স র জ মি ন জাফলং
ঘরেই ছিলেন নুরুল ইসলাম। আন্দাজ করতে পারছিলেন কিছু একটা হচ্ছে। হঠাৎ প্রবল ঢল। সেই সঙ্গে বিকট শব্দ। সবকিছু তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। পাশের ঘর থেকে চিৎকার। বাইরে বের হতে পারছিলেন না। এমন সময় নিজের ঘরে তীব্র ঢলের স্রোত। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে প্রবল বর্ষণের মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলেন। একবার ফিরে তাকালেন পেছনে।
পাকাবাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে ডাউকির গর্ভে। এভাবে প্রায় ত্রিশ মিনিটের তাণ্ডব। কিছুই অবশিষ্ট নেই। গোটা ঘর তলিয়ে গেল নদীগর্ভে। গতকাল কেঁদে নুরুল ইসলাম জানাচ্ছিলেন সর্বস্ব হারানোর কথা। ১৭ই জুন এ ঘটনা সিলেটের জাফলংয়ের অদূরের নয়াগাঙ্গের পাড়ে। শুধু নুরুল ইসলামই নয়; একসঙ্গে নদীতে তলিয়ে গেছে ৯টি পরিবারের বসতবাড়ি। তা-ও ছিল আবার পাকা ও সেমিপাকা বাড়ি। পাশেই ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়। এই পাহাড়ের ঢল এমনিভাবে সিলেটের গোয়াইনঘাটে ঢলের তাণ্ডব চালিয়েছে। এখন ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। নুরুল ইসলামদের সর্বস্ব হারানোর ঘটনা যারাই শুনছেন তারা আফসোস করছেন। এখন ঘরবাড়ি নেই ওই ৯টি পরিবারের। আশ্রয় নিয়েছেন এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে।
এক সঙ্গে তলিয়ে যায় মাঈন উদ্দিন, আবুল হক, হাসান আলী, অকিজ মিয়া, জয়নাল আবেদীন, ইউনুস মিয়া, গাজী মিয়া ও গনি মিয়ার ঘর। নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়া মাঈন উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রশিদ পুলিশের সদস্য। চাকরি করেন সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে। সব হারানোর খবর পেয়ে তিনি মা ও বাবার কাছে ছুটে এসেছেন। জানালেন- ‘বিশ্বম্ভরপুর থেকে শুনছিলাম ঢল নেমেছে। এরপর মোবাইলে পাচ্ছিলাম না। টানা চার দিন খুব চিন্তিত ছিলাম। চার দিন পর জানলাম উজানের ঢলে সব তলিয়ে গেছে। এরপর ছুটি নিয়ে এসেছি। জানি না আমাদের পরিবার আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা।’ মধ্য জাফলং ইউনিয়নে নয়াগাঙ্গের পাড়। ডাউকীর তীরে এই গ্রামের অবস্থান। নদীও বাঁক নিয়েছে তাদের বাড়ির পাশে। ফলে ঢল নামলে জাফলং থেকে গিয়ে সরাসরি আঘাত করতো তলিয়ে যাওয়া বাড়িগুলোতে। এভাবে প্রতি বছরই ঢল আসে। কিছু সময় পানি থাকে। এরপর নেমে যায়। কিন্তু এবারের ঢলে আর শেষ রক্ষা হলো না তাদের। তলিয়ে যাওয়া ৯টি বাড়ির পাশের বাড়ির বাসিন্দা আব্দুল আজিজ শিকদার। এক সময় তিনি প্রবাসে বসবাস করতেন। জানালেন ওই দিনের চিত্র। বললেন- ‘সেদিন ছিল শুক্রবার। রাত থেকে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। সেই সঙ্গে বজ্রপাতও। নদীতে পানি বাড়ছিল।
কখনো কখনো শাঁ শাঁ শব্দ করে ঢল নামছিল। গ্রামের কেউ ওই রাতে ঘুমাতে পারেননি। সবাই ভয়ের মধ্যে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো বাইরে সুনামি হচ্ছিল। এভাবে রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়। চোখের সামনেই দেখছিলাম উজানের ঢলের তাণ্ডব। পানি বাড়ছিল। সবার মধ্যে ভয়। হঠাৎ করে ঢল আঘাত করে বাড়িঘরে। মনে হচ্ছিল সুনামি হচ্ছে। সেই সঙ্গে চিৎকারের সুর আসছিল। সকাল তখন ১০টা। নুরুল ইসলামের বাড়ির ওদিক থেকে চিৎকার আসছিল। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করা হচ্ছিল। বাইরে বের হয়ে দেখি ওরা দৌড়াচ্ছে। ভারি বর্ষণের মধ্যে যে যেদিকে পারছিলেন নিরাপদে ছুটছিলেন। এমন সময় প্রচণ্ড শব্দ হয়। আর শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর ভাঙতে থাকে। একেক করে ৯টি বাড়ি চোখের সামনে তলিয়ে যায়।’ তিনি জানান- ‘মাত্র ত্রিশ মিনিটের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বাড়িগুলো। ওই বাড়িগুলোতে বসবাসকারী ৩০-৩৫ জন মানুষ কোনো মতে প্রাণে বেঁচে গেছেন। অনেক শিশু ও মহিলাকে আমরা উদ্ধার করেছি। আমরাও ছিলাম আতঙ্কে।
ঢল কিছুটা কমে আসার পর আমরা রেহাই পাই। এরপর টানা চার দিন সবাই পানিবন্দি ছিলাম। বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।’ ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বাসিন্দা হাসান আলী জানিয়েছেন, ‘আমরা ঘর থেকে একটি সুতাও বের করতে পারিনি। স্ত্রী-সন্তানদের কোনো মতে প্রাণ বাঁচিয়েছি। আরও দু’মিনিট দেরি হলে আমরা সবাই ভেসে যেতাম। এমন ঢল জীবনে কখনো দেখেননি বলে জানান তিনি। যেন গোটা জাফলং ভাসিয়ে আমাদের ওপর আচড়ে পড়ছিল।’ আশ্রয়হীন জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন, ‘আমরাও কেউ-ই গরিব না। আমাদের চারটি ঘর পাকা ও ৫টি ঘর ছিল সেমি পাকা। শক্ত মজবুত ঘর ছিল। সাজানো সংসার ছিল। স্বপ্নেও ভাবিনি এ ভাবে আশ্রয়হীন হবো। এখন তো সব শেষ। অবশিষ্ট বলতে কিছু আর থাকলো না। আমাদের প্রায় ১০ বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঘটনার পর টানা ৫ দিন অনাহারে, অর্ধাহারে কাটিয়েছি। এখন আমাদের মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই। সব তছনছ হয়ে গেছে।’ এমন ঘটনায় হতবাক ক্ষতিগ্রস্ত জয়নাল আবেদীন। তিনি জানান, ‘আমরা পাথর সহ নানা ব্যবসা করে পাকা, আধাপাকা ঘর বানিয়েছিলাম। জীবনের সব সঞ্চয় ব্যয় করেছি বাড়ি বানাতে। এখন পথে নেমে গেলাম।
প্রলয়ঙ্করী ঢল আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলো।’ তিনি বলেন- ‘আমরা এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পেছনে তাকিয়ে শুধু ঢলের তাণ্ডব দেখছিলাম আর চিৎকার করছিলাম। মনে হয়েছিলো কেয়ামত নেমে এসেছে।’ এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে একাকার বাসিন্দা ও গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ফারুক আহমদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ছুটে যান। তিনি জানালেন, ‘উজানে ঢল তাণ্ডব চালিয়েছে গোটা এলাকায়। ঢলের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন লোকজন। অনেককেই তখন নিরাপদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর তাদের মধ্যে খাবার দেয়া হয়েছে। ঢলে বাড়িঘর, গবাদিপশু, আসবাবপত্র সব ভেসে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন বাঁচানোই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।