Thursday, April 18, 2024
spot_img
Homeখেলাধুলাআমার রেকর্ড ভাঙবে, দেশে এমন কারও জন্ম হয়নি 

আমার রেকর্ড ভাঙবে, দেশে এমন কারও জন্ম হয়নি 

একান্ত সাক্ষাৎকার

‘২০১০ সালে ঢাকা এস এ গেমসে একটি স্বর্ণপদকের আশায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন দিন বসে ছিলেন, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপ ঘুচিয়ে দিয়েছিলাম। আজ আমাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। আমার বয়স শেষ, আমার সবটুকু আমি দেশকে উজার করে দিয়েছি। কিন্তু দেশ আমাকে অযোগ্যদের কাতারে ফেলে দিলো।’ আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন দেশসেরা ভারোত্তোলক হামিদুল ইসলাম।

শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দেওয়া করা হয় গত ৫ আগস্ট। এই পুরস্কার মনোনয়নে তার নামও ছিল। কিন্তু দেশ-বিদেশের হয়ে অসংখ্য পদকজয়ী এই তারকা পুরস্কার পাননি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দেওয়া হামিদুলের দেশীয় স্বর্ণপদক পাওয়া শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০২১ সাল পর্যন্ত ২১টি স্বর্ণপদক জেতেন তিনি। 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ আলো ছড়িয়েছেন হামিদুল। ২০০৪ সালে পাকিস্তানে নবম এস এ গেমসে দ্বিতীয় হয়ে রৌপ্য জয়। ২০০৬ সালে শ্রীলংকায় দশম এস এ গেমসে তৃতীয় হয়ে ব্রোঞ্জ জয়। তবে ২০১০ সালে এসে চূড়ান্ত সফলতা পান। ওই সময় দেশের মাটিতে ১১তম এস এ গেমসে স্বর্ণ পদক হাতে তোলেন। এছাড়া ২০০৬ অস্ট্রেলিয়া কমনওয়েলথ গেমসে চতুর্থ, ২০১০ সালে চীনে এশিয়ান গেমসে পঞ্চমস্থান লাভ করেন।

দেশসেরা এই ক্রীড়াবিদ সমসাময়িক অনেক বিষয় নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন।

শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার না পাওয়াটা আপনার জন্য কতটা হতাশজনক?

হামিদুল: আসলে এটা হতাশ না, আমি মনে করি এটা আমার জন্য বেদনাদায়ক। নিজের কাছে লজ্জাকর একটা বিষয়।

কী কারণে আপনাকে বিবেচনা করা হয়নি বলে মনে করেন?

হামিদুল: বিবেচনা কেন করা হয়নি সেটাতো আমি বলতে পারব না। তবে আমি মনে করি ওখানে যারা বিচারক ছিলেন, তাদের সেই যোগ্যতা নেই বিধায় তারা আমাকে পুরস্কারটা দেননি। তারা অযোগ্য ছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে।

দেশের জন্য এত সাফল্য বয়ে আনার পরও পুরস্কারে আপনার নাম ওঠেনি, এর জন্য আপনি কি কাউকে দায়ী করেন?

হামিদুল: অবশ্যই, কারণ যারা অদক্ষ বা পাওয়ার যোগ্য না তারা জানে তাকে আসলে দেওয়া যাবে না। আসলে আমি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দায়ী করি না। দায় দেব পুরো ক্রীড়াঙ্গনের সমাজকে। এই সমাজকে ভেঙেচুরে না সাজানো পর্যন্ত যোগ্য লোক পুরস্কার পাবে না। কেননা অযোগ্য লোকেরা এখানে ভরে গেছে, ফলে যোগ্যরা সম্মান পাচ্ছে না।

পুরস্কারের দেওয়ার সময় স্বজনপ্রীতি হয়েছে বলে কি আপনি মনে করেন?

হামিদুল: হ্যাঁ, এটা তো অবশ্যই ওখানে যারা বসছে তাদের স্বজনপ্রীতি করার কারণেই এটা হয়েছে। এটা বাস্তবতা।

খেলায় এখন পর্যন্ত আপনি কতগুলো পদক পেয়েছেন?

হামিদুল: আমি আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বর্ণ, একটা রুপা ও একটা ব্রোঞ্জ পেয়েছি। কমনওয়েলথ গেমস ও এশিয়ান গেমসে তুলনামূলকভাবে বিগত দিনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছি। বাংলাদেশের ভারোত্তোলনে স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিকভাবে স্বর্ণ পদকটা আমার হাত ধরেই এসেছে। দেশকে এসব উপহার দিয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। বাংলাদেশে প্রথম স্বর্ণ পদকধারী আমি। আমি সবচেয়ে আনন্দিত যে, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে সবাইকে উৎসাহ দিয়েছিলেন, চার দিন পরেই আমি স্বর্ণ পদক জিতি। সেবার বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণ পদকটি ছিল আমার। এটা আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত। আমি মনে করি শেখ হাসিনা সরকার ক্রীড়াবান্ধব সরকার। তবে এখানে অনেকেই স্বজনপ্রীতি করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। আমি মনে করি যোগ্য লোকদের সঠিক জায়গায় বসালেই আমার মতো ব্যক্তির কোথায় সম্মান নষ্ট হবে না। যার যতটুকু যোগ্যতা আছে সে ততটুকু পাবে। এখানে অদক্ষ মানুষ যারা বসে আছে, সেই জায়গাটা পরিস্কার করতে হবে।

এতগুলো পদক পাওয়ার পরও একজন ক্রীড়াবিদ যখন দেশ থেকে সম্মানসূচক কোনো স্বীকৃতি পায় না, তা আগামী ক্রীড়াবিদদের জন্য কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে?

হামিদুল: আমি মনে করি এতগুলো পদক পাওয়ার পরও যখন আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়নি, তখন আমি কিছু বলতেও চাই না, বলার কোনো আশাও নাই। আমি এটাই মনে করি পুরো সমাজটাকে বদলে ফেলতে হবে। এখানে যারা কাজ করছে তারা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।

আপনি ভারোত্তোলন শুরু করেছিলেন কবে?

হামিদুল: আমি ভারোত্তোলন শুরু করেছিলাম ১৯৯২ সালে। ১৯৯৪ সাল থেকে আমার পদক পাওয়া শুরু হয়।

আপনার এখানকার খেলার কী অবস্থা?

হামিদুল: আমি ২০২১ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে তিনটি জাতীয় রেকর্ডসহ স্বর্ণ পদকও জিতেছি।

জাতীয় রেকর্ডগুলো কেমন ছিল?

হামিদুল: আমার ক্যারিয়ারে যেমন ৬২, ৬৯ এসব ওয়েটগুলোতে এত পরিমাণে রেকর্ড আছে যে, আমি মনে করি এই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবে না। আমার রেকর্ড কেউ ছুঁয়ে দেখবে এমন ক্রীড়াবিদ বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। আমি খেলাধুলা জীবনে কোনোদিকে তাকায়নি, কোনো কিছু পাইওনি। কিন্তু যখন ফেডারেশন আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে আমি আশাবাদী হয়েছিলাম। তবে আমাকে না দেওয়ায় আমি মর্মাহত হয়েছিল। আমার মতো ক্রীড়াবিদকে যখন পুরস্কার দেওয়া হয়নি, তখন আমার মনে হয়েছে আমার সবকিছুই অযোগ্য। না আসলে আমি যোগ্যই, ওখানে যারা বসে আছে শতভাগই তারা অযোগ্য। এই অযোগ্য লোকদের না সরানো পর্যন্ত আমরা ক্রীড়াঙ্গনে ভালো কিছু করতে পারবো না।

আগামীতে নিশ্চয় খেলা চালিয়ে যাবেন?

হামিদুল: আমি আর খেলব না। আর এই খেলায় আমি কাউকে উৎসাহ দেব কিনা আমি জানি না। কারণ এখন আমি মানসিকভাবে খুবই হতাশ। আমার মনে হয় না আমার মুখ দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের ভালো কোনো কথা আসবে বা কাউকে উৎসাহ দেব। 

খেলায় আপনার অনুপ্রেরণা কে ছিলেন?

হামিদুল: আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে মোয়াজ্জেম নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন। উনিই আমাকে এই খেলায় নিয়ে এসেছেন। আর ঢাকাতে আসার পরে আমাকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন উইং কমান্ডার মহিউদ্দিন। তিনি সেসময় বাংলাদেশ ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি হয়তো সেভাবে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারেননি। তবে মৌখিক ভালোবাসা দিয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ওনার কারণেই হয়তো আমি আজ হামিদুল হয়েছি।

আপনি কি চান পরের জেনারেশনের কেউ এই খেলাতে আসুক?

হামিদুল: আমি মনে করি… কেন আসবে? কেউ আমার মতো ধুঁকে ধুঁকে, খাওয়া নাই, টাকা নাই, ভবিষ্যৎ নাই। কোনো কিছু নাই, অন্ধকারে কেন আসবে। আলোর পথ আসলে অবশ্যই আসবে। আমি তো মনে করি আমার পুরো জীবনটাই অন্ধকার। আমি আমার পরিবারের কাছে এখন একজন বাকপ্রতিবন্ধী। কারণ আমি কোনো জবাব দিতে পারি না।

আপনার পরিবারের কেউ এই খেলায় আসবে?

হামিদুল: আমার আশা আছে, ছিল। তবে কেন তাদের আনব সেটিও সন্দেহ আছে, আমি নিজেই এখন বিভ্রান্তিতে আছি। কোন আশায় তাদের এই অন্ধকারে ঠেলে দেব।

এই খেলার ভবিষ্যৎ কি আপনি বাংলাদেশে দেখছেন না?

হামিদুল: আমি মনে করি এটা সম্ভবই না। আমার গচ্ছিত কিছু সম্পদ ছিল, এই খেলার জন্য সেটা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। এই খেলা ধনীদের খেলা, কিন্তু ধনীর ছেলেরা তো মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, তারা তো ভারোত্তোলন খেলে না। এটা খেলতে হলে খাবারের জন্য প্রতিদিন ২-৩ হাজার টাকা প্রয়োজন। এই খেলাটায় সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। আমি মনে করি না কোনো শিল্পপতির ছেলে এই খেলায় আছে। এই খেলায় একেবারে নিম্নবিত্তরা এসেছে।

ভারোত্তোলনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কেমন?

হামিদুল: এখানে কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। আমাদের ফেডারেশনের যে দুর্দশা, এখানে যে বাজেট হয় তাতে করে একজন পিয়নের টাকাও হয় না। তাহলে একজন ভারোত্তোলকের প্রতিদিনের যে ২-৩ হাজার টাকা খাবারের পেছনে ব্যয় হয়, সেটা কোথায় থেকে আসবে। তাদের কাছে গেলে শুধু মৌখিক ভালোবাসা। তারা আসলে কী দেবে, তাদের কাছে যা আছে তারা তাই দিয়েছে। তারা যে খেলোয়াড়দের ধরে রেখেছে এটাই অনেক বেশি।

আপনাকে ধন্যবাদ।

হামিদুল: আপনাকেও ধন্যবাদ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments