায় সবাই কাঁপছেন আর গল্প শুনছেন।

রাত বাড়তেই রহিম চাচা বললেন, ‘সবাই কাল বিকেলে কাজ শেষ করে আসবেন। আজ ওরা কতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। ওরা একটু আরামে ঘুমাক। ওরা স্বাধীন দেশে মুক্তির আনন্দে নিশ্চিন্তে ঘুমাক।’

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments