আল্লামা ইবনে খালদুন বলেন, শ্রমের মূল্য হ্রাস করা শ্রমিকের প্রতি অবিচার। যে ব্যক্তি উপযুক্ত পারিশ্রমিকের চেয়ে কম মূল্যে শ্রমিক নিয়োগ দিল, সে শ্রমিকের অধিকার লুণ্ঠন করল। শ্রমিক তার পরিশ্রমের সমান পারিশ্রমিক পাবে। (মুকাদিমায়ে ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা ৫১২)
ইসলাম শ্রমিকের মানবিক ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করে এবং শ্রমিক যেন সম্মানজনক সামাজিক মর্যাদা লাভ করে সে পরিমাণ মজুরি নির্ধারণের নির্দেশ দেয়। এ ক্ষেত্রে ইসলাম যে বিষয়গুলোকে মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করে তা তুলে ধরা হলো।
যথাযথ মজুরি নির্ধারণ করা : ইসলাম শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরি নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মজুরি নির্ধারণ করা ব্যতীত শ্রমিক নিয়োগ করতে নিষেধ করেছেন।
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৪৯০)
আর শ্রমিকের মজুরি কেমন হবে তা-ও তিনি বলে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, যথোপযুক্ত খাদ্য ও পরিধেয় মালিকানাধীন (বা অধীন) ব্যক্তির প্রাপ্য। (মুয়াত্তায়ে মালিক, হাদিস : ৪১)
উল্লিখিত হাদিসে ব্যবহৃত ‘মারুফ’ বা যথোপযুক্ত শব্দটি তাৎপর্যবহ। কেননা কোনো পারিশ্রমিককে তখনই যথোপযুক্ত বলা যাবে, যখন তা শ্রমিকের মানবিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা ও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দেবে।
মজুরি নির্ধারণের মূলনীতি : রাসুলুল্লাহ (সা.) শ্রমিকের প্রাপ্য সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক হাদিস বর্ণনা করেছেন। যাকে ইসলামী শ্রম আইনে পারিশ্রমিক নির্ধারণের মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। তিনি বলেন, তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে আল্লাহ তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়, তা-ই পরিধান করায় যা সে পরিধান করে এবং তার ওপর এমন কোনো কাজের বোঝা চাপাবে না, যা তার সাধ্যাতীত। আর যদি এমন কাজের বোঝা চাপাতে বাধ্য হয়, তবে সে যেন তাকে এ বিষয়ে সাহায্য করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৫০)
উল্লিখিত হাদিসের আলোকে মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ.) চারটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন। তা হলো—
১. মালিক ও পুঁজিদার মজুর ও শ্রমিককে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করবে। দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য থাকে না এবং যেরূপ সম্পর্ক বর্তমান থাকে, তাদের ভেতরও তেমন সম্পর্ক থাকবে।
২. খাওয়া-পরা-থাকা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন পূরণের মান মালিক ও শ্রমিক উভয়ের সমান হবে। মালিক ও পুঁজিদার নিজে যা খাবে ও পরবে মজুর-শ্রমিককে তাই খেতে-পরতে দেবে; কিংবা অনুরূপ মানের পরিমাণ অর্থ মজুরিস্বরূপ দান করবে।
৩. সময় ও কাজ উভয় দিকে দিয়ে সাধ্যাতীত এমন কোনো কাজ মজুরের ওপর চাপানো যাবে না, যাতে সে সীমাহীন ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
৪. কোনো কাজ সাধ্যাতীত হলে মজুরকে অতিরিক্ত সময় বা লোকবল দিয়ে সাহায্য করতে হবে। (ইসলামী অর্থনীতি, পৃষ্ঠা ১১০-১১১)
মজুরি ন্যায়সংগত হওয়া আবশ্যক কেন : মুসলিম সমাজবিজ্ঞানী আল্লামা ইবনে খালদুন বলেন, ‘শ্রমের মূল্য হ্রাস করা শ্রমিকের প্রতি অবিচার। যে ব্যক্তি উপযুক্ত পারিশ্রমিকের চেয়ে কম মূল্যে শ্রমিক নিয়োগ দিল, সে শ্রমিকের অধিকার লুণ্ঠন করল। শ্রমিক তার পরিশ্রমের সমান পারিশ্রমিক পাবে। কেউ যদি তার চেয়ে কম পারিশ্রমিক দেয়, তবে সে জুলুম করল। আর জুলুম ব্যক্তির জন্য ধ্বংসাত্মক, সভ্যতাকে দুর্বলকারী এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্টকারী। ’ (মুকাদিমায়ে ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা ৫১২)
তিনি আরো বলেন, ‘কোনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ছাড়া মানবসভ্যতার সঠিক বিকাশ সম্ভব নয়। কেননা জুলুম মানবপ্রকৃতিতে মন্দ প্রভাব ফেলে। তা মনোবৃত্তিকে দুর্বল করে, প্রকৃতিকে অসুস্থ করে এবং তার সুকুমারবৃত্তি ধ্বংস করে। ফলে মানুষ হতাশ হয়ে যায়, জীবিকা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে ফেলে। তখন তাদের কর্মস্পৃহা বিলুপ্ত হয় এবং সমাজের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। এভাবে ক্রমেই মানবসভ্যতার বিপদ বাড়তে থাকে। ’ (মুকাদিমায়ে ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা ৩৩৩)
লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা