Saturday, April 20, 2024
spot_img
Homeধর্মইসলামে নারীর আর্থিক নিরাপত্তা

ইসলামে নারীর আর্থিক নিরাপত্তা

ধর্ম হিসেবে শুধু ইসলামই নারীর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। ইসলামপূর্ব জাহেলি সমাজ যেখানে কন্যাশিশুর বেঁচে থাকার অধিকার অস্বীকার করেছিল, সেখানে ইসলাম কন্যাশিশুর জন্মগ্রহণকে সুসংবাদ আখ্যা দিয়েছিল এবং যে সমাজে নারী উত্তরাধিকার সম্পদের মতো ভোগ্য ও হস্তান্তরযোগ্য ছিল, সেখানে ইসলাম নারীর পূর্ব আর্থিক নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। নিম্নে ইসলাম প্রদত্ত নারীর আর্থিক নিরাপত্তার নানা দিক তুলে ধরা হলো।

সাধারণ আর্থিক অধিকার : সম্পদ লাভের সাধারণ মাধ্যম হলো সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়া এবং অর্থ উপার্জনের সুযোগ লাভ করা।

ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কেই সাধারণ এই আর্থিক অধিকার দান করেছে।

ক.   উত্তরাধিকার লাভ করার ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক বা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৭)

খ.   সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কোরো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩২)

বিশেষ আর্থিক অধিকার : ইসলাম নারীকে এমন কিছু আর্থিক অধিকার প্রদান করেছে, যা পুরুষকে দেয়নি। তা হলো মোহর ও ভরণ-পোষণ।

ক.   মোহর : ইসলামী শরিয়তের বিধান মতে, কোনো নারী বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হলে সে ন্যায়সংগত মোহর লাভ করে। কিন্তু পুরুষ তা লাভ করে না। পবিত্র কোরআন নারীর মোহর আদায়ের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা নারীদের তাদের মোহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে; সন্তুষ্টচিত্তে তারা মোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করবে। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৪)

খ.   ভরণ-পোষণ : একইভাবে জীবনের সব স্তরে নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পরিবারের দায়িত্বশীল পুরুষের ওপর অর্পিত। বিপরীতে পুরুষের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নারীর ওপর বর্তায় না। ফকিহ আলেমরা বলেন, স্বামীর জন্য স্ত্রীর দৈনন্দিন খরচ (ভরণ-পোষণ) প্রদান করা আবশ্যক। দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু প্রয়োজন হয়, তা স্ত্রীর প্রাপ্য। যেমন চুল পরিপাটি করার জন্য তেল ও চিরুনি এবং গোসলের পানি কেনার অর্থ। স্ত্রী শহরের প্রচলিত পোশাকরীতি অনুসারে উপযুক্ত পোশাক লাভ করবে, বিছানা ও বালিশ পাবে। সে উপযুক্ত বাসস্থান লাভ করবে। যদি স্ত্রীকে বাবার বাড়িতে রাখে এবং সেখানে কোনো সেবিকার প্রয়োজন হয় তবে স্বামী সেবিকার পারিশ্রমিকও পরিশোধ করবে। ’ (প্রবন্ধ : আল-হুকুকুল মালিয়্যাতি ফি শারিয়াতিল ইসলামিয়্যা, পৃষ্ঠা ৬)

অবশ্য ভরণ-পোষণের ক্ষেত্রে স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা ও স্বামীর আর্থিক সামর্থ্য উভয় দিকেই লক্ষ্য রাখতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন তার চেয়ে গুরুতর বোঝা তিনি তার ওপর চাপান না। আল্লাহ কষ্টের পর দেবেন স্বস্তি। ’ (সুরা তালাক, আয়াত : ৭)

আনুষঙ্গিক আর্থিক অধিকার : ইসলাম নারীর মৌলিক ও বিশেষ আর্থিক অধিকারগুলোর পরিপূরক হিসেবে কিছু আনুষঙ্গিক আর্থিক অধিকার দান করেছে। এ অধিকারগুলো নারীর স্বার্থ ও সুরক্ষার শর্তে আবর্তিত। যেমন—

১. ন্যায়সংগত ভরণ-পোষণ আদায় : কোনো স্বামী যদি স্ত্রীকে ন্যায়সংগত ভরণ-পোষণ না দেয় এবং কার্পণ্য করে, তবে স্ত্রী বিচারকের দ্বারস্থ হতে পারবে এবং স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার সম্পদ থেকে প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘মুয়াবিয়া (রা.)-এর মা হিন্দা আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বলেন, আবু সুফিয়ান (রা.) একজন কৃপণ ব্যক্তি। এ অবস্থায় আমি যদি তার সম্পদ থেকে গোপনে কিছু গ্রহণ করি, তাতে কি গুনাহ হবে? তিনি বললেন, তুমি তোমার ও সন্তানদের প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যায়ভাবে গ্রহণ করতে পার। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২১১)

২. স্তন্যদানের পারিশ্রমিক : ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী কোনো মা সন্তানকে স্তন্যদানে বাধ্য নয়। সুতরাং সে যদি স্তন্যদানের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দাবি করে তবে বাবা তা পরিশোধে বাধ্য হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে স্তন্য পানকাল পূর্ণ করতে চায়, তার জন্য মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর স্তন্য পান করাবে। জনকের দায়িত্ব যথাবিধি তাদের ভরণ-পোষণ করা। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৩)

৩. অঙ্গহানির ক্ষতিপূরণ : কোনো নারী স্বামী বা অন্য যেকোনো মানুষের দ্বারা অঙ্গহানির শিকার হলে, সে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ ক্ষেত্রে অঙ্গহানির প্রতিবিধান হিসেবে অত্যাচারী ব্যক্তির অঙ্গহানি (কিসাস) যেমন দাবি করতে পারে, তেমনি সে আর্থিক ক্ষতিপূরণ (দিয়্যত) দাবি করতে পারে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তাদের জন্য তাতে বিধান দিয়েছিলাম যে প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে অনুরূপ জখম। অতঃপর কেউ তা ক্ষমা করলে তাতে তারই পাপ মোচন হবে। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৪৫)

৪. তালাকের পর ভরণ-পোষণ : তালাকের কারণে একজন নারী হঠাৎ আশ্রয়হীন হয়ে পড়তে পারে এবং আর্থিকভাবে সে অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে। এ জন্য ইসলাম তালাকের পর অবস্থাভেদে শর্তসাপেক্ষে তালাকপ্রাপ্ত নারীদের জন্য মুতা (উপহার) ও ভরণ-পোষণ লাভের অধিকার দিয়েছে। যেন নারী ইদ্দতকালের ভেতরে পরবর্তী জীবনের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারে। (প্রবন্ধ : আল-হুকুকুল মালিয়্যাতি ফি শারিয়াতিল ইসলামিয়্যা, পৃষ্ঠা ৯-১১)

নারীর আর্থিক দায়মুক্তি : উল্লিখিত আর্থিক অধিকারগুলোর বিপরীতে ইসলাম নারীর ওপর ঘর ও পরিবারের কোনো ধরনের আর্থিক দায় চাপায়নি। নারী কোনো ব্যক্তি বিশেষের দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য নয়। যা নারীর আর্থিক নিরাপত্তাকে আরো সুসংহত করেছে। তবে নৈতিক দায়বোধ থেকে যদি কোনো অর্থ ব্যয় করে সেটা ভিন্ন কথা। অবশ্য নারী যদি সম্পদশালী হয় এবং জাকাত, ফিতরা ও কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া যায়, তবে এগুলো আদায় করা ওয়াজিব।

নারীর আর্থিক দায়িত্ব যাদের ওপর : এমনকি ইসলাম তাকে নিজের ভরণ-পোষণের দায় থেকেও মুক্তি দিয়েছে। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পরিবারের দায়িত্বশীল পুরুষের। এই শরিয়তের বিধান নিম্নরূপ—

১.   সুস্থ পুত্রের ক্ষেত্রে পিতার ওপর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সাবালক হওয়া পর্যন্ত আর কন্যার ক্ষেত্রে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত। সন্তানরা (ছেলে হোক বা মেয়ে) সম্পদশালী হয়, তবে পিতার ওপর তা ওয়াজিব থাকবে না। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩/৬১২; ফাতহুল কাদির ৪/২২০)

২.   কন্যা সাবালক হলেও তাকে উপার্জনে বাধ্য করার অবকাশ পিতার নেই। তবে কন্যা যদি সেলাই ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জন করে তাহলে তার ভরণ-পোষণ নিজের উপার্জন থেকেই হবে। তবে তা যথেষ্ট না হলে বাকিটুকু পিতার জিম্মায় ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুহতার : ৩/৬১২)

৩.   বিয়ের পর কনের ভরণ-পোষণ স্বামীর জিম্মায়। আর কোনো কারণে বিচ্ছেদ হলে ইদ্দত শেষ হওয়ার পর কন্যার ভরণ-পোষণ পুনরায় পিতার ওপর অর্পিত হয়, যদি না কন্যার নিজের সম্পদ থাকে। (ফাতহুল কাদির : ৪/২১৭)

৪.   পিতার অবর্তমানে কিংবা তার দারিদ্য ও অক্ষমতার ক্ষেত্রে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের ওপর সম্পদহীন নারীর ভরণ-পোষণ ওয়াজিব হয়। (আল-মুফাসসাল ফি আহকামিল মারআহ : ১০/৭০)

৫.   মাতা-পিতা দরিদ্র হলে এবং পিতার নিজের কোনো উপার্জন না থাকলে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সচ্ছল সন্তানের। (মুগনিল মুহতাজ : ৩/৫৬৯; আলমুগনি : ১১/৩৭৩)

৬.   পিতা থাকা অবস্থায়ও প্রয়োজনের সময় অভাবী মায়ের ভরণ-পোষণ সন্তানের ওপর ওয়াজিব হয়। (রদ্দুল মুহতার : ৩/৬১৬)

৭.   দাদা-দাদি, নানা-নানিও মা-বাবার মতোই। সুতরাং প্রয়োজনের মুহূর্তে তাদের ভরণ-পোষণের ভার পৌত্র-পৌত্রি ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীদের ওপর অর্পিত হয়। (মাবসুত সারাখসি : ৫/২২২; আলমুগনি ১১/৩৪৭)

আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments