Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামকীভাবে মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাবে

কীভাবে মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাবে

মূল্যস্ফীতি বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের দ্রব্য বা সেবার মূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে বুঝায়। আর অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বলতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিকে বুঝায়। তাতে সীমিত পণ্য ও সেবার পিছনে বিস্তর টাকা ব্যয় হয়। চাহিদা ও যোগানের অসমতার কারণে সাধারণত মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। অর্থনীতির ভাষায়, কোনো দ্রব্য পাওয়ার আকাক্সক্ষা ও তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বা সামর্থ্য এবং সেই অর্থ ব্যয় করার সদিচ্ছাকে ‘চাহিদা’ বলে। আর দ্রব্যের সরবরাহকে ‘যোগান’ বলা হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট দামে বিক্রেতাগণ কোনো দ্রব্যের যে পরিমাণ বিক্রয়ের জন্য বাজারে নিয়ে আসেন, তাকে ‘যোগান’ বলা হয়। এককথায় ক্রেতা বা ভোক্তার দিক থেকে চাহিদা সৃষ্টি হয় এবং বিক্রেতা বা উৎপাদক সেটি যোগান দিয়ে থাকেন। তাই চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানা, উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগ সকল ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা বল্গাহীন। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় এগুলি সবই রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানাধীন। অতঃপর উভয় তন্ত্রের দোষ ও দুর্বলতাসমূহ বর্জন করে এবং গুণগুলো গ্রহণ করে যে নতুন অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাকে বলা হয় ‘মিশ্র অর্থব্যবস্থা’। যেখানে ব্যক্তি ও সরকারি উদ্যোগ সমন্বিত ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থা হলো, মিশ্র অর্থনীতি (Mixed Economy)। এখানে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় ব্যবস্থার কিছু কিছু উপাদান রয়েছে। উভয় ব্যবস্থায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উৎপাদন ও বণ্টনে স্বাধীন। এইসাথে শুরু থেকেই রয়েছে সুদী প্রথা, যেখানে কোনরূপ লোকসানের ঝুঁকি ছাড়াই ঋণদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একচেটিয়াভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ফলে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে ধনী ও দরিদ্রের পাহাড় প্রমাণ বৈষম্য। অতঃপর ১৯৯১ সাল থেকে চালু হয়েছে ভ্যাট, যা সামগ্রিক অর্থব্যবস্থাকে আরও ধনতান্ত্রিক করে ফেলেছে। পক্ষান্তরে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃত। কিন্তু তা হালাল-হারাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে যাকাত-ছাদাক্বা ও অন্যান্য ব্যয়-বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক অর্থনীতি সুনির্ধারিত। সেখানে অসৎ উদ্দেশ্যে মজুতদারী, ফটকাবাজারী ও প্রতারণা চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ। ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ সুরক্ষিত। এই অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদের মূল মালিক হলেন আল্লাহ। তাই এর উৎপাদন ও ব্যয় বণ্টন সবই হবে আল্লাহ্র বিধান মতে। এখানে দুনিয়া মুখ্য নয়, আখেরাতই মুখ্য। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মানুষ প্রবৃত্তির গোলাম। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় মানুষ রাষ্ট্রের গোলাম। আর ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মানুষ আল্লাহ্র গোলাম।

মূল্যস্ফীতির কারণ: (১) অনুৎপাদনশীল খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, (২) বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, (৩) চোরাচালান ও মজুতদারী, (৪) বেতন-ভাতা ও মজুরিবৃদ্ধি, (৫) ঘাটতি বাজেট পূরণ, (৬) প্রাকৃতিক দুর্যোগ, (৭) বিলাস দ্রব্যের অত্যধিক আমদানি, (৮) ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জন, (৯) মধ্যস্বত্বভোগীদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ, (১০) চাঁদাবাজি, (১১) ব্যাংক কর্মকর্তা ও আমদানিকারকদের অশুভ আঁতাত। যেখানে ওভার ইনভয়েসিং (চালানপত্রে পণ্যের দাম বেশি দেখানো)-এর মাধ্যমে অসাধু আমদানিকারকরা অর্থ বিদেশে পাচার করেন। সেইসাথে প্রকৃত দামের চাইতে বেশি দামে পণ্য বাজারে ছাড়েন। (১২) রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এসব কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্ণিত প্রায় সবক’টি কারণ মজুদ রয়েছে। ফলে ১০ শতাংশ হারের মুদ্রাস্ফীতিকে সহনীয় বলা হলেও বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত ৮ মাসের মধ্যে তেলের মূল্য সর্বনিম্ন হলেও বাংলাদেশে তেলের মূল্য সর্বাধিক। বাজারে দ্রব্যমূল্যে আগুন ধরে গেছে। এমনকি শস্য-শ্যামল এই বাংলাদেশে সবজির দাম আকাশছোঁয়া। মাছ-গোশত ও ডিমসহ সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের একই অবস্থা। সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। মা-বোনেরা শেষ সম্বল গহনা-পত্র বিক্রি শুরু করেছেন। এমনকি কলিজার টুকরা সন্তানকেও বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে আসছেন।

বাংলা ১১৭৬ সালে (১৭৭০ খৃ.) বাংলাদেশে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, তা ইতিহাসে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে প্রসিদ্ধ। এ সময় বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ফসলের পরিবর্তে তারা রাজস্ব আদায়ের জন্য মুদ্রাব্যবস্থা চালু করে। ফলে খাজনার টাকা সংগ্রহের জন্য কৃষককে তার সারা বছরের ফসল বিক্রি করতে হতো। এই সুযোগে ইংরেজ ও তাদের দোসররা দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান-চালের ক্রয়কেন্দ্র খোলে। অতঃপর সেগুলি গুদামজাত করে। পরে সুযোগ মতো এসব খাদ্য চড়ামূল্যে চাষিদের নিকট পুনরায় বিক্রয় করে। এ কারণে দেশে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি হয়। মানুষ নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। মারা যায় কয়েক লাখ বনু আদম। ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টারের মতে, ‘এই দুর্ভিক্ষে মানুষ তাদের গরু-বাছুর, লাঙ্গল-জোয়াল বিক্রি করে এবং বীজধান খেয়ে অবশেষে সন্তান বিক্রি করতে শুরু করে। এমনকি একপর্যায়ে তারা ক্ষুধার তাড়নায় মৃত মানুষের গোশত পর্যন্ত খেতে শুরু করে’ (W.W. Hunter, The Annals of Rural Bengal (London : Smith, Elder and Co, 1868), P. 26.)

বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত ৫০ বছরের মধ্যে ১৯৭৪ সালটি ছিল বাংলাদেশের জন্য দুর্ভিক্ষের বছর। যখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। কারণ ছিল অসৎ ব্যবসায়ীদের চোরাচালান, মজুতদারী, চোরাকারবারী ও বর্ধিত মুনাফার উদ্দেশ্যে খাদ্য বিনষ্ট করে দেওয়া। মূল্যস্ফীতির কারণে হতদরিদ্র বর্গাচাষি, কৃষিশ্রমিক ও শহুরে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ’৭৪ সালে কুড়িগ্রামের চিলমারী থানার রমনা ইউনিয়নের জোড়গাছ গ্রামের এক জেলে পরিবারের বাক প্রতিবন্ধী যুবতী মেয়ে ‘বাসন্তী’র মাছ ধরার জাল পরে লজ্জা নিবারণের মর্মান্তিক ছবি প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। সেসময় দেশে লুটপাট ও চুরি-ডাকাতির হিড়িক পড়ে যায়। ফলে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলতে বাধ্য হন, ‘অন্যেরা পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’।

প্রতিকার : (১) সুদভিত্তিক অর্থনীতি বাতিল করা, (২) অনৈতিক মজুতদারী বন্ধ করা, (৩) ঘুষ-দুর্নীতিসহ হারামের সকল পথ বন্ধ করা এবং হালাল রূজির পথকে বাধাহীন করা, (৪) চাঁদাবাজি বন্ধ করা, (৫) দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত ২৫২৯টি (জুন ২০২২) এনজিওর মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণদানকারীদের নিবন্ধন বাতিল করা ও তাদের শোষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, (৬) সরকারিভাবে ‘করযে হাসানাহ’ প্রকল্প চালু করা এবং তার মাধ্যমে সৎ ও আল্লাহভীরু উদ্যোক্তাদের মধ্যে সুদবিহীন ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করা, (৭) দালালী প্রথার মাধ্যমে প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করা, (৮) বাজারে চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিরঙ্কুশ রাখা, (৯) ন্যায্যমূল্যে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ফসল ক্রয় করা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা, (১০) অসৎ ব্যবসায়ীদের, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ও বিভিন্ন বিভাগের অশুভ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়া, (১১) জুয়া, হাউজি, ক্যাসিনো ও মাদকদ্রব্য প্রভৃতি সকল প্রকার হারাম বস্তু ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা, (১২) ব্যাংকগুলোতে এলসি (খবঃঃবৎ ড়ভ পৎবফরঃ) বা ঋণপত্রের অর্থ পরিশোধের সময়সীমা কমিয়ে আনা, যাতে আমদানিকারকরা মজুদের সময় না পায় এবং আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্য দ্রুত বাজারে চলে যায়, (১৩) স্থল, নৌ ও বিমানপথে গোয়েন্দা নজরদারী জোরদার করা, যাতে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার না হতে পারে এবং বিদেশ থেকে চোরাইপথে কোনো নিষিদ্ধ পণ্য দেশে প্রবেশ করতে না পারে, (১৪) রক্ষক হওয়া ভক্ষকদের প্রকাশ্যভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, (১৫) প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ভুক্তভোগীদের দ্রুত খাদ্য সরবরাহ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা, (১৬) আর্থিক খাতের সকল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আল্লাহভীরু ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করা, (১৭) সর্বত্র ঈমানী পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং আল্লাহ্র নিকট তওবা-ইস্তেগফার করা এবং (১৮) ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় অপচয় পরিহার করা এবং অল্পে তুষ্ট থাকা।
মনে রাখতে হবে যে, সকল সৃষ্টবস্তুর চাহিদা ও যোগানের মালিক আল্লাহ। অনেক প্রাণী আছে যারা নিজেরা রুজি বহন করে না, কিন্তু আল্লাহ তাদের রুজি পৌঁছে দেন’ (হূদ ১১/৬; আনকাবূত ২৯/৬০)। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ ও ভূমির উর্বরা শক্তি তাঁরই দেওয়া অপার নেয়ামত (যারিয়াত ৫১/২২)। বান্দার দায়িত্ব কেবল চাহিদা ও যোগানে ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী বস্তুসমূহ দূর করা। বাজার ব্যবস্থাপনাকে স্থিতিশীল রাখা। অতএব, সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও সর্বোপরি সরকারের কর্তব্য হবে ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ নীতির আলোকে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা। তাতে মূল্যস্ফীতি কমে যাবে এবং বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, আমীন!

লেখক: আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও সাবেক শিক্ষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments