বদিউর রহমান
খেলাপি কাকে বলে তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। যার যার সুবিধা অনুযায়ী একেকজন একেক ব্যাখ্যা দিতে পারেন। এই ধরুন, মাসের ১০ তারিখের মধ্যে আমার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার চুক্তি হয়েছে, আমি ১০ তারিখের মধ্যে কিস্তি পরিশোধ করলাম না। আমি কি খেলাপি হলাম? সোজাসাপটা ব্যাখ্যায় আমি খেলাপি হয়েছি। বিল পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখ শেষ হলেই আমি কিন্তু খেলাপি হলাম।
হ্যাঁ, এমনতর খেলাপির জন্য কিছুটা জরিমানা দিয়ে পরে পরিশোধের সুযোগ থাকে বিধায় শোধ করে দিলে আর খেলাপির খাতায় নাম ওঠে না। এর মেয়াদ প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্নতর হয়-এটা স্বাভাবিক। ব্যাংকের ঋণ, কোনো সমিতির ঋণ, এমনকি সরকারি বা অন্য চাকুরের সরকারের কাছ থেকে কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত ঋণের বা অগ্রিমেরও একটা নির্দিষ্ট পরিশোধ-মেয়াদ স্থির করা থাকে। দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত মোতাবেক যথাসময়ে কিস্তি, আসল, সুদ-যা যা হিসাবমতো ধার্য হয়, তা নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করা হলেই তিনি খেলাপি নন। ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুসারে ঋণ প্রদানের আগে সাতঘাট বেঁধে তবে তো ঋণ প্রদান করে থাকে। গ্রহীতার পরিশোধের সামর্থ্য আছে কি না, ব্যবসা গ্রহণ করা হলে সেই ব্যবসার স্বরূপ কেমন, ব্যর্থ হলে এর বিপরীতে জামানত বা বন্ধক রাখা সম্পত্তির প্রকৃত বাজারমূল্য যাচাই করে দেখা; ব্যক্তি জামিনদার থাকলে তার সচ্ছলতা-কত আঁটুনি-বাঁধুনি যে থাকে এর কি শেষ আছে? না, নেই। কিন্তু তারপরও খেলাপি কেন হয়?
খেলাপি হওয়ার মূল কারণ মোটা দাগে দুটি। এক. প্রথম যাচাই-বাছাইয়ে ঋণগ্রহীতার প্রদত্ত তথ্যাদি, কাগজপত্র, জামানত প্রভৃতি সঠিকভাবে দেখা হয় না। ঋণদাতার অদক্ষতার চেয়েও এক্ষেত্রে যোগসাজশের বড় অভিযোগ থেকে যায়। যিনি বা যারা এসব যাচাই-বাছাই করে থাকেন, তাদের অসততা, ব্যক্তিগত লাভের হিসাব, লোভের মানসিকতা একভাবে না একভাবে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে ফেলে। ফলে যিনি শর্ত পূরণ করে ঋণ পাওয়ার যোগ্য নন, তিনিও পেয়ে যান। এরা পরে খেলাপি হয়ে যান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। দুই. একশ্রেণির ঋণগ্রহীতা ঋণ নেওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তিনি টাকাটা মেরে দেবেন। ঋণটা তিনি নেনই মেরে দেওয়ার জন্য। এই শ্রেণির ঋণগ্রহীতা কইয়ের তেলে কই ভেজে থাকেন। এরা ঋণদাতার সঙ্গে ঋণের টাকাটাই শেয়ারিং করে ফেলেন। এতে প্রতিষ্ঠানের বারোটা বাজলেও প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ ও গৃহীতা-উভয়পক্ষই নিজেরা লাভবান হয়। হালে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের ফটকাবাজরা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছেন। এক বেসিক-বাচ্চুর কথা শুনলে তো ভিরমি খেতে হয়। অতএব, এসব ঋণখেলাপির জন্য বারবার অনৈতিক সুবিধা খোদ সরকারই দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো নিজের টাকাই হেফাজত করতে পারে না, অন্যেরা নিয়ে যায়; এ ব্যাংক আবার তফশিলি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে কীভাবে?
বিলখেলাপি হলে আমাদের কত সাজা, কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠান, এমনকি খোদ সরকারি মন্ত্রণালয়/বিভাগও কোটি কোটি টাকার বিলখেলাপি হয়, তাদের সাজা হয় না কেন? তাদের লাইন কাটা হয় না কেন? এক দেশে আইনের দুরকম ব্যাখ্যা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? হাজার টাকার ঋণের জন্য কৃষকের কোমরে দড়ি লাগিয়ে জেলে নেওয়া হয়, তাদের হাজতে থাকতে হয়; আর কোটি কোটি টাকার খেলাপির জন্য বারবার তফশিলীকরণ, এটা মাফ ওটা মাফ, সুযোগে পুরো সুদই মাফ, আরও কত মাফ আর মাফ! কী যে আমাদের শাসন, প্রশাসন, সুশাসন, নাকি অপশাসন, কুশাসন ও দুঃশাসন? এসব কি শাসন থেকে পরে শোষণ হয়ে পড়ছে না?
ঋণখেলাপি আর বিলখেলাপি আমরা যারা হচ্ছি, কেন হচ্ছি? উত্তর একটাই-আমাদের মাথায় পচন ধরেছে। আমাদের মাথাটি কী? মাথাটি হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতিতে যদি পচন ধরে, তাহলে আর বাঁচাবে কে? রাজনীতি ছাড়া দেশ অচল, চুরি-ডাকাতি যা-ই করুক না কেন, রাজনীতিক ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। ফলে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় আসার পর তাদের নির্বাচনি ইশতাহার মতো কাজ চললে রাজনৈতিক দলের খেলাপি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। রাজনৈতিক দল খেলাপি না হলে অপশাসন ও দুঃশাসন বা কুশাসন আসারও কোনো ফুরসত থাকে না। কিন্তু রাজনৈতিক দল যদি খেলাপি হয়ে পড়ে অর্থাৎ দলের লোকজন যদি পান্ডামি, গুন্ডামি করে, নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে মাস্তানি করে লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পাড়ে, একটু ক্ষমতার জন্য, মন্ত্রিত্বের জন্য নীতিনৈতিকতা বাদ দিয়ে বড় কোনো দলের লেজুড় হয়ে যায়, অন্য দলের মার্কায় ভোট করে, তাহলে তো আমজনতা আবার অসহায়। অতএব, রাজনীতিতে দলখেলাপি এখন আমাদের আরেক বড় রোগ, দুষ্ট ক্ষত। এ রোগ সারাতে না পারলে, এ ক্ষতি বেড়ে যাওয়ার আগে থামাতে না পারলে রাজনীতিতে অবশ্যই গ্যাংরিন হবে। গ্যাংরিন হলে তো আর উপায় নেই, কেটে ফেলে দিতে হবে। রাজনীতিকেই যদি কেটে ফেলতে হয়, তাহলে থাকব কী নিয়ে? আবার কি তেরেমেরে ডান্ডা, করে দেব ঠান্ডা? ডান্ডায় মুক্তি তো আমরা কখনো পেলাম না, বারবার তো ডান্ডার খেলা দেখলাম।
আমরা বলতে চাই, ঋণখেলাপি কঠোরভাবে দমন করা হোক। আমরা দেখতে চাই কৃষকের কোমরে দড়ি না লাগিয়ে বড় বড় ঋণখেলাপির হাতে হাতকড়া লাগানো হোক। বিলখেলাপি ব্যক্তিকে কেবল হযরানি না করে আগে বড় বড় সরকারি-বেসরকারি বিলখেলাপিদের খেলাপি বিল অনতিবিলম্বে আদায় করা হোক। তাদের লাইন কেটে দিয়ে নজির স্থাপন করা হোক। এগুলো কে করবে? করবে তো সরকার। আর সরকার কে চালায়? সরকার তো চালায় ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দল। অতএব, রাজনৈতিক দল যেন খেলাপি না হয়, সেটা দেখতে চাই সবার আগে। রাজনীতি ঠিক তো রাজনৈতিক দলও ঠিক, রাজনীতিতে দলখেলাপি তাই সর্বাগ্রে বন্ধ করতে হবে। এটা বন্ধ করতে হলে একজনা-দুজনা নামসর্বস্ব কিংবা সাইনবোর্ডসর্বস্ব কোনো রাজনৈতিক দলকে যেন বড় কোনো দল আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়, তা আমরা দেখতে চাই। ‘নিবন্ধন পেতে ৯৮ রাজনৈতিক দলের আবেদন-কার্যালয়-কার্যক্রম নেই অনেক দলের’ (যুগান্তর, ১ নভেম্বর ২০২২)-এমন খবরও আমরা আর দেখতে মোটেই আগ্রহী নই। ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি, রাজনীতিতে দলখেলাপি নিপাত যাক, নিপাত যাক।
যখন সত্তরের দশকের শেষের দিকে প্রথম শ্রেণির অফিসার হিসাবে সরকারি কর্মকমিশন-১-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করলাম, তখন আমাদের ছয় মাসের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং এবং ছয় মাসের বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ের যে কড়া প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো, তা আজও ভুলতে পারি না। এ প্রশিক্ষণের বদৌলতে এক সুযোগেই ব্যাংকিং ডিপ্লোমা প্রথম পার্ট পাশ করা আমাদের খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমরা তখন বলতাম, সৎভাবে চাকরি করার জন্য এ ব্যাংকের চাকুরেরা আগে বেহেশতে যাবে। কোথায় গেল আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই দিনগুলো! এত কঠোর ছিল আমাদের ১৯৭৬-এর ৮০ জনের ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়া। আজ মনে পড়ে, বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ের প্রশিক্ষণ পড়েছিল আমার অগ্রণী ব্যাংকে। প্রতি সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ-কোঅর্ডিনেটর সহকারী মহাব্যবস্থাপক নিজামুল ইসলাম (যতটুকু নাম মনে পড়ে) তার হেড অফিসের কক্ষে হাতেকলমে পরীক্ষা নিতেন, আমাদের নোট-খাতা দেখতেন, মৌখিক প্রশ্ন তো করতেনই। অ্যাডভান্স শাখায় কাজ করার সময় ঋণ প্রদানের সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি পইপই করে ঝালাই করে দিতেন। ঘুস বলতে এ শাখায় বড়জোর একটু চাইনিজ খাওয়ানো ছিল তখন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করার সময় সংশ্লিষ্ট অফিসার চাইনিজ খেতে সুযোগ পেতেন, কখনো কখনো। আমরা বলতাম,…ভাই বেহেশতের গেটে একটু ধরা খাবেন। মনিটরিং থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন কঠোরভাবে পালিত হলে খেলাপি হবে কেমন করে? তাহলে কি বলা যায়, গোড়ায় গলদ রয়ে গেছে। না কি?
বাড়ি করার জন্য আমার ব্যাংক ঋণের কড়াকড়ি একটু শেয়ার করি। ব্যাংক আমার বাড়ি তো বন্ধক নিল, পুরো এক কোটি বিশ লাখ টাকার একটা তারিখবিহীন চেক নিয়ে নিল, মাসিক সোয়া লাখ টাকার উপরের কিস্তির ছয় মাস ছয় মাস করে ১৫ বছরে যতটা চেক হয়, তারিখবিহীনভাবে ততগুলো চেকও স্বাক্ষর করিয়ে নিল। আমার বয়স ৬০-এর বেশি বলে ছোট ছেলেকে যৌথ আবেদনকারী করে নিল, বড় ছেলেকে জামিনদার করে নিল। আমার আর বাকি থাকিল কী? বললাম, স্ত্রীটা আর বাদ রাখলেন কেন, ওটাও নিয়ে নিন-আমার সব আপনাদের হয়ে যাক এক ঋণের বিনিময়ে। এই যদি কঠোর অবস্থান হয়, তাহলে খেলাপি হওয়ার সুযোগ কোথায়? তারপর আবার কম্পিউটার কিস্তির সমপরিমাণ থেকে ব্যাংকে এক পয়সা কম থাকলেও কিস্তি নেয় না। প্রতিদিনের জন্য জরিমানা-সুদ হয়, প্রতি তিন মাস অন্তর জমে যাওয়া সুদ আবার আসল হয়ে যায়। আমাদের জন্য এত কড়াকড়ি হলে বড় বড় ঋণখেলাপি হয় কোন মাজেজায়? আমরা কি তাহলে ‘সব সুবিধা খেলাপিদের জন্যই’, ‘খেলাপি ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে’ (প্রথম আলো, ১৫ নভেম্বর ২০২২) অবিশ্বাস করব? ‘বিডিবিএল নিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন-ঋণের ১৩৩ কোটি টাকা হজম’, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, বিআরপিডির সার্কুলার ও নীতিমালা লঙ্ঘন করে ঋণ ইস্যু, টাকা গেছে অস্তিত্বহীন ব্যবসা, জামানত অতি মূল্যায়ন ও ভুয়া এমওইউতে’ (যুগান্তর, ২০ অক্টেবর ২০২২)-অবিশ্বাসের জো আছে? সুশাসন লাটে উঠলে যা হয় আর কী।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান