ই-কমার্স কম্পানির লোভনীয় অফারের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত লাখো গ্রাহকের পাওনা প্রায় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়া প্রায় অনিশ্চিত। ১৩টি কম্পানির কাছ থেকে গ্রাহকরা আংশিক টাকা ফেরত পেলেও ১৪টি কম্পানি কোনো টাকাই দেয়নি।
গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ার সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল বলছে, গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে প্রতারিত গ্রাহকের তথ্য পাওয়া কঠিন। কম্পানিগুলো এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে না। এতে বিপুল অঙ্কের ওই টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
অভিযোগ ওঠা কম্পানির কেউ কেউ আগেই দেশ ছেড়েছেন, কেউ বা গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। আবার কয়েকটি কম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কম্পানির টাকার দায় নিচ্ছে না কেউ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, ইভ্যালি নিয়েছে এক হাজার কোটি টাকা, ই-অরেঞ্জের গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের পাওনা এক হাজার ১০০ কোটি টাকা, ধামাকা নিয়েছে ৮০৩ কোটি টাকা, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১৫০ কোটি টাকা, এহসান গ্রুপ ১১০ কোটি টাকা, নিরাপদডটকম আট কোটি টাকা, চলন্তিকা ৩১ কোটি টাকা, সুপম প্রডাক্ট ৫০ কোটি টাকা, নিউ নাভানা ৩০ কোটি টাকা, কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং ১৫ কোটি টাকা, সিরাজগঞ্জশপ ৪৭ কোটি ও আলাদিনের প্রদীপ নিয়েছে ১০০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া বিভিন্ন কম্পানি ও মার্চেন্টের কাছ থেকে বাকিতে নেওয়া পণ্যের অর্থও ফেরত দেয়নি অভিযোগ ওঠা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই টাকার কোনো হিসাব দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ই-কমার্স খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে বা যাদের কাছে মার্চেন্ট ও ভোক্তারা টাকা পাবে, তাদের কাছে দুই ধরনের অর্থ রয়েছে। একটি হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) বা নির্দেশিকা হওয়ার আগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাওয়া অর্থ। সেই অর্থ দেওয়ার জন্য সরকার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যে যাদের ব্যবসা চালু হবে, তারা ব্যাবসায়িক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নজরদারিতে থেকে গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করবে।
আর যাদের ব্যবসা আইনভঙ্গ করার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের বিষয়ে প্রচলিত আইনে সরকার বা আদালত আলাদা সিদ্ধান্ত দেবেন। যাদের অর্থ পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে আছে, তাদের ক্ষেত্রে তালিকা ও অভিযোগ যাচাই করে টাকা পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) যুগ্ম সম্পাদক নাসিমা আক্তার নিশা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ই-কমার্স খাতে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের পাশাপাশি অনেক মার্চেন্টের টাকাও আটকে গেছে। যেসব মার্চেন্টের টাকা আটকে আছে, তারা সর্বস্ব বিক্রি করে এখানে বিনিয়োগ করেছে। কিউকমের কাছে এখনো অনেক মার্চেন্টের টাকা আটকে আছে।’
নাসিমা আক্তার বলেন, ‘সরকার কিছু কম্পানির টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এখনো অনেক মানুষের টাকা ফেরত দেওয়া যায়নি। এতে পারিবারিক অশান্তি হচ্ছে, সামাজিক কলহ হচ্ছে। টাকাগুলো যত দ্রুত পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে দিয়ে দেওয়া যায়, ততই ভালো। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভালো ব্যবসায়ীদের ওপর।’
ফিরেছে সামান্যই : বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেয় কিউকমে আটকে থাকা টাকা দিয়ে। ২০২১ সালের ৩০ জুন এসক্রো পদ্ধতি চালুর পর থেকে কিউকমের গ্রাহকদের আটকে থাকা ৫৯ কোটি টাকা ফেরতের তালিকা করা হয় গত বছরের জানুয়ারিতে। কিউকমের পর আলেশা মার্ট, দালাল প্লাস, বাংলাদেশ ডিল, আনন্দের বাজার, শ্রেষ্ঠ ডটকম, আলিফ ওয়ার্ল্ড, ধামাকাসহ ১১টি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের আংশিক টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। ২৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১১০টি মামলা রয়েছে। সিআইডি মোট ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে।
পেমেন্ট গেটওয়ের টাকা : বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগ ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্রয়াদেশ দেওয়ার পর বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে রয়েছে প্রায় ৫২৫ কোটি টাকা। এর মধ্য থেকে গ্রাহক ফেরত পেয়েছেন ৩২৪ কোটি টাকা। বাকি ২০১ কোটি টাকা এখনো ফেরত পাননি গ্রাহকরা। সবচেয়ে বেশি ফেরত দিয়েছে ফস্টার পেমেন্ট। এ হিসাব ২০২১ সালের ৩০ জুনের পরবর্তী সময়ের। তবে ২০২১ সালের ৩০ জুনের আগের সময়ে প্রতারিত কোনো গ্রাহকের দায়িত্ব সরকার নিতে চাইছে না।
ফেরত দেয়নি ১৪ প্রতিষ্ঠান : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৫২৫ কোটি টাকার মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কোনো টাকাই ফেরত দেয়নি। ১৩টি ফেরত দিয়েছে আংশিক টাকা। ফেরত না দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ইভ্যালি, সিরাজগঞ্জ শপ, নিডস, টোয়েন্টিফোর টিকেটি, ই-অরেঞ্জ, উইকুম, আকাশ নীল, প্রিয় শপ, আলাদীনের প্রদীপ, আমার বাজার, আস্থার প্রতীক, বাড়ির দোকান ডটকম, নিরাপদ ও ইনফিনিটি মার্কেটিং লিমিটেড।
ই-ক্যাবের তথ্য মতে, সব মিলিয়ে দেশে প্রায় আড়াই হাজার ই-কমার্স সাইট আছে। ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ব্যাবসায়িক উদ্যোগ রয়েছে দেড় লাখের বেশি। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে পরিচালনা করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম পাওয়া গেছে এক হাজার প্রতিষ্ঠানের।
গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ার সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল। এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমরা ৩০০ কোটি টাকার বেশি ফেরত দিয়েছি। বাকি টাকা ফেরত দেওয়ার কাজ চলছে। প্রতারিত গ্রাহকের তথ্য পাওয়া কঠিন হচ্ছে। কম্পানিগুলোও আমাদের তথ্য দিতে পারছে না।’
গ্রাহকের পাওনার পরিমাণ কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পেমেন্ট গেটওয়েতে থাকা টাকা পাওনার পরিমাণ ৫০০ কোটির বেশি। গেটওয়ের বাইরে কত টাকা, তার তথ্য পাওয়া মুশকিল। ইভ্যালি আমাদের নির্দিষ্ট তিনটি তারিখে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু তারা তালিকা দিতে পারছে না। নতুন করে কোনো কম্পানির ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়নি। তবে কম্পানি সাতটি বন্ধ হয়েছে। এদের বড় অংশ জুয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল। নতুন করে আর প্রতারণা করার সুযোগ নেই। কেউ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, বিশ্বে ই-কমার্স ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও বাংলাদেশে যথাযথ উদ্যোগ ও যুগোপযোগী আইনের অভাব, সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে বিভ্রান্তি ও কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার জন্য এই খাত যতটা বিকশিত হওয়ার কথা তা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যমান আইন সংশোধনের মাধ্যমে যথাযথ প্রয়োগ করে প্রতারণামূলক ই-কমার্স ব্যবসাগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি আইন প্রয়োগের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া দক্ষ জনবল বৃদ্ধি এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।
ই-ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ই-কমার্স খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশ। ২০২২ সালে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়েছে। করোনার আগে খাতটিতে ৩০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল।
ই-কমার্স খাতে প্রবৃদ্ধি কমার কারণ জানতে চাইলে ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিছু কম্পানির ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাবসায়িক মডেলে গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণে খাতটিতে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বেশির ভাগ কম্পানির সম্পদের তুলনায় দায় এত বেশি যে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ কম। ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত ১৬টি কম্পানির সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ২৪টি কম্পানি নিয়ে তদন্ত করছে। গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া গেলে খাতটিতে আস্থা ফিরে আসবে বলে আশা করি।’