Tuesday, April 23, 2024
spot_img
Homeলাইফস্টাইলকাশির লক্ষণ দেখে চিকিৎসা

কাশির লক্ষণ দেখে চিকিৎসা

কাশি হলো শরীরের একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রতিবর্তী ক্রিয়া। যদি কখনো ধুলাবালি, ধোঁয়া বা অন্য কিছু আমাদের শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে, সঙ্গে সঙ্গে কাশি শুরু হয়। এ কাশির মাধ্যমে ধুলাবালি বা অন্য কোনো বস্তু শ্বাসনালি থেকে বের হয়ে যায়। এটাই হলো প্রকৃতির প্রতিরক্ষা। কাশি এভাবেই শ্বাসনালিকে পরিষ্কার রাখে। আমরা খেতে বসলে অনেক সময় খাদ্যকণা শ্বাসনালিতে চলে যায়, যদি কাশি নামক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না থাকত, তাহলে প্রতিনিয়ত শ্বাসনালির সংক্রমণ হতো।

কাশির প্রক্রিয়াটি তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমে শ্বাস ভেতরে নেয়, তারপর স্বরযন্ত্র বন্ধ অবস্থায় নিশ্বাস বের করার প্রচেষ্টা এবং সবশেষে সামান্য খোলা স্বরযন্ত্রের মধ্য থেকে হঠাৎ জোরে শব্দ করে নিশ্বাস ত্যাগ করা। বিস্তারিত লিখেছেন বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং ভারতের মাদ্রাজ শ্রী বালাজী মেডিকেল ইউনিভর্সিটির (চেন্নাই) ভিজিটিং প্রফেসর

ডা. এইচ. এন. সরকার

কথায় আছে-কোনো কিছুরই অতিরিক্ত ভালো নয়। তেমনি কাশি যদি অতিরিক্ত হয়, তখন সেটি রোগের উপসর্গ হিসাবে পরিগণিত হয়। যখন উপসর্গ হিসাবে কাশি দেখা দেয়, তখন কাশি স্বল্পস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং কাশি শুষ্ক হতে পারে বা কফযুক্ত হতে পারে।

কাশির অনেক কারণ আছে। বেশিরভাগ কাশি এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।

স্বল্পস্থায়ী কাশি

স্বল্পস্থায়ী কাশি দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয়; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাস দিয়ে হয়ে থাকে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। স্বল্পস্থায়ী কাশি নিম্নলিখিত কারণে হয়ে থাকে-

* ঊর্ধ্ব শ্বাসনালীর সংক্রমণ : গলা, শ্বাসনালি বা সাইনাসের সংক্রমণ যেমন- সাধারণ সর্দি, ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা, ল্যারিঞ্জাইটিস, সাইনোসাইটিস, হুপিং কাশি।

* নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণ : নিউমোনিয়া, একিউট ব্রংকাইটিস।

* অ্যালার্জি : অ্যালার্জিজনিত নাকের প্রদাহ।

দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোগের সাময়িক অবনতি যেমন- হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বা ক্রনিক ব্রংকাইটিস, ধুলোবালি মিশ্রিত বাতাস বা ধোঁয়া ইত্যাদি।

দীর্ঘস্থায়ী কাশি

দীর্ঘস্থায়ী কাশি আট সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণে হয়। যেমন-

দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, যেমন-যক্ষ্মা, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট, যেমন-

ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বা ক্রনিক ব্রংকাইটিস

* হাঁপানি বা অ্যাজমা

* ধূমপান : ধূমপায়ীর কাশি এবংম ধূমপান থেকে COPD-এর লক্ষণ হতে পারে।

* অ্যালার্জি

* ব্রংকিয়েক্টাসিস : যেখানে ফুসফুসের শ্বাসনালি অস্বাভাবিকভাবে প্রশস্ত হয়ে যায়।

* পোস্টন্যাজাল ড্রিপ : এ ক্ষেত্রে নাকের পেছন থেকে গলা দিয়ে শ্লেষ্মা ঝরে, যা রাইনাইটিস বা সাইনোসাইটিসের মতো অবস্থার কারণে হয়।

* গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ : যেখানে পাকস্থলীর অ্যাসিড বের হয়ে গলা জ্বালা করে।

* হার্ট ফেইলুরের জন্য কাশি হতে পারে।

* ফুসফুসের ক্যানসার।

* উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওষুধ যেমন এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ইনহিবিটর, আইসিনোপ্রিল, রেমিপ্রিলের কারণেও কাশি হতে পারে।

এখন আসি কাশি শুষ্ক এবং কফযুক্ত কাশি সম্পর্কে-

শুষ্ক কাশি

শুষ্ক কাশিতে কফ বের হয় না। কাশতে কাশতে সামান্য সাদা কফ বের হয়। ভাইরাসজনিত রোগে সাধারণত শুষ্ক কাশি হয়; তবে সেকেন্ডারি ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণ হলে হলুদ কফ হতে পারে। ধূমপানের কাশি, অ্যালার্জি এবং গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজের কাশি শুষ্ক কাশি হয়।

কফযুক্ত কাশি

কফযুক্ত কাশিতে মিউকয়েড মিউকোপ্রুলেন্ট বা প্রুলেন্ট কফ বের হতে পারে। কফের পরিমাণ সামান্য থেকে প্রচুর পরিমাণ হতে পারে, যেমন হাঁপানি রোগে অল্প কফ বের হয়, আবার ব্রংকিয়েক্টাসিসে প্রচুর কফ বা শ্লেষ্মা বের হয়।

কাশির কারণজনিত রোগগুলো আলোচনার আগে কাশির চিকিৎসা সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করে নেই।

কাশির চিকিৎসা

কাশির সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা হলো তার অন্তর্নিহিত কারণের চিকিৎসা। কাশি সৃষ্টিকারী রোগের চিকিৎসা করলেই কাশি ভালো হয়ে যায়। স্বল্পমেয়াদি কাশির জন্য সবসময় চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ভাইরাল সংক্রমণ দিয়ে হয়ে থাকে, যেমন সাধারণ ঠান্ডা, ফ্লু ইত্যাদি। এসব রোগ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজেই ভালো হয়ে যায়।

প্রাচীন কাল থেকে কাশি হলে আমরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছি। আমাদের মা-বাবা, দাদা-দাদি ও নানা-নানি কাশি হলে গরম পানি, তুলসীপাতার রস, বাসকপাতার রস ইত্যাদি খাওয়াত। এগুলোর প্রয়োজনীয়তা এবং কার্যকারিতা আজও আছে।

নিম্নে ঘরোয়া চিকিৎসার কতকগুলো উদাহরণ দেওয়া হলো-

বিশ্রামে থাকুন : বিশ্রাম যেমন ক্লান্তি বা অবসাদ দূর করে, তেমনি শ্বাসনালি এবং ফুসফুসকে আপেক্ষিকভাবে বিশ্রাম দিয়ে কাশিকে প্রশমন করে। কেননা, পরিশ্রম করলে শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায় যা কাশের রোগীর কাশি সৃষ্টিতে প্ররোচিত করে।

প্রচুর পানি পান করুন : পানি আমাদের শরীরের পানির পরিমাণকে বজায় রাখে। শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে আমাদের শরীর থেকে নিঃসৃত সব পদার্থই ঘন হয়ে যায়, তেমনই কফও ঘন হয়ে যায়। ফলে কাশি বের হতে কষ্ট হয়। উষ্ণ পানি পান করলে কফ তরল হয়ে কাশিতে বের হতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত তরল পান করলে শ্লেষ্মা পাতলা রাখতেও সাহায্য করে।

গরম পানির বাষ্প টানলে কাশি উপশম হয়। তার সঙ্গে একটু মেনথল দিলে আরও ভালো উপকার পাওয়া যায়। বাষ্প শ্লেষ্মাকে তরল করে কাশিতে বের হতে সাহায্য করে।

মধু একটি প্রচলিত ঘরোয়া প্রতিকার। মধু খেলে কাশি কমে এটা আমাদের সবারই জানা। তবে বটুলিজমের ঝুঁকির কারণে এক বছরের কম বয়সি শিশুদের মধু দেওয়া উচিত নয়। মধুর সঙ্গে লেবুর রস খেলে বেশি উপকার পাওয়া যায়।

গরম দুধ খেলে কাশি কমে এটা একটা প্রচলিত ধারণা; এটা ভুল। গরম দুধে কাশি কমে এরকম কোনো প্রমাণ নেই।

কাশি সৃষ্টিতে প্রভাবকারী উপাদানগুলোকে দূর করা-

ধূমপান ত্যাগ করা : ধূমপান সিওপিডি বা ক্রনিক ব্রংকাইটিস ছাড়াও কাশি সৃষ্টি করতে পারে, যেটিকে ধূমপায়ীদের কাশি (Smoker’s

cough) বলা হয়। ধূমপায়ীর কাশি সাধারণত সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কয়েকটা কাশি হয় বা ধূমপানের পর কাশি হয়, যা অল্প একটু কফ বা শ্লেষ্মা বের হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপান সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করলে ধূমপায়ীর কাশি বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি ক্রনিক ব্রংকাইটিসের কাশি ও শ্বাসকষ্ট কমে যায় এবং রোগীর আয়ু বাড়ায়।

ধুলাবালি (Dust) এড়িয়ে চলা : ধুলাবালি ও ধোঁয়া কাশি সৃষ্টি করতে পারে। যাদের ডাস্ট-অ্যালার্জি আছে, তাদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টও সৃষ্টি করতে পারে। রান্নার ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া ক্রনিক ব্রংকাইটিস সৃষ্টি করতে পারে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলা ভালো।

অ্যালার্জেন : যাদের অ্যালার্জি আছে, তাদের ক্ষেত্রে অ্যালার্জেন কাশি বা শ্বাসকষ্ট তৈরি করে। সবার সব কিছুতে অ্যালার্জি হয় না। কারও খাবারে অ্যালার্জি, কারও ধুলাবালিতে অ্যালার্জি, আবার অনেকের ওষুধে অ্যালার্জি। যার যেটায় অ্যালার্জি, সে জিনিসটি এড়িয়ে চলুন।

সর্দি কাশি হলেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া জরুরি নয়। অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক খেলে আমাদের শরীর ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে যায়।

কাশির সম্ভাব্য ওষুধ যা হতে পারে

কাশি হলো একটি উপকারী শারীরিক প্রক্রিয়া, যা শ্বাসনালি থেকে নিঃসৃত অতিরিক্ত তরল পদার্থ এবং বাইরের কোনো কিছু শ্বাসনালিতে ঢুকলে তা বের করে শ্বাসনালিকে পরিষ্কার রাখে। তাই কাশিকে বিবেচনাহীন যথেচ্ছা প্রশমন করা ঠিক নয়। আবার, কখনো কখনো কাশি তার উপকারী ভূমিকা পালন না করে বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়; বিশ্রাম এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। তখন কাশির ওষুধের প্রয়োজন হয়।

কাশির ওষুধ যেগুলো সচরাচর কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলো সাধারণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-

* কাশি প্রশমনকারী (Antitussive) : এ ধরনের ওষুধ কাশির সেন্টারের ওপর কাজ করে কাশি দমন করে। এ ওষুধগুলো যেমন ডেক্সট্রোমেথরফেন, কোডিন, বিউমেটারাইট ইত্যাদি শুষ্ক কাশিকে প্রশমিত করে।

* শ্লেষ্মা নির্গমনকারী (Expectorant)-এ ধরনের ওষুধ যেমন এন-এসিটাইল সিস্টিন (N-acetyl cystein) শ্লেষ্মাকে বের করে দিয়ে শ্বাসনালিকে পরিষ্কার করে, ফলে কাশি এবং শ্বাসকষ্ট কমিয়ে রোগীকে স্বস্তি দেয়।

কাশির ওষুধ নির্ধারণের সময় আমাদের সতর্ক হতে হবে। কারণ, কাশিতে সঠিক ওষুধ নির্ধারণ না হলে উপকারের পরিবর্তে অপকার হতে পারে; যেমন শ্লেষ্মাযুক্ত কাশিতে যদি কাশি প্রশমনকারী ওষুধ সেবন করা হয়, তাহলে শ্লেষ্মা শ্বাসনালিতে জমে গিয়ে শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করতে পারে, এমন কি জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

এ ছাড়াও নিম্নবর্ণিত ওষুধ কাশিতে ব্যবহার করা হয়-

* এন্টিহিস্টামিন (Antihistamine) : এন্টিহিস্টামিন যেমন ফেক্সফেনাডিন, রুপাটিডিন ইত্যাদি অ্যালার্জিজনিত কাশি প্রশমনে সাহায্য করে।

* শ্বাসনালি প্রসারণকারী ওষুধ (Bronchodilator) : শ্বাসনালি প্রসারণকারী ওষুধ যেমন সালবুটামল, টারবিউটালিন ইত্যাদি শ্বাসনালিকে প্রসারিত করে শ্লেষ্মা বের করতে সহয়তা করে; ফলে কাশি কমে যায়।

অন্তর্নিহিত কারণের চিকিৎসা

যদি কাশির কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে, তাহলে সেটির চিকিৎসা করলে কাশি ভালো হয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে কাশি হলে যেমন-নিউমোনিয়া; তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয় এবং রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।

* অ্যালার্জি : অ্যালার্জি আছে এমন জিনিসগুলো এড়িয়ে চলুন এবং আপনার অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া কমাতে অ্যান্টিহিস্টামিন গ্রহণ করে অ্যালার্জির চিকিৎসা করা যেতে পারে।

* হাঁপানি : হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালিতে প্রদাহ কমাতে স্টেরয়েড ইনহেলার এবং শ্বাসনালি প্রসারণকারী ওষুধ ইনহেলার ব্যবহার করা হয়। তাতে শ্বাসও কমে এবং কাশিও কমে।

শ্বাসনালি প্রশস্ত করা ব্রংকোডাইলেটর দিয়ে COPD-এর চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। যদি কেউ ধূমপান করেন, তাহলে ছেড়ে দিলে কাশির উন্নতিতেও সাহায্য করবে।

পাকস্থলীর অ্যাসিড ঊর্ধ্বগতির (GERD) কারণে কাশি হলে, অ্যাসিড নিরপেক্ষ করতে অ্যান্টাসিড বা পাকস্থলী থেকে অ্যাসিড উৎপন্ন কমাতে অমিপ্রাজল, এসঅমিপ্রাজল ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে; সঙ্গে সঙ্গে ডমপেরিডন ব্যবহার করবেন। এর সঙ্গে বিছানার মাথার দিকটা একটু উঁচু করে নিবেন অথবা উঁচু বালিশে ঘুমাবেন। রাতে অধিক খাবার খাবেন না। বিকালে চা, কফি বর্জন করুন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments