Friday, April 19, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামএকা চলার সিদ্ধান্ত জামায়াতের, কোন পথে হেফাজত?

একা চলার সিদ্ধান্ত জামায়াতের, কোন পথে হেফাজত?

কাওরান বাজারের চিঠি

যেকোনো জোটের রাজনীতি পরিত্যাগের ব্যাপারে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দল হিসেবে জামায়াতের কৌশল হচ্ছে, তারা স্বতন্ত্র রাজনীতি করবে। তবে কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা থাকলেও থাকতে পারে। তা হবে কৌশলগত।


আইডিয়াটা সম্ভবত প্রয়াত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আনোয়ার জাহিদের। আওয়ামী লীগ বিরোধী সব ভোট এক বাক্সে নিতে হবে। তাহলেই আওয়ামী লীগকে ভোটের রাজনীতিতে হারানো সম্ভব। তিনি বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে এটি বুঝানোর চেষ্টা করেন। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন এটি জামায়াতের তৎকালীন আমীর গোলাম আযমের ধারণাপত্র। সে যাই হোক এই ধারণার আলোকেই গড়ে ওঠে চারদলীয় জোট। তবে এর আগে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল জামায়াত।

সেই সরকারে যদিও ধর্মভিত্তিক এই দলটির কোনো অংশীদারিত্ব ছিল না। চারদলীয় জোট অবশ্য অষ্টম সংসদ নির্বাচনের আগেই হোঁচট খায়। ক্যাম্প বদলের জন্য বিখ্যাত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জোট ছেড়ে দেন। তার দলের নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর থেকে যান চারদলীয় জোটে। জোড়াতালি দিয়ে জোটের নামটাও অক্ষুণ্ন রাখা হয়। নির্বাচনে ভূমিধস জয়লাভ করে এই জোট। ভোটে জয়লাভের পরপরই জামায়াতে দু’টি প্রশ্ন নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়- ১. সরকারে জামায়াতের অংশ নেয়া উচিত হবে কিনা? ২. অংশ নিলে দল থেকে মন্ত্রী হবেন কারা? শেষ পর্যন্ত জামায়াতের তখনকার আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। সমালোচকরা এই জোটকে বিএনপি-জামায়াত জোট হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় জঙ্গিবাদের উত্থানের দৃশ্য দেখা যায়। 

কেউ কেউ এর জন্য জামায়াতকে দায়ী করে থাকেন। দলটির মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার ইস্যুটিও নতুন করে সামনে আসে। চারদলীয় জোট সরকারের শেষদিকে পরিস্থিতি নাজুক হতে থাকে। মেয়াদের শেষ মুহূর্তে রাজপথে অসহায় হয়ে পড়ে জামায়াত। ২৮শে অক্টোবরের ঘটনা দলটির ভেতরে-বাইরে তোলপাড় তৈরি করে। নানা নাটকীয় ঘটনাবলীর এক পর্যায়ে ওয়ান ইলেভেন সংঘটিত হয়। তবে জরুরি জমানার শুরুতে জামায়াতকে তেমন কোনো বড় বিপাকে পড়তে হয়নি। বরং অন্যান্য দলের নেতারা গণহারে গ্রেপ্তার হলেও জামায়াতের নেতাকর্মীরা এর বাইরে থেকে যান। তবে সে সময়ই তৈরি হয় জামায়াতের রাজনীতির একটি অধ্যায়ের সমাপ্তির পটভূমি। নতুন করে আন্দোলন শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। ‘বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই’ জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের এমন একটি মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে  তোলে। নবম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে একধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব সেখানে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষেই মত দেয়। বিশেষ করে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ভূমিকা এক্ষেত্রে আলোচিত।  

এমনিতে জামায়াতের ভেতরে কী আলোচনা হয় তার বেশির ভাগই প্রকাশ্যে আসে না। তবে দলটির তৎকালীন শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে কিছু বিষয়ে ভিন্নমতের বিষয়টি পরে প্রকাশ্যে এসেছে। প্রধানত দুটি ইস্যুতে দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার মোটাদাগে ভিন্ন আলোচনা দেখা গিয়েছিল। প্রথমত, তারা এটি আলোচনায় আনার চেষ্টা করেন যে, জামায়াতের বাইরে কোনো ‘কল্যাণমূলক’ দল বা সংগঠন গড়ে তোলা যায় কিনা? এক্ষেত্রে তারা মিশর, তুরস্কসহ কয়েকটি দেশে ইসলামপন্থি দলগুলোর মডেল অনুসরণের কথা বলেন। দ্বিতীয়ত, আরেকটি বিষয় মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করা। তবে এ দুটি ধারণাই শেষ পর্যন্ত জামায়াতে জনপ্রিয়তা পায়নি। বিশেষ করে দলের পুরনো এবং প্রবীণ নেতারা এ ধরনের সংস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ এ ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। এই তত্ত্বের নেতা হিসেবে আলোচিত ছিলেন তৎকালীন জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান প্রমুখ।  ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়। দেশি-বিদেশি নানা উপাদান জড়িয়ে পড়ে এরমধ্যে। শুরুতে শাসক দলকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলেও  দ্রুতই অ্যাকশনে যায় তারা। প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

 একে একে গ্রেপ্তার করা হয় জামায়াতের সব শীর্ষ নেতাকে। বেশির ভাগেরই রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় এবং তা পরে ক্রমান্বয়ে কার্যকরও হয়। কারাবন্দি থাকা অবস্থাতেই মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি জামায়াতের তখনকার নেতৃত্বকে। তা অবশ্য আমলে নেয়া হয়নি। এরমধ্যে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াতও বর্জন করে। শীর্ষ নেতাদের রক্ষা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের তৃণমূল নেতৃত্বকে কড়া মূল্য শোধ করতে হয়। রাজপথে নিহতের সংখ্যাও কম নয়। গ্রেপ্তার, রিমান্ড ছিল মামুলি ব্যাপার। সহিংসতার জন্যও আবার অনেকে জামায়াতকে দুষে থাকেন।  ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকে। বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক নিয়েও তৈরি হয় নানা আলোচনা-টানাপড়েন। আন্তর্জাতিক মহলের একটি অংশেরও আপত্তি দেখা যায় জামায়াতকে নিয়ে। বিএনপি নেতৃত্বও দৃশ্যত দুই ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশ জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। নানা টানাপড়েন তৈরি হয় বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে। নিবন্ধন হারানো জামায়াত দৃশ্যত জোটে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিগত সংসদ নির্বাচনের আগে গড়ে ওঠা ঐক্যফ্রন্ট জামায়াতের গুরুত্ব একেবারেই কমিয়ে দেয়। 

যদিও শেষ পর্যন্ত গত নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকেই অংশ নেয় জামায়াত। ভোট কী ধরনের হয়েছে তা যেমন সবার জানা সে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিপর্যয়ের বিষয়টিও সবার জানা। নির্বাচনে জামায়াত একটি আসনেও জয়লাভ করেনি। ভোটের পর নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু হয় জামায়াতে। জামায়াত ত্যাগের ঘোষণা দেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। যদিও আগে থেকেই তিনি লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তবে তার দলত্যাগ জামায়াতের জন্য বড় আঘাত হিসেবেই দেখা হয়। কারণ দলের আইনি দিক পুরোটাই দেখভাল করতেন তিনি। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক মহলেও তার ভালো যোগাযোগ ছিল। দল ত্যাগের আগেও তিনি সংস্কারের পক্ষে সরব ছিলেন। তবে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় দল ত্যাগের পরও যেন আবদুর রাজ্জাকের ব্যাপারে সংগঠনের কোনো পর্যায় থেকেই আপত্তিকর মন্তব্য করা না হয়। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের দলত্যাগ নিয়ে ১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ যুগান্তরের রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া ও দল বিলুপ্তির পরামর্শ দিয়ে জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক।

 তিনি দলটির সহকারী  সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। রাজ্জাকের পদত্যাগের বিষয়ে এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামীর  সেক্রেটারি জেনারেল (তৎকালীন) ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকসহ আমরা দীর্ঘদিন একই সঙ্গে এই সংগঠনে কাজ করেছি। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল  নেতা ছিলেন। দলে তার সব অবদান আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। রিপোর্টে আরও বলা হয়, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী নেতাদের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক গত ছয় বছর ধরে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তিনি পদত্যাগপত্রে দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, জামায়াত ’৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি এবং একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার আলোকে এবং অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি। বলে রাখা দরকার ব্যারিস্টার রাজ্জাক পরবর্তীতে এবি পার্টিতে সংযুক্ত হলেও তিনি দেশে ফিরেননি এবং দলটির তেমন কোনো কার্যক্রমেও তাকে দেখা যায়নি। প্রধানত শিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জুর উদ্যোগে তৈরি এ সংগঠন জামায়াতের মধ্যেও তেমন কোনো ভাঙন তৈরি করতে পারেনি।

 গত সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কও অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়ে। প্রচলিত রাজনীতি থেকে বের হওয়ার পক্ষে জামায়াতের একটি অংশ সরব হয়। এর জেরেই সম্ভবত জামায়াতের নতুন আমীর ডা. শফিকুর রহমান নানা সামাজিক কার্যক্রমে দেশের একাংশ থেকে আরেকাংশে ছুটে যান। তবে সম্প্রতি দলটির কার্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ঢাকায় নানা ইস্যুতে একাধিক বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে জামায়াতকে। এর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের গুঞ্জনও তৈরি হয়। যদিও জামায়াতের সংশ্লিষ্ট সূত্র তা স্বীকার করেনি। তবে জামায়াতের রাজনীতির অন্দরমহলের খবর রাখেন এমন একাধিক পর্যবেক্ষক বলেন, রাজনীতি থেকে দূরে আসার ব্যাপারে দলে এখন জোরালো মত নেই। বরং যেকোনো জোটের রাজনীতি পরিত্যাগের ব্যাপারে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দল হিসেবে জামায়াতের কৌশল হচ্ছে, তারা স্বতন্ত্র রাজনীতি করবে। তবে কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা থাকলেও থাকতে পারে। তা হবে কৌশলগত। দীর্ঘদিন পর হেফাজতে ইসলামের খবর দেখা গেল। গত বুধবার মানবজমিনে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, হেফাজতের আমীর মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে দেখা করেছেন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও ফটিকছড়ি থেকে নির্বাচিত এমপি  সৈয়দ নজিবুল বশর ভাণ্ডারী। রোববার দুপুরে ফটিকছড়িতে হেফাজত আমীরের পরিচালিত বাবুনগর মাদ্রাসায় ঝটিকা সফরে আসেন ভাণ্ডারী। 

তার এই আসাকে নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎকার বলা হলেও বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে কৌতূহল। নানা ইস্যুতে হেফাজতে ইসলামের বড় ধরনের আত্মপ্রকাশ ছিল নাটকীয়। ঘটনাবহুল সময় পার করতে হয়েছে অরাজনৈতিক সংগঠনটির নেতাদের। মতভেদ, চাপ, শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুতে এক পর্যায়ে অনেকটাই ভেঙে পড়ে সংগঠনটি। আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর দায়িত্ব নেন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী। কিন্তু আল্লামা শফীর সমর্থক একটি অংশ তা মেনে নেয়নি। পরবর্তীতে জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর দায়িত্ব পান মহিবুল্লাহ বাবুনগরী। কিন্তু এ ব্যাপারে সংগঠনটির সব নেতা একমত নন। এরমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ নেতাই গ্রেপ্তার হন। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখনো কারাগারে রয়েছেন। জামায়াত ও হেফাজত। আদর্শিক দিক থেকে দূরত্ব রয়েছে দুটি দল বা সংগঠনেরই। কিন্তু দুই শিবিরই এখন বিপর্যস্ত। তাদের গন্তব্য কোথায় সেদিকে কৌতূহল রয়েছে রাজনৈতিক মহলের।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments