Friday, April 19, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামআবারো গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির খড়গ

আবারো গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির খড়গ

করোনাকালীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট কাটতে না কাটতেই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তাসহ অর্থনৈতিক সংকট ঘণীভুত হওয়ার সাথে সাথে মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে সাধারণ মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, তখন একের পর এক গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। গতমাসে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বাড়ানোর পর গত সপ্তাহে বিদ্যুতকেন্দ্র ও শিল্পকারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে বলা হয়, আবাসিক ভোক্তা পর্যায়ে এই বৃদ্ধি কার্যকর হচ্ছে না। তবে এই ঘোষণা যে শুভঙ্করের ফাঁকি তা সহজেই অনুমেয়। পইকারি পর্যায়ে বা বিদ্যুতকেন্দ্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি অবধারিত ও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকার আবারো গ্যাস বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে সে সত্যই প্রকাশ করল। তবে দাম বৃদ্ধিই লোকসান বা ভতুর্কি কমানোর একমাত্র উপায় কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আবারো গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এটি সঠিক সময় নয়। নতুন কর্মসংস্থান না থাকা, আয় কমে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই দেশের কোটি কোটি মানুষ অভাবনীয় দুর্ভোগ-দুর্দশা ও দারিদ্রপীড়িত জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। স্বল্প আয়ের মানুষ পরিবারের চাহিদা পুরণ করতে না পারায় পুষ্টিহীনতাসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় বড় ধরণের ঘাটতি তৈরী হচ্ছে।

গত ১৪ বছরে গ্রাহক পর্যায়ে অন্তত ১১ দফা গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বেড়েছে পণ্য ও সেবামূল্য। একই সমান্তরালে মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে বড় ধরণের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে সাধারণ মানুষ। দেড় দশক আগে যে পরিবারকে মাসে ৩০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হতো, বিদ্যুতখাতে সরকারের ভতুর্কির অঙ্ক বহুগুণ বাড়লেও একই পরিমান বিদ্যুত খরচ করে এখন ভোক্তা পর্যায়ে ২০০০ টাকা বিল দিতে হচ্ছে। ভোক্তা পর্যায়ে খরচ বাড়ার সাথে সাথে গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লসের নামে দুর্নীতি, অপচয় ও লুটপাটও আগের চেয়ে বেড়েছে। বার বার মূল্য বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও সিস্টেম লস কমানোর কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের দাম একলাফে ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি করার পর তা কার্যকর হওয়ার আগেই ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির নতুন উদ্যোগ চলমান সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভোক্তা অধিকার সংগঠনের সভাপতি গোলাম রহমানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘ আবার গ্যাসের দাম বাড়নো হলে মানুষের জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে’। এ সময়ে এ ধরণের উদ্যোগ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। ভতুর্কি কমানোর বিকল্প উদ্যোগগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। অধিকাংশ আবাসিক লাইনে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় খোদ রাজধানীতে দিনের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরে চুলা জ্বলছে না। একইভাবে বিদ্যুতে লোডশেডিং অব্যাহত রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত না করে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ অবিবেচনাপ্রসুত।

গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্য সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে দেশে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি কার্যকর ছিল। এ ক্ষেত্রে গণশুনানি ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় সেখানে জনমত ও ভোক্তা অধিকারের প্রতিফলনের সুযোগ থাকে। সম্প্রতি সরকার এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন সংশোধন করে তাদের ক্ষমতা খর্ব করেছে। এতে ইচ্ছামাফিক বিদ্যুত ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের মনোপলির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মূল্যস্ফীতির ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষকে প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসতেও দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে নিস্পেষিত সাধারণ মানুষের দুর্দশা বিবেচনায় না নিয়ে শুধুমাত্র আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে আবারো গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির খড়গ জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত জনগণ মেনে নেবে কিভাবে? সরকার জরুরি প্রয়োজনে রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিপুল ভতুর্কি মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একযুগ আগে। একযুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েও হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের মত অপচয় এখনই বন্ধ করতে হবে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হলেও সারাদেশে লাখ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অবৈধ সংযোগ, দুর্নীতি-অপচয় রোধের উদ্যোগ নিলে লোকসান ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিইআরসি আইনে ভোক্তা ও অংশীজনদের অধিকার ও স্বচ্ছতা অক্ষুন্ন রাখতে হবে। সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামতসহ কাজের সমন্বয় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments