Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামইউক্রেন ঘিরে রাশিয়া-আমেরিকা পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি

ইউক্রেন ঘিরে রাশিয়া-আমেরিকা পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম সম্মেলন ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু এবং শতকোটি মানুষের অভাবনীয় দুর্ভোগের ফলশ্রতিতে ভবিষ্যতে এ ধরণের যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতেই বিগত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক সংকট নিরসনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল। গণবিদ্ধংসী পারমানবিক বোমার উপর ভর করে যুদ্ধজয়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের ঘোষিত নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারও সমানতালে তাদের কর্তৃত্ববাদী অবস্থান নিশ্চিত করে বিশ্বকে পরিচালিত করতে শুরু করে। হিটলার-মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদ এশিয়া-আফ্রিকার কোনো দেশ থেকে রফতানি হয়নি। জাতীয়তাবাদের মোড়কে মানুষের উপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে বিরোধীমত দমন ও নিশ্চিহ্ন করার ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ইউরোপে জার্মানির প্রতিবেশী দেশগুলো। রাশিয়ার বিশাল কৌশলগত সামরিক সামর্থ্যকে পুঁজি করে ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পশ্চিমাদের জয় হলেও তাদের প্রথম টার্গেট ছিল তুরস্কের নেতৃত্বাধীন উসমানীয় খেলাফত এবং দ্বিতীয় টার্গেট ছিল সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রথম মহাযুদ্ধের খুব স্পর্শকাতর সময়ে ১৯১৭ সালের অক্টোবরে রাশিয়ায় ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। পশ্চিমা পুঁজিবাদের সম্পুর্ণ বিপরীতমুখী এজেন্ডা ও প্রবণতা নিয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা নিউ ওয়ার্ল্ড অডার্রের জন্য হুমকি এবং দুই শক্তিকে পারস্পরিক দ্বা›িদ্বক অবস্থানে ঠেলে দিলেও হিটলারের ফ্যাসিবাদ এই দুই বিশ্বশক্তির জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠায় বিশেষ প্রয়োজনে দুই শক্তির ঐক্য ত্রিভুজের অপর বাহুটিকে ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়েছিল। বিংশ শতকের প্রথমার্ধের ৩৫ বছরের মধ্যে বিশ্ব দুইটি মহাযুদ্ধের সম্মুখীন হলেও জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার পর গত ৭৭ বছরে আর কোনো মহাযুদ্ধ সংঘটিত না হলেও এ সময়ে একটি বছরও যুদ্ধ ও সামরিক আগ্রাসনের বাইরে ছিল না। ফিলিস্তিনী আরবদের ভূমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন, কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান ও ইরাক দখল, সিরিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে হালের ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আঞ্চলিক যুদ্ধসংঘাতের মূল কুশীলব হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদেরকেই সদা সক্রিয় দেখা গেছে। সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তির উপর ভর করে বিশ্বযুদ্ধ জয়ের অভিজ্ঞতা থেকে পশ্চিমাদের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের মূল টার্গেট হচ্ছে, তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের স্থান ও অবস্থানকে নিরাপদ ও নিরঙ্কুশ রাখা। প্রতিটি আঞ্চলিক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের অভিন্ন অবস্থানের পেছনে তাঁদের মূল অভিপ্রায় হচ্ছে, পুঁজিবাদি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রনব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখা। কোরীয় যুদ্ধ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যন্ত অবস্থা খুব একটা বদলায়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণে ১৯৫০ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া কোরীয় যুদ্ধ ১৯৫৩ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় অবসান ঘটলেও এই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়নি। চীন-রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে উত্তর ও দক্ষিণ কোরীয় এখনো যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়ে পরস্পরের দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। ইউক্রেন যেন সেই যুদ্ধেরই নতুন প্ল্যাটফর্ম। ইউক্রেন ঘিরে আবারো একটি পারমানবিক যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই দানা বেঁধে উঠেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট মার্কিন যুদ্ধবিমান থেকে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র পারমানবিক বোমার ধ্বংসলীলা সংঘটিত করা হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধে বিমান থেকে বোমা হামলা, কামান-বন্দুক, ট্যাঙ্ক-মর্টার বা মিসাইলের মত প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্রে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর নিদারুণ অভিজ্ঞতা বিশ্বের মানুষের হয়েছিল। কিন্তু পারমানবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যুর অভাবনীয় ক্ষমতা দেখে সৈনিকদেরও পিলে চমকে গিয়েছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ শহর মাটিতে মিশে যাওয়া এবং লাখ লাখ মানুষের সেই ভয়াল দৃশ্য থেকে আজকের আরো অনেক শক্তিশালী হাজার হাজার পারমানবিক বোমার যুদ্ধে ডুমস ডে বা মহাপ্রলয়ের আশঙ্কার কথা মনে করে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষকে আঁৎকে উঠতে হয়। জার্মানি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া ইহুদী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন পারমানবিক শক্তির ফর্মূলা ফাঁস করার পর পেন্টাগনের যুদ্ধবাজ নেতারা তা লুফে নিয়ে বোমা বানানোর কার্যক্রম শুরু করে। বোমার এই প্রযুক্তি ও পারমানবিক অস্ত্রশিল্প সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে সমৃদ্ধি লাভ করতে বেশি সময় লাগেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন পশ্চিমা মিত্র বৃটেন ও ফ্রান্সকে পারমানবিক বলে বলিয়ান হতে সহায়তা করেছে, একইভাবে আরেক সমাজতান্ত্রিক শক্তি গণচীনও পারমানবিক বোমা অর্জনে মরিয়া হয়ে তাতে সাফল্য লাভ করে। উপমহাদেশে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্ব›িদ্বতার জেরে ষাটের দশকের শেষদিকে ভারত পারমানবিক বোমার পরীক্ষায় সফল হওয়ার পর এক দশকের মধ্যে ভারতের চির প্রতিদ্ব›দ্বী পাকিস্তানও পারমানবিক শক্তির অধিকারী হয়। এই মুহূর্তে পশ্চিম সীমান্তে পারমানবিক শক্তিধর দু’টি বৈরী রাষ্ট্রশক্তি ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ। তবে এ কথা ঠিক যে, কোনো পারমানবিক যুদ্ধে কোনো পক্ষের জয়লাভের সুযোগ খুবই ক্ষীণ। কারণ, পারমানবিক শক্তিধর কোনো দেশের সবগুলো বোমা একসাথে ধ্বংস করে ফেলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে সাবমেরিন ও আইসিবিএম ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পাল্টা হামলার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। পারমানবিক শক্তিতে পূর্ব-পশ্চিমে একটি ভারসাম্য তৈরী হওয়ার কারণে সোভিয়েত-আমেরিকার ¯œায়ুযুদ্ধ কখনো পারমানবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারেনি। হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা ব্যবহারের একমাত্র কুশীলব যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এরপর আর কোনো যুদ্ধে এই বোমার ব্যবহার না হলেও ১৯৯০ সালে প্রথম গাল্ফ ওয়ার এবং ২০০৩ সালের আগ্রাসনের পর ইরাকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম বোমা ব্যবহার করেছে। এর ফলে ইরাকে হাজার হাজার নারী গর্ভে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান এবং নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সামরিক বিশ্লেষকরা ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়া এবং মার্কির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির মুখোমুখী অবস্থানকে ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের চেয়েও বড় পারমানবিক হুমকি হিসেবে গণ্য করছেন। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছকাছি ইতালি ও তুরস্কে জুপিটার ব্যালেস্টিক মিসাইল স্থাপন করার পাশাপাশি ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরুদ্ধবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী কিউবানদের ব্যবহার করে মার্কিন নৌবাহিনী ১৯৬১ সালে কিউবার উপকুলীয় বে অব পিগস দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর ফিদেল ক্যাস্ত্রোর অনুরোধে সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ কিউবায় মধ্য পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল আর-১২ এবং আর-১৪ মোতায়েন করতে শুরু করলে দুই পরাশক্তি পারমানবিক যুদ্ধের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ উপকূলীয় রাজ্য ফ্লোরিডা থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে কিউবায় সোভিয়েত পারমানবিক মিসাইলের উপস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি প্রশাসনের ঘুম হারাম করে দেয়। ইতালি ও তুরস্ক থেকে জুপিটার ক্ষেপনাস্ত্র প্রত্যাহার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় সামরিক আগ্রাসন না চালানোর মুচলেকা দেয়ার পর কিউবা থেকে সোভিয়েত মিসাইল ফিরিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের শান্তিপূর্ণ উপায়ে কূটনৈতিক সমাধান হয়। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে ওয়ারশ’ সামরিক জোটের বিলুপ্তি এবং ¯œায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটলেও ন্যাটোর শক্তিবৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ বাকি দুনিয়ার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি সৃষ্টি করে চলেছে। গত দিন দশকে নানা মিথ্যা অভিযোগ ও পরিকল্পিত প্রপাগান্ডার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত ৫টি দেশ ন্যাটো বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত, আগ্রাসন ও দখলবাজির শিকার হয়েছে। রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনের বক্তৃতায় বলেছেন, গণতন্ত্রসহ নানা প্রতিশ্রæতি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পর কোনো দেশেই সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে ন্যুনতম ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসহ বিশ্বের সামনে বিদ্যমান হুমকি ও সমস্যাগুলো উঠে আসলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষণে ইউক্রেন নিয়ে প্রপাগান্ডা ও মিসইনফরমেশনের গতানুগতিক রেটরিক প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে কেউ হুমকি না দিলেও সোভিয়েত নেতা পুতিন পারমানবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন রাশিয়ার সৃষ্টি হলেও ইউক্রেনকে কখনোই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি। তাঁর এই কথা সত্য হলেও এর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের অপতৎপরতাই মূলত দায়ী। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ইউক্রেনে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পশ্চিমা-জায়নবাদী শিখÐী ও বশংবদ শাসক বসিয়ে ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত করার যে তৎপরতা চলছে, তা অনেকটাই কিউবায় সোভিয়েত পারমানবিক মিসাইল মোতায়েনের মতই বড় ক্রাইসিস। সেই হুমকিই রাশিয়াকে ১৯১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণে বাধ্য করে। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে একটি স্বাধীন দেশের উপর আরেক দেশের আগ্রাসন সমর্থনযোগ্য নয়। তবে ইউক্রেন বা কিউবাকে রুশ-মার্কিন নিরাপত্তার দ্ব›দ্বকে এতটা সরলাঙ্কিকভাবে দেখার সুযোগ খুব ক্ষীণ। কিউবান বিদ্রোহীদের মদত দিয়ে ১৯৬১ সালে মার্কিনীদের কিউবা দখলের চেষ্টা, ইতালি ও তুরস্কে মার্কিন জুপিটার ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন এবং ইউক্রেনে মার্কিন ও ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি ও রাশিয়াবিরোধী তৎপরতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

কোরীয় যুদ্ধ, কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারসহ সংঘাতপূর্ণ বিশ্বের অনেক কিছুই কূটনৈতিকভাবে সমাধান হলেও ইউক্রেন বা রোহিঙ্গা সমস্যার কূটনৈতিক সমাধান না হওয়ার পেছনে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী চক্রের ভূরাজনৈতিক চালবাজি কাজ করছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং বাংলাদেশে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে পুশইন করার পর সমস্যা জিইয়ে রেখে ফায়দা হাসিল করতে চীন ও ভারত যার যার অবস্থান থেকে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম সম্মেলনে বিশ্বনেতারা প্রায় ৯০ ভাগ সময় ব্যয় করেছেন ইউক্রেন যুদ্ধের বেøইম গেমে। সেখানে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের অন্যসব সমস্যা যেন অপাঙতেয় হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা গণহত্যার শিকার হয়েছে। বার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সিরিয়া বা ইউক্রেন যুদ্ধে কয়েক লাখ শরনার্থীকে আশ্রয় দিতে যেখানে পুরো ইউরোপের সরকারগুলোর মাথানষ্ট হয়ে যায়, সেখানে বাংলাদেশকে ৫ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণ করার পাশাপাশি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বেপরোয়া কার্যকলাপ ও হুমকি পোহাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা রাশিয়া বা ইউক্রেনের চেয়ে বেশি। বলতে গেলে দুই দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যার কাছাকাছি। এই মুহূর্তে মিয়ানমারের সৈন্যরা বাংলাদেশ সীমান্ত লঙ্ঘনসহ উস্কানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। এ সময়ে পরাশক্তি ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতারা জাতিসংঘে শুধুমাত্র ইউক্রেন নিয়ে আলোচনায় সময় পার করেছেন। বাংলাদেশের মত দেশগুলো জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খাদ্য নিরাপত্তার হুমকির মধ্যে রয়েছে। ফিলিস্তিনের উপর জায়নবাদী ইসরাইলের আগ্রাসন, দেড় দশকের ধরে সর্বাত্মক অবরোধ সৃষ্টি করে ফিলিস্তিনের গাজা সিটিকে বিশ্বের বৃহত্তম কারাগারে পরিনত করা জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুসারে যুদ্ধাপরাধ এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা বিশ্ব নেতাদের কোনো বক্তব্য নেই। রোহিঙ্গা গণহত্যা জাতিসংঘের স্বীকৃত ও প্রমানিত মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কোনো নেতার কণ্ঠে কোনো বক্তব্য না আসা দুঃখজনক। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ টাইপের একটি ডিপ্লোম্যাটিক বক্তব্যে করোনাকালে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের সহায়তার ফিরিস্তি তুলে ধরতে গিয়ে মালদ্বীপ, আফগানিস্তানের পাশাপাশি মিয়ানমারের প্রসঙ্গ আসলেও বাংলাদেশ বা রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ আসেনি। ভারত ও বাংলাদেশ সরকার গত এক দশক ধরে দুই দেশের সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতার কথা বললেও রোহিঙ্গা সংকট বা সীমান্তে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উস্কানির বিপরীতে ভারতের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনা ও বা ডিপ্লোম্যাটিক সমাধান নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। অন্যদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে কূটনৈতিক সমাধানের কথা বলা হলেও পশ্চিমা বিশ্ব যেন একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের মধ্যেই জয়পরাজয় নিশ্চিত করতে চাইছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শত শত কোটি ডলারের যুদ্ধ বাজেট এবং বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি ইসরাইল জেলেনস্কির বাহিনীর হাতে গণবিদ্ধংসী অস্ত্র দিয়ে রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে চাইছে। জেলেনস্কির ইউক্রেনে পারমানবিক অস্ত্র মোতায়েনের কথাও শোনা যাচ্ছে।

এতদিন সীমিত পরিসরে যুদ্ধের ছক নিয়ে এগিয়েছিল রাশিয়া। সম্প্রতি খারকিভে রুশ বাহিনী একটি কৌশলগত পরাজয়ের সম্মুখীন হওয়ার মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় ধাপে বৃহত্তর আক্রমণ কৌশলের আভাস দিয়েছে রাশিয়া। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ ও ইসরাইলী জায়নবাদী শক্তির ক্রীড়নক, কমেডিয়ান জেলনস্কির কাঁধে বন্দুক রেখে মার্কিন ট্রেজারি থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিতে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্সি যুদ্ধের বøুপ্রিন্ট এঁেকছে মার্কিন মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কর্পোরেট ওয়ার কন্ট্রাক্টররা। কূটনৈতিক সমাধানের পথে শান্তি ও নিরাপত্তার সমাধানে অস্ত্র ব্যবসায় মুনাফাবাজির সুযোগ নেই। ইউক্রেনে পশ্চিমা সম্মিলিত শক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়েই মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধবাদী পুঁজিবাদের চূড়ান্ত পতন নিশ্চিত হতে পারে। সাংহাই কো-অপারেশন চুক্তির মধ্য দিয়ে চীন এবং রাশিয়া সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। চীন এখনো সরাসরি এই যুদ্ধে অংশ না নিলেও প্রয়োজনে রাশিয়ার পাশে দাঁড়াবে, এটা নিশ্চিত। তবে ইউক্রেনে বশংবদ প্রশাসনের পতন এবং মার্কিন ও ইউরোপের জনগণের ক্ষোভ বেড়ে গেলে ইউক্রেনে ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ার প্রক্সি যুদ্ধের মত পিছু হটার আগেই কেবল পশ্চিমারা কূটনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে পারে। এর বিপরীতে মানবতার শত্রæ জায়নবাদীরা বিশ্বকে একটি পারমানবিক যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায়না। ইউক্রেন এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হওয়ায় এখানকার জনসমষ্টির বড় একটি অংশই রুশ ভাষাভাষী ও রাশিয়ান বংশোদ্ভুত। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পশ্চিমারা যতই ইউক্রেনের জন্য মায়াকান্না দেখাক না কেন, ডনবাস এলাকায় রুশ বংশোদ্ভুত নাগরিকরা রাশিয়াকে একটি বাড়তি সুবিধাজনক অবস্থান নিশ্চিত করেছে। গত সপ্তাহে ডনবাস এলাকার চারটি অঞ্চল, লুহানস্ক, দোনেস্ক, খেরসন ও জাপরিঝিয়ায় অনুষ্ঠিত রেফারেন্ডামে শতকরা প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটারের ৯০ শতাংশই রাশিয়ার সাথে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে। এই রায়ের পর রাশিয়ার পার্লামেন্ট এই চারিিট অঞ্চলকে রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশ বলে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে একমত হয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, কিয়েভের জেলনস্কি প্রশাসন ডনবাস এলাকার রুশ বাহিনী অধিকৃত এলাকাগুলো পুর্নদখলের যে সঙ্কল্প ব্যক্ত করেছে তা যদি করা হয়, রাশিয়া তার নিজ ভূমি রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি ব্যবহারের নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করেছে। এটি পশ্চিমাদের জন্য বড় ধরণের কৌশলগত পরাজয় এবং চরম গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজে আক্রান্ত হলে রাশিয়া পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে। পারমানবিক যুদ্ধ নিঃসন্দেহে কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। পারমানবিক যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে ইউক্রেনের স্বাধীনতার প্রশ্নে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমাধানই শান্তির একমাত্র পথ। জায়নবাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি বিশ্বের শত শত কোটি মানুষকে হত্যা করে নতুন বিশ্বব্যবস্থা কায়েমের গোপন এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে বলে যে কনস্পিরেসি থিওরি চালু আছে, পূর্ব-পশ্চিম ও বাকি দুনিয়ার এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments