Friday, April 19, 2024
spot_img
Homeধর্মআফ্রিকায় ইসলামের ইতিহাস

আফ্রিকায় ইসলামের ইতিহাস

আফ্রিকায় ইসলামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় ১৭ শতকের দিকে। মক্কায় কাফিরদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে মহানবী (সা.)-এর আদেশে তাঁর সাহাবিদের একটি অংশ ৬১৫ সালের দিকে লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে আকসাম এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।

মুসলমানদের সংস্কৃতি মতে, মক্কা থেকে অন্য আকসামে চলে যাওয়া প্রথম ‘হিজরত’ নামে পরিচিত। ওই দলে ২৩ জন বিশ্বাসী ছিলেন, যাঁরা আবিসিনিয়ায় উপস্থিত হন।

সেখানকার বাদশাহ ছিলেন নাজ্জাসি। তিনি মুসলিম দলটিকে আশ্রয় দেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দেন। পরবর্তীকালে তিনিও ইসলামের পতাকাতলে একত্র হন। পরের বছর আরো ১০১ জন মুসলিম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এদের কিছু লোক বর্তমান সোমালিয়ায় আশ্রয় নেয়। এই এলাকাটি ‘বারবারস ভূমি’র একটি অংশ। এখানে ‘জেইলায়’ তারা দুই কিবলার মসজিদ নির্মাণ করে। নিম্নে আফ্রিকায় ইসলামের প্রসারের একটি পর্যায়ক্রমিক চিত্র তুলে ধরা হলো।

৬২৭ সাল : আফ্রিকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ নির্মিত হয়, যেটি ইরিত্রিয়ার ‘মাসাওয়া’ শহরে অবস্থিত।

৬৪১ সাল : তখন মদিনা রাষ্ট্রের খলিফা ইবনুল খাত্তাব (রা)। এ সময় মুসলিম সেনারা বর্তমান মিসর ও লিবিয়া অধিকার করে। প্রাচীনকালে মিসর উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ ছিল। আর লিবিয়া উত্তর আফ্রিকার একটি দেশ।

৬৪৭ সাল : তৃতীয় খলিফা উসমান (রা,)-এর খেলাফতকালে মুসলমানরা আফ্রিকান দেশ তিউনিশিয়া অধিকার করে। এর পর থেকে উত্তর আফ্রিকায় ইসলামের প্রসার এগিয়ে চলে।

৬৮০ সাল : উমাইয়া খেলাফতকালে আলজেরিয়ার বিরাট অংশ মুসলমানদের করতলগত হয়।

৬৯৮ সাল : আফ্রিকার বাইজেন্টাইনরা ‘কারথেইজ’ থেকে অপসারিত হয়। এরপর মুসলমানরা ‘বারবার’ দেশটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

৬৪৭ থেকে ৭০৯ সাল : ঐতিহাসিক তথ্যে জানা যায়, উমাইয়া খলিফাদের কর্তৃক উত্তর আফ্রিকা বিজিত হয়। এই সময়কালে আফ্রিকায় খ্রিস্টান আধিপত্য শেষ হয় এবং কয়েক শতক ধরে ইসলামের জয়জয়কার নিশ্চিত হয়।

৭১১ সাল : মরক্কো থেকে মুসলিম সেনারা জিব্রাল্টার পার হয়ে ইউরাপে প্রবেশ করে।

৭৫০ সাল : আরবের মুসলমানরা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড়সড় ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ সময় আরব মুসলমান সেনারা স্পেনে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করে। এই সাম্রাজ্য তিন তিনটি মহাদেশে প্রভাব বিস্তার করে। উত্তর ও দক্ষিণ আফ্রিকার এই মুসলমানরা ইউরোপে ‘মুরস’ নামে পরিচিত।

৭৫০ থেকে ৮০০ সাল : আব্বাসীয় খলিফাদের এই সময়কালে আফ্রিকায় মুসলমানদের প্রভাব আরো বিস্তৃত হয়। তখন নিল নদের উপত্যকা থেকে নাইজার এবং মরুভূমি থেকে আরব বণিকরা ছড়িয়ে পড়ে।

অষ্টম ও নবম শতক : এই দুই শতাব্দীর মধ্যভাগে আরবের বণিকরা, ভ্রমণকারীরা এবং আফ্রিকানরা আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম আফ্রিকা এবং মধ্য সুদানে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইসলামের প্রসার ঘটায়। ওই এলাকায় প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ছিল সুদানের ব্যবসায়ীরা। নবম শতাব্দীতে ‘হর্ন অব আফ্রিকা’য় মুসলিম সুলতানদের রাজত্ব কায়েম হয়। দশম শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে সেনেগাল নদী পর্যন্ত ‘আলমোরাভিড’ রাজবংশ প্রভাব বিস্তার করে।

৯০০ সাল : আরব বণিকরা ঘানায় আগমন করে। তারা স্থানীয় লোকদের ইসলামে দীক্ষিত করে। তারা সেখানে মসজিদ নির্মাণ করে। এ সময় অনেক সরকারি চাকুরে এবং ব্যবসায়ী ইসলাম গ্রহণ করে। তারা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ়করণে, শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহাবস্থানে ইসলামের শিক্ষা লাভ করে। এভাবে ব্যবসায়ী ও ইসলাম প্রচারকদের মাধ্যমে ধীরগতিতে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের আলোর বিস্তার ঘটে।

১১ শতক : এই সময়ে আফ্রিকায় ‘আলমোরাভিড’ বংশের হস্তক্ষেপে নেতৃত্ব দান করে বারবারদের একটি গোষ্ঠী, যারা ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিল। এর পর থেকে ঘানা ও এর নিকটবর্তী এলাকায় ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। অনুরূপভাবে ‘সাওয়ালি’ উপকূলেও ইসলামের বিস্তার হয়। ১১ শতকের মধ্যভাগে ‘কানিম’ সাম্রাজ্যের প্রভাবে সুদানে ইসলাম ব্যাপকতা লাভ করে। একই সময়ে ‘বরনু’ সাম্রাজ্যের শাসকদের মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকায় ইসলাম ব্যাপ্তি লাভ করে। তবে ওই সব এলাকার সাধারণ মানুষ, যাদের বেশির ভাগ ছিল কৃষক, তারা প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ না করলেও শাসকদের দেখাদেখি তারাও ইসলামের পতাকাতলে এসে আশ্রয় নেয়। ওদিকে দশম শতকে আরব বণিকরা যখন আফ্রিকায় আগমন করে, তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ইসলামী পণ্ডিতও এখানে আগমন করেন। এই ইসলামী পণ্ডিতরা আরবি বলতে ও লিখতে পারতেন। ফলে আফ্রিকায় ইসলাম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আরবি ভাষাও সেখানকার লোকদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তারা সহজেই কোরআনের ভাষা বুঝতে পারে। আরবিতে পড়া এবং লেখায় তারা পারদর্শী হয়ে ওঠে এবং সাক্ষরতার হারও বৃদ্ধি পেতে থাকে।  

১২ শতক : এই শতকে আফ্রিকার দক্ষিণ এলাকায় বিশেষ করে মোজাম্বিকে ‘কিলওয়া সালতানাত’ সাম্রাজ্য বিস্তার করে। ১২৩৫ সালে ঘানার পতন হলে একই সময়ে মালির উত্থান হয়। ১৩০৭ সালে মুসলিম শাসকের অধীনে মালিতে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। রাজা ‘মানসা মুসা’ মক্কা থেকে ইসলামী পণ্ডিতদের মালিতে নিয়ে আসেন। তাঁরা মালির শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ইসলামের প্রশিক্ষণ দান করেন। এই সময়ে মালির সম্প্রসারণও ঘটে। তবে পরবর্তী শাসকরা মালির সীমানা ধরে রাখতে পারেনি।

১৪০০ সাল : এই সময় মালি দুর্বল হতে থাকে। তখন ‘বারবাররা টিমবুকটু’ ও ‘ওয়ালটার’ শিক্ষাকেন্দ্রগুলো তাদের অধিকারে নিয়ে নেয়।

১৪৩৫ সাল : ‘সোনগাই’ অঞ্চলের যুবরাজ মালি থেকে আলাদা হওয়ার জন্য ‘গাওয়ার’ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পরবর্তী এক যুগে প্রতিবেশী এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে এবং ইসলামী বিধান চালু করেন।

১৪৯০ সাল : মুসলিম শাসক ‘আসকিয়া মুহাম্মাদ’ ইসলামকে জাতীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে তিনি অমুসলিমদের ইসলামে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। তা ছাড়া তিনি দেশটিকে ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

১৫০০ সাল : ইসলামী ‘সোনগাই’ তখন আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

১৫৮৫ সাল : এ বছর মরক্কো সোনগাইয়ের লবণের খনি দখল করে নেয়। এর কয়েক বছরের মধ্যে তারা সাম্রাজ্যের স্বর্ণের সন্ধান পেয়ে যায়। বাস্তবিক পক্ষে, অবশেষে গোয়া, টিমবুকটু এবং সোনগাই মরক্কোর সেনাদের অধীনে চলে যায়। এরই মধ্যে ষোলো শতকে ‘ওআড্ডাই সাম্রাজ্য’ এবং ‘কিংডম অব কানো’ ইসলাম গ্রহণ করে।

১৮ শতক : এ সময় নাইজেরিয়াভিত্তিক ‘সুকুটো খিলাফত’ ইসলাম প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এর নেতৃত্ব দেন উসমান ডান ফোডিও।

১৯ শতক : এই শতকের প্রথম দিকে ‘ঝানজিবার সালতানাত’-এর সময় ‘মালাউবি’ এবং ‘কঙ্গোতে’ ইসলামের আলো গভীরভাবে প্রোথিত হয়। এরপর ব্রিটিশরা তাদের কলোনি স্থাপনের সময়কালে এখানে ভারত থেকে শ্রমিক নিয়ে আসে, যার মধ্যে কিছু  মুসলমানও ছিল। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশদের এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।

বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় অর্ধেক এলাকায় ইসলাম সবচেয়ে বিকাশমান একটি ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আফ্রিকার ‘মাগরিব’ অঞ্চল তথা আলজেরিয়া, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো এবং তিউনিশিয়ায় ইসলামের এই ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। ইসলাম ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলেও ব্যাপকতা লাভ করেছে। এই অঞ্চলগুলো হলো—জিবুতি, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং ডি ফেক্টো সোমালিল্যান্ড। তা ছাড়া আছে ‘সাহেল’ অঞ্চল। এই অঞ্চলের দেশগুলো হলো—বুরকিনা ফাসো, ক্যামেরুন, চাদ, গাম্বিয়া, গায়না, মালি, নাইজার ও সেনেগাল। পশ্চিম আফ্রিকায়ও ইসলামের ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত বলে জানা যায়।

মোটকথা, আফ্রিকা ইসলামের একটি উর্বর ভূমি। এই মহাদেশের বেশির ভাগ দেশে ইসলাম প্রথম দিক থেকেই বিস্তার লাভ করে। আজও ইসলামের বিকাশ ও বিস্তৃতি উল্লেখযোগ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।  

লেখক : সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, বর্তমানে হেড অব বিজনেস অ্যান্ড শরিয়াহ সেক্রেটারিয়েট, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments