Saturday, April 20, 2024
spot_img
Homeজাতীয়‘ইভিএমের অডিট কার্ডে ফলাফল পরিবর্তন সম্ভব’

‘ইভিএমের অডিট কার্ডে ফলাফল পরিবর্তন সম্ভব’

ইভিএমের অডিট কার্ডে ফলাফল পরিবর্তন সম্ভব বলে মনে করেন ভোডাফোন নেদারল্যান্ডসের সিনিয়র সল্যুশন অর্কিটেক্ট ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেছেন, ইভিএমে ইন্টিগ্রেটেড ও স্বয়ংক্রিয় রেজাল্ট তৈরির সুযোগ নেই, বরং হাতে ফলাফল তৈরি হয়। এসডি কার্ড বা অডিট কার্ডের মাধ্যমে কেন্দ্রের বুথ থেকে ফলাফল হস্তান্তরের পরের সব প্রক্রিয়া ম্যানুয়াল। কেন্দ্রের ফলাফল ও পুরো আসনের সবকেন্দ্রের ফলাফল তৈরি হয় ম্যানুয়ালভাবে। মেশিন নষ্ট, হ্যাং কিংবা ব্যাকআপ রাখার কারণের নির্বাচন কমিশন থেকে এক্সট্রা কার্ড দেয়া হয়। 
অডিট কার্ডের চিপ টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে, আগে থেকেই ধারণ করা প্রি-লোডেড ফলাফলের মাধ্যমে কিংবা অন্য একটি অডিট কার্ডের মাধ্যমে জালিয়াতি সম্ভব। 
শনিবার সন্ধ্যায় ‘ইভিএমে সমস্যা কোথায়?’ শিরোনামের এক ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম এবং অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞ।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ইভিএমের আরো কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। সেগুলো হচ্ছে:
১. স্বচ্ছ ব্যালটবক্স দেখানোর বাধ্যবাধকতার মতো অডিট কার্ডে আগে থেকেই কোনো ফলাফল রেকর্ড করা আছে কি না, তা চেক করার ব্যবস্থা নেই।
২. ইভিএমে ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) নেই। পেপার ব্যাক অডিট ট্রেইল হচ্ছে ভোটের স্লিপ। সেটা ভোট দেওয়ার রিসিপট। এর মাধ্যমে ভোটার নিশ্চিত হন, তিনি কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন।

এই রিসিপট ভোটের পরে ভোটার নিজে স্বচ্ছ ব্যালটবক্সে ফেলবেন, নিয়ে যাবেন না। জালিয়াতির অভিযোগ থাকলে, এই স্লিপ গুণে পুনরায় ভোট গণনা করা হয়। যেটা বাংলাদেশের নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়া মেশিনেও থাকবে না। ভিভিপিএটি না থাকায়, কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে, সেটাই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এটি পুনরায় গণনা বা অডিট করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে সই করেননি।
৩. ডিজিটাল অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা নিরাপদ নয়, এটা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট করে। যেকোনো ডিজিটাল মেশিন পদ্ধতিগতভাবে এবং বৈশিষ্ট্যগত কারণে তার সব কার্যক্রমের অভ্যন্তরীণ লগ তৈরি করে। এই লগ দিয়ে ওই ডিজিটাল মেশিনের নিজস্ব কারিগরি সমস্যার ট্রাবলশুট করা হয়। এর ফলে ইভিএমের মতো মেশিনে, যেখানে বায়োমেট্রিক ডেটার ব্যবহার আছে সেখানে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার ঝুঁকি আছে। বায়োমেট্রিক ডেটার সঙ্গে প্রদত্ত ভোটের ম্যাপিং ডিজিটাল ফরেনসিক করে বের করা সম্ভব। এটা নির্বাচন পরবর্তীতে ভোটারের ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। ২০২২ সালের ২৪ জুলাই পটুয়াখালীর এক সরকার দলীয় নেতা বলেছেন, ‘ভোট হবে ইভিএমে, কে কোথায় ভোট দেবে তা কিন্তু আমাদের কাছে চলে আসবে।’ এমন বক্তব্য চট্টগ্রাম থেকেও শোনা গেছে।
৪. ইভিএম হ্যাং করে। ভোট পরিবর্তন করতে, অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক ব্যালটে চাপ, দ্রুত একাধিক বাটনে চাপ দিলেই মেশিন হ্যাং করে। একবার মেশিন হ্যাং করলেই ৫ থেকে ১০ মিনিট নষ্ট হয়, মেশিন পুনরায় সিনক্রোনাইজেশান বা রিস্টার্ট দিতে হয়। এতে ভোটগ্রহণের হার কমে যায়।
৫. মেশিন বায়োমেট্রিক সঠিকভাবে নেয় না। শ্রমঘন কাজে জড়িত, কায়িক পরিশ্রম ও গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত নাগরিক ও বয়স্কদের আঙুলের ছাপ ইভিএম মেশিনে না মেলার বহু অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক ভোটযন্ত্রে প্রায়ই কৃষক-শ্রমিক-বয়স্কদের বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ সম্ভব হয় না। এর ফলে, বুথে দীর্ঘ লাইন তৈরি হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে ভোটদানের হার কমে যায়।
৬. কর্মকর্তাদের ইভিএম ওভাররাইটের ক্ষমতা রয়েছে। নির্বাচনে ফিঙ্গার প্রিন্ট না মিললে, ডেটাবেজে সমস্যা হলে, ইভিএম হ্যাং করলে এই  অনধিকার চর্চার সুযোগ দেওয়া আছে। ওভাররাইটের সর্বোচ্চ শতাংশ কত হবে এবং তা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট চেক অ্যান্ড ব্যাল্যান্স নেই। এটা সম্ভবও নয়। কেননা ওই কেন্দ্রের ঠিক কত শতাংশ ভোটারের আঙুলের ছাপ মিলবে না, তা কেউ জানে না। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী কর্মকর্তাদেরকে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ইভিএমকে ওভাররাইট করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।
৭. নিখুঁত এনআইডি ও বায়োমেট্রিক তথ্যশালা এখনও তৈরি হয়নি। নির্বাচন কমিশনে এনআইডি বিষয়ক লাখো অভিযোগ আছে। এনআইডিতে ভুলের বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গত ১৯ জুলাই তিনি বলেছেন, ‘ভুলের পরিমাণ এত বেশি যে, আমার মনে হয় কোটি কোটি ভুল। এর সঙ্গে আছে জন্ম নিবন্ধন তথ্যশালা হারিয়ে যাওয়ার সমস্যা। ধারণা করা হচ্ছে, সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৫ কোটি জন্ম নিবন্ধন একেবারেই গায়েব হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের মধ্যে কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি তৈরিসহ, বিদ্যমান এনআইডির কোটি ভুল শুধরানো অসম্ভব। যেখানে নিখুঁত এনআইডি ও বায়োমেট্রিক তথ্যশালা তৈরি হয়নি, সেখানে অর্ধেক (১৫০) আসনে ইভিএমে ভোটের যৌক্তিকতা কোথায়?
৮. একটি কেন্দ্রের সব বুথের মাস্টার ডেটাবেজ নেই। একটি কেন্দ্রের সব ভোটারের তথ্য ওই কেন্দ্রের সব ইভিএমে থাকে না। ফলে একটি ইভিএম হ্যাং করলে, নষ্ট হলে বা একটি ইভিএমে ভোটারের বায়োমেট্রিক শনাক্ত করা না গেলে, তাকে অন্য ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না। ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বিষয়ে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘৪ হাজার কোটি টাকা খরচের পর নির্বাচন কমিশন ইভিএমে নির্বাচনের জন্য তাদের কারিগরি সক্ষমতাকে ৬ থেকে ৭৫টিতে উন্নীত করতে ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯ বছর সময় নিয়েছে। একাদশ নির্বাচনের আগে ইভিএম ক্রয়ে ব্যয় হয় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা (৪৫০ মিলিয়ন ডলার)। প্রশ্ন হচ্ছে, ৯ বছরে যেখানে ইসি ৭৫টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের কারিগরি সক্ষমতা তৈরি করেছে, সেখানে মাত্র ১ বছরেই এই সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে পারবে কি? এই সময়ে ইভিএম পরিচালনার কারিগরি জনবল তৈরি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক সংকটকালে ‘ডলার ড্রেইন’ করে ইভিএমের অতি উচ্চ খরচের যৌক্তিক বিষয়ে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে আরও দেড় থেকে ২ লাখ ইভিএম কিনতে হবে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয়ে ৪ হাজার কোটি খরচ হয়। এই খরচের খাতগুলো হচ্ছে: ইভিএম ক্রয়, প্রচার, পরিবহন, মোটরযান, কম্পিউটার সফটওয়্যার, আসবাবপত্র, সংরক্ষণ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ। সবকেন্দ্রে কারিগরি বিশেষজ্ঞ বা টেকনিশিয়ান তৈরিও সময় ও খরচ সাপেক্ষ।’ নতুন ইভিএম ক্রয়ে খরচ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন ইভিএম কিনতে প্রায় পৌনে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা ও প্রচারে আরও ২০৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
ইভিএমে মানুষের আস্থা প্রশ্নে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘গত ৩০ মে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেছেন, “গোপন কক্ষে একজন করে ডাকাত দাঁড়িয়ে থাকে, এটাই ইভিএমের চ্যালেঞ্জ।” এমন অবস্থায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারিগরি উৎকর্ষতাও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তা দেয় না। ভোটার শনাক্তকরণের পরে যেখানে ডাকাতরা বাটনটি টিপে দেন, সেখানে ইভিএমও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। বিষয়টি শুধুই কারিগরি অক্ষমতার নয়, বরং বিষয়টি রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার।’
এদিকে ইভিএম ভোটগ্রহণের আরও কয়েকটি সমস্যা তুলে ধরেছেন তিনি। সেগুলো হলো:
১. ভোটগ্রহণে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেন নির্বাচন কমিশনের নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তারা। এসব প্রশিক্ষণে শুধু মেশিন অন-অফ করা, ভোট দেওয়ার জন্য বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ ও ভোটের ডিজিটাল বাটন বিষয়ে শেখানো হয়। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কোনো কারিগরি সমস্যার সমাধান করতে পারেন না। ২. টেকনিশিয়ানের অভাব রয়েছে। একটি কেন্দ্রের ৬, ৮ বা ১০টি বুথের জন্য নয়, বরং কাছাকাছি অবস্থিত ২ বা ৩টি কেন্দ্রের প্রায় ২০টির বেশি বুথের জন্য মাত্র ১ জন টেকনিশিয়ান দেওয়া হয়। একই সঙ্গে একাধিক মেশিন হ্যাং করলে টেকনিশিয়ানের কিছুই করার থাকে না। ৩. ইভিএমে ভোট দেওয়ার সময় অপরাপর ডিজিটাল জরিপ বা পোলিংয়ের মতো প্রদত্ত ভোটের ফলাফলের তাৎক্ষণিক হিসাব ভোটারকে দেখানো হয় না। তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা দেখতে পারেন। অভিযোগ আছে, টেকনিশিয়ানের নাম করে ‘বিশেষ’ লোকজন কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। এতে তাদের কাছে ডুপ্লিকেট ‘অডিট কার্ড’ থাকতে পারে কি না, সেই আশঙ্কা রয়েছে। ৪. একটা ইভিএম ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন চার্জ দেওয়া হলে, সেটি সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৬ঘণ্টা চলতে পারে। বর্তমান লোডশেডিং পরিস্থিতিতে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ বিঘ্নিত হতে পারে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments