Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeধর্মকারাগারে লেখা কয়েকটি বিখ্যাত ইসলামী গ্রন্থ

কারাগারে লেখা কয়েকটি বিখ্যাত ইসলামী গ্রন্থ

যুগে যুগে বহু বিখ্যাত মনীষী রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা ধর্মীয় কারণে কারাজীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই আবার কারাজীবনের এই নির্ঝঞ্ঝাট সময়কে সদ্ব্যবহার করে লিখে গেছেন অমর কিছু গ্রন্থ। তেমনই কয়েকটি বিখ্যাত ইসলামী গ্রন্থের আলোচনা করা হলো—

১. আল মাবসুত : এটি হানাফি মাজহাবের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ও সর্ববৃহৎ ফিকহগ্রন্থ। গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুত থেকে ২০ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ‘ফিকাহ বিশ্বকোষ’ হিসেবে পরিচিত গ্রন্থটি তুলনামূলক ফিকাহর আকরগ্রন্থ হিসেবেও যুগ যুগ ধরে সমাদৃত হয়ে আসছে। কেননা এই গ্রন্থে ফিকহে হানাফির পাশাপাশি শাফেয়ি ও মালেকি মাজহাবের ফিকহও স্থান পেয়েছে। খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফকিহ ‘শামসুল আয়িম্মাহ’ খ্যাত আল্লামা মুহাম্মদ বিন আহমদ আস সারাখসি (১০৯৬ খ্রি.) গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনি বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের ‘সারাখস’ নগরীর অধিবাসী ছিলেন। নগরীর শাসকের সঙ্গে একটি ফিকহি মাসআলা নিয়ে মতবিরোধের জেরে ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। তিনি ১৫ বছর কারাগারের একটি নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন। এ সময় তিনি এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি রচনা করেন।

২. ইবনে তাইমিয়ার রচনাবলি : খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ও ফকিহ ইমাম ইবনে তাইমিয়া (মৃত্যু ১৩২৪ খ্রি.)। ইসলামী ফিকহ ও আকিদা সংক্রান্ত তাঁর মতবাদ ও দর্শনগুলো এখনো মুসলিম স্কলার ও দার্শনিকদের চর্চা ও গবেষণার বিষয়। ইরাকের ‘হারান’ শহরে জন্ম হলেও শিক্ষার্জন ও বেড়ে ওঠা সিরিয়ার দামেস্ক শহরে। মোঙ্গলদের নির্মম হামলায় মুসলিম বিশ্ব যখন ক্ষতবিক্ষত ও বিপর্যস্ত, তখনই ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর আবির্ভাব। মোঙ্গলদের সঙ্গে সম্মুখজিহাদেও তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন ফিকহি মাসআলা, ধর্মীয় ইস্যু ও বিশ্বাসগত বিষয় নিয়ে মতবিরোধের কারণে যৌবনের শুরু থেকে তিনি একাধিকবার কারাগারে বন্দি হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুও হয়েছে দামেস্কের একটি কারাগারে। জীবনের নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যেও তাঁর কলম থামেনি। একের পর এক লিখে গেছেন তাফসির, ইসলামী দর্শন, ফিকাহ, আকিদাসহ নানা বিষয়ের অমর সব গ্রন্থ। তাঁর রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৩৩০। বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থ হলো ‘আস সারিমুল মাসলুল আলা শাতিমির রাসুল’, ‘একতেজাউস সিরাতিল মুসতাকিম ফির রাদ্দি আলা আসহাবিল জাহিম’, ‘কিতাবুল ঈমান আল আওসাত’, ‘আর রিসালাতুল আরশিয়্যাহ’, ‘আর রিসালাতুল আকমলিয়্যাহ’, ‘কিতাবুল ইসতাকামা’, ‘আল ঈমান আল কাবির’, ‘আল রিসালাহ আল তাদাম্মুরিয়্যাহ’, ‘ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া’, ‘রাফউল মালাম আন আল আইম্মাহ ওয়া আল আলাম’ ইত্যাদি।

৩. ফি জিলালিল কোরআন : এটি একটি বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ। প্রখ্যাত মিসরীয় লেখক, কবি ও সাহিত্যিক সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.) (১৯০৬-১৯৬৬)-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা ‘ফি জিলালিল কোরআন’। তিনি সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত থাকা এবং নাশকতা মামলায় ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন। মিসরের আদালত তাঁকে ১৫ বছরের সাজা দেন। এ সময় তিনি এই বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থটির বেশির ভাগ রচনা করেন। এ ছাড়া তিনি সে সময় ‘আল মুসতাকবাল লি হাজাদ দ্বিন’ ও ‘হাজাদ দ্বিন’ শিরোনামে আরো দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৬৪ সালের মে মাসে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট একটি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

৪. মুখতাসার সহিহ মুসলিম : এটি সিহাহ সিত্তা বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থের অন্যতম ‘সহিহ মুসলিম’-এর একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। এখানে হাদিসের সনদ তথা বর্ণনাসূত্র এবং পুনারাবৃত্তি বাদ দিয়ে সহিহ মুসলিমের হাদিসগুলোকে সাধারণ পাঠক ও শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন আলবানি (১৯১৪-১৯৯৯) কারাগারে বসেই এই বহুল চর্চিত গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর হুকুমে কয়েকজন আলেমের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে আমাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। আল্লাহর পথে দাওয়াত ও মানুষকে ইসলামের শিক্ষা দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো অপরাধ ছিল না। আমাকে দামেস্কের বিভিন্ন কারাগারে রাখা হয়। কিছুদিন পর আমাকে মুক্তি দেওয়া হলেও অল্পদিনের ব্যবধানে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। এবার আমাকে একটি দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়। সেখানকার এক কারাগারে আমি কয়েক মাস কাটিয়েছি। এ সময় আমার সঙ্গে সহিহ মুসলিমের একটি কপি এবং একটি কলম ও দোয়াত ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেখানে আমি আমার অনেক দিনের লালিত আকাঙ্ক্ষাটি বাস্তবায়নের সুযোগ পাই। তিন মাস লাগাতার কাজ করে সহিহ মুসলিমের সংক্ষিপ্ত সংস্করণটি প্রস্তুত করি। এ সময় আমি রাত-দিন পরিশ্রম করেছি। কখনো ক্লান্তি বা বিরক্তি অনুভব করিনি। সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যার অনুগ্রহে ভালো কাজগুলো পূর্ণতা পায়।’

লেখক : প্রভাষক, আরবি বিভাগ,

ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments