Tuesday, April 16, 2024
spot_img
Homeধর্মইসলামে মানবাধিকারের মূলনীতি

ইসলামে মানবাধিকারের মূলনীতি

১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। ৪ ডিসেম্বর ১৯৫০ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ঘোষণা করে এবং সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে তা উদযাপনের আহ্বান জানায়। মূলত ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ মানবাধিকারের ওপর সর্বজনীন ঘোষণার খসড়া অনুমোদন করে। ঘোষণাপত্রটি সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিত। ঘোষণাপত্রে মোট ৩০টি ধারায় মানুষের মৌলিক ও অমৌলিক অধিকারগুলো বিবৃত হয়েছে। এক শতাব্দীরও কম সময়ের আগে আধুনিক সমাজ ও সভ্যতা যে অধিকারগুলো ঘোষণা করেছে, ইসলাম সেগুলো প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মানুষের জন্য তা সুনিশ্চিত করেছে।

ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা : মানবাধিকারের ধারণা ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে জড়িত এবং তা অত্যন্ত বিস্তৃত ও ব্যাপক। ইসলাম মানুষের সামগ্রিক অধিকার ও নিরাপত্তার কথা বলে। শরিয়তের প্রধান পাঁচটি ‘মাকসাদ’ বা উদ্দেশ্য হলো পাঁচটি বিষয়ের মানবাধিকারের নিরাপত্তা প্রদান করা। তা হলো—ধর্ম বিশ্বাস, জীবন, সম্পদ, বংশধারা ও মেধা-বুদ্ধি। সুতরাং ইসলামী আইন মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন ও সম্পদ, সম্মান ও সম্ভ্রম, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। (তাওদিউল আহকাম মিন বুলুগিল মারাম : ১/৪৪)

ইসলামী মানবাধিকার আইনের বৈশিষ্ট্য : ড. ইবরাহিম মুহাম্মদ খালিদ বোরকান ইসলামী মানবাধিকার আইনের ছয়টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। তা হলো—

১. আল্লাহ প্রদত্ত : ইসলাম মানুষের যেসব অধিকার ঘোষণা করেছে, তা মৌলিকভাবে আল্লাহর ঘোষণা এবং আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার। আর স্রষ্টা হিসেবে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য কোন অধিকার প্রয়োজন, তা সর্বাধিক অবগত। তাই ইসলাম ঘোষিত মানবাধিকার মানবপ্রকৃতির অধিক অনুকূল।

২. ব্যাপক : ইসলাম ঘোষিত মানবাধিকার ব্যাপক ও বিস্তৃত। তা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও আঞ্চলিকতার মধ্যে পার্থক্য করে না। বরং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে।

৩. ইবাদতের সঙ্গে সম্পৃক্ত : ইসলাম মানুষের অধিকার রক্ষাকে ঈমান ও ইবাদতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। যেমন—রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার মুখ ও হাত থেকে মানুষ নিরাপদ হবে।’

৪. ভারসাম্য : ভারসাম্য ইসলাম, ইসলামী আইন ও মুসলিম জাতির বৈশিষ্ট্য। ইসলাম অন্য সব ক্ষেত্রের মতো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়ও ভারসাম্য রক্ষা করেছে। যেমন— ইসলাম ব্যক্তি অধিকার ও স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা যদি সমাজ ও রাষ্ট্রকে হুমকির মুখে ফেলে, সমাজে পাপাচার বিস্তার লাভ করে, তবে ইসলাম তাকে নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেয়।

৫. স্থায়ী : ইসলাম কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের জন্য জীবন বিধান। তাই ইসলাম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে বিধান দিয়েছে, তা কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরণীয়। মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামের মৌলিক বিধানে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই।

৬. শর্তযুক্ত : ইসলাম মানুষের সব অধিকার স্বীকার করে। তবে শর্ত হলো, তা আল্লাহর বিধানের বিপরীত হতে পারবে না। মানবাধিকারের নামে আল্লাহর বিধান অমান্য করার সুযোগ ইসলামে নেই। (প্রবন্ধ : হুকুকুল ইনসানি ফিল ইসলাম : খাসায়িসুহা ও মাজালাতুহা, পৃষ্ঠা ৪-৫)

ইসলামে মানবাধিকারের ঘোষণা : মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য সব অধিকারই ইসলাম মানুষকে দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—

১. জীবনের নিরাপত্তা : ইসলাম সব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে একজন মানুষের জীবনকে সমগ্র মানবজাতির জীবনের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর দায় ছাড়া কোনো মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। যে কোনো একজন মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সব মানুষের জীবন রক্ষা করল।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩২)

২. স্বাধীনতা : ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বাধীনতা দিয়েছে; যতক্ষণ না তার স্বাধীনতা অন্যের তথা সমাজের স্বাধীনতা ও কল্যাণকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। নিম্নোক্ত আয়াতে যার ইঙ্গিত আছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি, তাকে কর্তৃত্ব দিয়েছি স্থলে ও জলে, তাদের দিয়েছি উত্তম জীবিকা এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি আমার সৃষ্টিজগতের অনেকের ওপর।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭০)

৩. সাম্য ও সুবিচার : ইসলাম সব মানুষের প্রতি সুবিচারের নির্দেশ দিয়ে বলে, ‘হে মুমিনরা! আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার কোরো এটাই আল্লাহভীতির অধিক নিকটতর।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৮)

৪. মালিকানা লাভ : ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কে সম্পদের মালিকানা লাভের অধিকার দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘পুরুষ যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কোরো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩২)

৫. বিচরণ : ইসলাম জীবিকার তাগিদে, জীবন রক্ষার প্রয়োজনে মানুষকে স্থানান্তরিত হওয়ার অধিকার দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন; অতএব তোমরা তার দিগ-দিগন্তে বিচরণ কোরো এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে আহার গ্রহণ কোরো।’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ১৫)

৬. বাসস্থানের অধিকার : মানুষকে বাসস্থান নির্বাচন, নির্মাণ ও তাতে স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের ঘরকে করেন তোমাদের আবাসস্থল এবং তিনিই তোমাদের জন্য পশুর চামড়ার তাঁবুর ব্যবস্থা করেন, তোমরা তাকে সহজ মনে কোরো ভ্রমণকালে এবং অবস্থানকালে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৮০)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে ঘরের অধিবাসীদের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদের সালাম না দিয়ে প্রবেশ কোরো না। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সুরা নুর, আয়াত : ২৭)

৭. সামাজিক নিরাপত্তা : সমাজের অসহায় মানুষের জন্য ইসলাম সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের সম্পদে আছে অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ১৯)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় অসহায়, এতিম ও বন্দিদের আহার করায়।’ (সুরা : ইনসান, আয়াত : ৮)

আল্লাহ সবাইকে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments