Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামআমাদের উন্নয়ন নীতি কতটা কর্মবান্ধব?

আমাদের উন্নয়ন নীতি কতটা কর্মবান্ধব?

ড. আর এম দেবনাথ

এলসি খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো, কিন্তু বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। ধনী, অতিধনীরা ফার্স্ট ক্লাস, কিউ-সুইট বুকিং করে বিদেশ যাচ্ছে। কোত্থেকে আসছে ডলার? না, বাংলাদেশের ধনী, অতিধনীদের কোনো সমস্যা কোনো কিছুতেই নেই। বিমানের টিকিটে সমস্যা নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য এসেছে, তা ছোটাতেও তাদের সমস্যা নেই। একটি ফোন, সরাসরি ফোনই যথেষ্ট। ভ্যাটের আপত্তিও ফোনে ফোনে তারা সারে।

বস্তুত কোনো সেবা পেতেই তাদের কোনো সমস্যা হয় না। অবশ্য শুধু বাংলাদেশি ধনী, অতিধনীদের বেলায়ই তা প্রযোজ্য নয়; সারা বিশ্বের অতিধনীদের একই অবস্থা। তাদের রমরমা ব্যবসা চলছেই। তারা আরও ধনী হচ্ছে, ধনী থেকে শ্রেষ্ঠ ধনী হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ছোটদের নিয়ে, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়ে। তারা যাবে কোথায়? তাদের কথা বলার কোনো লোক নেই। সবাই ব্যস্ত বড় বড় সমস্যা নিয়ে। ডলার সমস্যা, বড় বড় ঋণের সমস্যা, শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের পুনঃতফসিলের সমস্যা, বড় বড় প্রকল্পের সমস্যা-এসব নিয়েই সবাই ব্যস্ত। ব্যস্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ে। কার কথা কে শোনে? ছোটদের কথা, কৃষকের কথা কে বলে?

উদাহরণ দেই। কিছুদিন আগে আমার পাড়াতেই একটি পুরোনো বিল্ডিং ভাঙে এর মালিক। নতুন দালান হবে। অথচ ওই বিল্ডিংয়ে এই গোটাদশেক ছোট ছোট দোকান ছিল। লেপ-তোশক, সেলাই, মুদিখানা, বিকাশ সুবিদা, ইস্ত্রি, পানের দোকান-এসব ব্যবসা আর কী। হঠাৎ তারা উচ্ছেদ হয়। দশটি দোকান মানে দশটি পরিবার। কোথায় যাবে তারা? কার কাছে কী বলবে? ওয়ার্ড কাউন্সিলর, মেয়র, মন্ত্রী, ব্যাংক-কোথায় অভিযোগ জানিয়ে বলবে ‘আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা করে দাও’? দেখলাম উচ্ছেদকৃত দোকানদারদের কেউ কেউ হকারি করছে, কেউ এখনো বেকার, কর্মচ্যুত। কেউ ‘দেশের’ বাড়িতে চলে গেছে পরিবারসহ। হতাশা আর হতাশা।

এমনই আরেকটি কিছু বড় ঘটনা। সেটি একটি বড় বাজারে। সেখানে মাছ, মাংস, সবজি, মুদিদ্রব্য, চাল, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, সেলাই কর্মীসহ হরেকরকমের দোকান। তারা ব্যবসা করে খাচ্ছে অনেকদিন। ভালোই চলছিল। হঠাৎ ছন্দপতন। কোনো একটি প্রভাবশালী গ্রুপ তাদের দোকান-ব্যবসা থেকে উচ্ছেদ করে। পঞ্চাশটিরও বেশি ব্যবসায়ী/দোকান। কর্মচ্যুত হয়ে তারা উপায়ান্তর না দেখে চারদিকে ছোটাছুটি করেছে অনেকদিন। কিছুতেই কিছু হয়নি। কেউ কেউ এখনো কর্ম/ব্যবসাচ্যুত। কেউ হকারি টাইপের কাজ করছে। কেউ ‘দেশের’ বাড়িতে চলে গেছে।

এই যে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম-সেগুলো কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? তা হলেই খুশি হতাম। কিন্তু তা নয়। ছোটরা, মাঝারিরা, অতিক্ষুদ্ররা কোথাও টিকতে পারছে না। গ্রামগঞ্জে একই অবস্থা। ঢাকা শহরেও একই অবস্থা। দুদিন পরপরই রাস্তা থেকে হকার উচ্ছেদ করা হয়। করাই উচিত। কারণ ফুটপাতে দোকনদারি করা অবৈধ। অতএব, আইনেই তারা উচ্ছেদ হবে। কিন্তু তাদের বিকল্প ব্যবস্থা কী?

যেহেতু এই ছোট ছোট দোকানদাররা সমিতিবদ্ধ হয়ে আইন ভাঙছে, সরকার তাদের ফুটপাত থেকে তুলছে; পরমুহূর্তেই তারা আবার সেসব দোকান খুলে রাস্তায় বসছে। দিন দিন ঢাকা শহরসহ সব বড় শহর হকারে হকারে সয়লাব হচ্ছে। রিকশাওয়ালায় সয়লাব হচ্ছে। এরা গ্রাম থেকে আসছে। নদীতে কারও ঘরবাড়ি গেছে। যান্ত্রিকীকরণের কারণে গ্রামে কাজ কমছে। অনেকে গ্রামে মহাজনদের কাছে ঋণী। বিভিন্ন পুরোনো পেশা নষ্ট হচ্ছে।

পদ্মা ব্রিজ একটা বড় অর্জন, সন্দেহ নেই। এর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল উপকৃত হবে, উপকৃত হবে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু পদ্মা ব্রিজের কারণে ঘটে গেছে আরেক ঘটনা। লঞ্চের ব্যবসায়, মাঝিদের জীবনে নেমেছে ধস। স্পিডবোটের মালিকদের ব্যবসায় নেমেছে ধস। লঞ্চের সঙ্গে জড়িত ডজন ডজন শিল্প-ব্যবসা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যবসাচ্যুত, কর্মচ্যুত এ লোকেরা হঠাৎ করে কোথায় যাবে? দেশের অভ্যন্তরে কাজের অভাব। ঢাকায় কিছু কাজ আছে, তাও আজকাল সেই কাজ এবং এতে রোজগারের পরিমাণ ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে।

মাঝি-মাল্লা, সুকানি ইত্যাদি শ্রেণির লোকেদের নতুন কাজ কোথায়? তাঁতি, জেলে, কামার, কুমাররা হচ্ছে কর্মচ্যুত-নতুন ‘টেকনোলজির’ কাছে। তা-ই স্বাভাবিক। টেকনোলজি কাউকে ছাড় দেবে না। নতুন নতুন টেকনোলজি আসবে, পুরোনো কর্মীরা বাতিল হবে। নতুন চাহিদার সৃষ্টি হবে। এটা সাধারণ বিশ্বাস। কিন্তু তা বস্তবে কতটুকু হচ্ছে? নতুন দক্ষতা অর্জন, নতুন কর্ম-উপযোগিতা অর্জন করতে সময় লাগে। এই ফাঁকে মানুষ হয়ে পড়ে বেকার, কর্মচ্যুত। কাজ না পেয়ে শহরে এসে রিকশা চালায়, যেখানে কোনো দক্ষতা-অভিজ্ঞতার দরকার হয় না। ঢাকার আশপাশ অঞ্চলে, এমনকি সুদূর নোয়াখালী ও চট্টগ্রামেও এখন উত্তরাঞ্চলের রিকশাওয়ালার দেখা মেলে।

উত্তরাঞ্চলের মেয়েরাও এখন ঢাকায় মাটি কাটে, লেবারের কাজ করে। এদের প্রায় সবাই কিন্তু নিজ বাড়িতে থেকে ছোট ছোট কাজ করত। রাতে শান্তিতে ঘুমাত। এখন তারা শহরে বস্তিবাসী। এদের জন্য নতুন শব্দ যোগ হয়েছে। এরা ‘নগর দরিদ্র’। গ্রামের দারিদ্র্য শহরে এসে হাজির। ফলে ঢাকা শহরের আকার-অবয়ব বাড়ছে, অতিবৃদ্ধি ঘটছে। এক ঢাকা শহরকে বাঁচাতেই যে খরচ হচ্ছে, এর পরিবহণ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে যে খরচ হচ্ছে, অবকাঠামো গড়তে এবং ধরে রাখতে যে খরচ হচ্ছে, তা দিয়ে সারা দেশের কাজ করা যায়।

দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট কাজ এভাবে মারা যাচ্ছে। মুড়ি-মুড়কি বানানো, মোয়া-নাড়ু তৈরি, ধান ভাঙা, গম ভাঙা, সরিষার তেল তৈরি, গরু পালন, ছাগল পালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদিতে এখন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। বড় বড় কোম্পানি এসব ব্যবসায় ঢুকেছে। অনলাইন ব্যবসা শুরু হয়েছে। ছোট ছোট মালিকরা হচ্ছে কর্মচারী। ঢাকা শহরের ওষুধের দোকান-এক সময় ছিল পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট দোকান; এখন বড় বড় গ্রুপ ওষুধের ব্যবসায় নেমেছে। বিশাল বিশাল ব্যবসা/দোকান/শোরুম তাদের।

ছোট ছোট কাপড়ের দোকান ছিল, মুদি দোকান ছিল। এখন হচ্ছে বড় বড় মল-শপিং সেটার। এক ছাদের নিচেই সব। এমনকি তরিতরকারি, মাছ-মাংস পর্যন্ত। এভাবে দেখা যাবে সর্বত্রই বড় বড় কারবার, বড় বড় ব্যবসার রমরমা অবস্থা। ছোটরা বিনিয়োগ, বিপণন, অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। তারা কি বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করতে পারছে? আমার কোনো ধারণা নেই। মানুষ তাহলে চলছে কী করে?

কিছুটা বোঝা যায় ‘টিসিবি’র ওপেন মার্কেট অপারেশনের কার্যক্রম দেখলে। খোলাবাজারে এমনসব মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছে, যাদের প্রচলিত অর্থে গরিব বলা যায় না। বোঝা যায়, অর্থাভাবে তারা সস্তায় পণ্য কিনতে রাস্তায় নামছে। এটা আরও বোঝা যায় সরকারি কার্যক্রম থেকে। প্রতিবছরই ‘সামাজিক সুরক্ষার’ (সোশ্যাল সেফটি নেট) অধীনস্থ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এতে বরাদ্দও বাড়ছে। দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে, বিনিয়োগ বাড়ছে। তাই প্রশ্ন, ‘সামাজিক সুরক্ষার’ অধীনে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন? কেন সারা দেশের মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে? কেন ‘নগর দারিদ্র্য’, ‘পকেট দারিদ্র্য’ বলে কতগুলো শব্দের জন্ম হচ্ছে? এটা কি আমাদের বর্তমানে অনুসৃত উন্নয়ন নীতিমালার ফল নয়? আমাদের কি উচিত নয় উন্নয়ন নীতিমালা পুনঃপরীক্ষা করে দেখা?

এক্ষেত্রে ব্যাংকের অর্থায়ন অনেক সাহায্যে আসতে পারত। কিন্তু তা হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো ব্যস্ত বড়দের সেবায়। অথচ স্বাধীনতার পর ব্যাংকগুলো জাতীয়করণ করা হয়েছিল সাধারণ মানুষের সেবার জন্য। গ্রামে গ্রামে শাখা খোলার ব্যবস্থা হয়। পল্লী উন্নয়নে ফিন্যান্সের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেই যাত্রা বিঘ্নিত হয় ১৯৮২-৮৩ সালে, যখন বেসরকারি খাতে ব্যাংক দেওয়া শুরু হয় এবং দুটি সরকারি ব্যাংককে বেসরকারি করা হয়।

এই যে উলটো যাত্রা, বাজার অর্থনীতির নামে, তার ফলাফল ব্যাংক খাতের জন্য খুব বেশি সুখকর হয়নি। কথা ছিল ব্যাংক খাত দক্ষ হবে, জনগণ অধিকতর সেবা পাবে, ছোট ছোট উদ্যোক্তা ঋণ সুবিধা পাবে, স্বনিয়োজিত মানুষের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু এর কিছুই হয়নি। আজ বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ব্যবসা মোট ব্যাংক ব্যবসার প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ। কিন্তু এই ব্যবসাজুড়ে রয়েছে ধনীদের ব্যবসা, অতিধনীদের ব্যবসা। ছোট-মাঝারি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্থান এক্ষেত্রে খুবই কম। বড়দের সেবা করতে গিয়ে ব্যাংক খাত এখন খাদের কিনারে। শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণ, পুঁজিস্বল্পতা, প্রভিশন ঘাটতি, দক্ষতার ঘাটতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নানা ধরনের রেয়াত দিয়ে, বড় বড় ব্যবসায়ীদের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যাংকব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।

এদিকে দেশে তৈরি হয়েছে বড় বড় ‘গ্রুপ’, যাদের অনেকেই এখন ‘ওভার বরোড’ কোম্পানি, গ্রুপ। তাদের ক্ষমতা যতটা, তার চেয়ে বেশি তাদের সম্প্রসারণ। অবাধে ও সস্তায় ঋণ পেয়ে তারা গড়ে তুলেছে অনেক ক্ষেত্রে অনেক ‘ওভার ক্যাপাসিটি’। সিমেন্ট, চিনি, ইস্পাত, লোহা, বস্ত্র থেকে শুরু করে সর্বত্র এখন ‘একসেস ক্যাপাসিটি’, এমনকি বিদ্যুতেও। এর বোঝা বহন করতে হচ্ছে ব্যাংক খাতকে। অথচ যদি এর ছটাকও করা হতো ছোট ছোট উদ্যোক্তা, ছোট ছোট ব্যবসায়ী, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য, তাহলে দেশে এত বেকারত্ব, কর্মহীনতা, ব্যবসাচ্যুতির ঘটনা ঘটত না।

আমরা কার্যত ছোটদের প্রতি নজরই দিচ্ছি না। ‘এসএমই’ বলে বলে আমরা এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ‘এসএমই’তে এক লাখ, দুই লাখ, পাঁচ লাখ, দশ লাখের ঋণগ্রহীতা কয়জন? ব্যাংকগুলো ছোট ব্যবসায় যেতে চায় না। বলা হয় ব্যয় বেশি। আরও কত কী? অথচ কে না জানে, ১৬-১৮ কোটি মানুষের দেশে, এত অল্প জায়গার মধ্যে বাঁচতে হলে আমাদের ছোটদের নিয়েই বাঁচতে হবে। প্রযুক্তি দরকার। কিন্তু মানুষের কাজেরও দরকার, চাকরি-কর্মেরও দরকার।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যদি সবাইকে কর্মহীন করে উৎপাদন বাড়ায়, তাহলে সেই উৎপাদিত পণ্য কে খাবে? উন্নয়নের মডেল হিসাবে আমেরিকা, ইউরোপ, চীন, জাপান আমাদের সামনে। চূড়ান্ত উন্নয়ন করেও সেখানে বেকারত্বের শিকার বহু মানুষ। ঘরবাড়ি নেই বহু লোকের। বিয়ে-শাদি, পরিবার সব তছনছ। রাষ্ট্রের আনুকূল্যে বেঁচে আছে অনেকেই। ওইসব দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এমন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যেখানে ছোট ছোট কাজ করে মানুষ বাঁচতে পারে। প্রযুক্তির উন্নয়ন আমাদের ভাত-কাপড়ের বিনিময়ে নয়। অতএব, ছোটদের দেখুন।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments